কোন কাজ যে ছোট নয় সেটা সাইদুল বাশার বোঝেন, আমরা বুঝি কি?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমরা কথায় কথায় তরুণদের উদ্যোক্তা হতে বলি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলি। অথচ সাইদুলের মতো তরুণরা যখন বাধার দেয়াল ভেঙে উদ্যোক্তা হবার পথে নামেন, তখন তাদের 'সবজি বিক্রেতা' আখ্যা দিয়ে বাতিলের খাতায় ফেলে দেই...
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র করোনাকালে সবজি বিক্রি করছেন, এটা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। কেউ সাধুবাদ দিচ্ছেন, কেউবা বলছেন ভাইরাল হবার ধান্ধা। কেউ আফসোস করছেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করা একজন ছাত্রকে কেন সবজি বিক্রি করতে হবে এই ভেবে। কেউ করোনার দুঃসময়কে দুষছেন, কেউবা আবার দেশের জব সেক্টরের সমালোচনায় মত্ত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রের নাম সাইদুল বাশার। ইসলামের ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন তিনি। করোনাকালে তার সবজি ঘটনাটা ছড়িয়েছিল তার এক সহপাঠীর মাধ্যমে। সেই সহপাঠী ফেসবুকে সাইদুলের সবজি বিক্রির ছবি আপলোড দিয়ে লিখেছিলেন-
"করোনাকালীন অবসর সময় আমার এই ক্লাসমেট সবজি বিক্রি করে আয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটাকে অর্থনীতির ভাষায় কি বলে জানেন? উদ্যোক্তা। যেখানে আপনার আমার স্কুল পাশ ভাইবোনরা লজ্জা পায় কোন উদ্যোগ নিতে সেখানে সে ঢাবি থেকে মাস্টার্স পাস করে খুশি মনে উদ্যোগ নিয়েছে। সে কি একটু হলেও আপনার আমার মনের ভয় দূর করতে পেরেছে? মনকে মুক্তি দিতে পেরেছে? সমাজের কাছে নিজের মনকে, স্বাধীনতাকে আর বন্দি করে রাখবেন না। চোখ খুলুক আপনার আমার।"
সেই স্ট্যাটাসটা ভাইরাল হয়েছে, অনেকেই জেনেছে সাইদুলের কথা, তার জীবন সংগ্রামের কথা। সাইদুল সবজি বিক্রিটাকে ছোট করে দেখেননি, কাজ তো কাজই, তিনি বরং কাজের প্রতি সৎ থাকাটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যে কোন বিষয়ে তো আমরা দুই ভাগ হয়ে যাই, এখানেও সেই ঘটনা ঘটেছে। অজস্র মানুষ যখন সাইদুলের প্রশংসা করেছেন, তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, তারই ফাঁকে আজেবাজে কিছু মন্তব্যের শিকারও হতে হয়েছে সাইদুল বাশারকে। তিনি আলোচনায় থাকার জন্য, ভাইরাল হবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করেছেন- এমন অভিযোগও তুলেছেন কেউ কেউ। সেসবের জবাবে সাইদুল ফেসবুকে লিখেছেন-
"আমার বাবা পেশায় ফুটপাতে সবজি বিক্রেতা। সবজি বিক্রি করে শুধু সংসার না, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচও এই সবজি বিক্রি করা হতেই আসছে। শুধু আমার না, আমার ছোট ভাইয়েরও। আমার বাবার পেশা ছোট হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেও বাবার সাথে এই করোনাকালীন সময়ে সবজি বিক্রি করতে আমার একটুও খারাপ লাগেনি।
গতকাল অমার একটা ছবি নিয়ে কম টানাহেঁচড়া হয় নি। আমার অনেক বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী ইনবক্সে, ফোনে অনেক কথাই বলছে। তাদের উদ্দেশ্যেই বলছি আমি ভাইরাল হওয়ার জন্য কিছু করিনি। ছবিটি নিছক মজার জন্য তুলছিলাম। কিন্তু সেটা এমন হবে তা বুঝতে পারিনি।
আরেকটা কথা ক্লিয়ার করতে চাই- আমার বাবা একজন সবজি বিক্রেতা, করোনা কালীন অবসর সময়ে বেকার বসে থাকার চেয়ে বাবার সাথে সবজি বিক্রি করা আমার কাছে গর্বের। আমি চুরি, ডাকাতি বা অন্যায়/অবৈধ পথে কিছু করিনি। সবাইকে ধন্যবাদ।"
সাইদুল চুরি করছেন না, ডাকাতি করছেন না, অসৎ পথে উপার্জন করছেন না, কারো ভাগের টাকা মেরে খাচ্ছেন না। পরিশ্রম করছেন, কোন কাজকে ছোট করে না দেখে সবজি বিক্রি করছেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়েছেন বলে অমুক কাজ বা তমুক কাজ করা যাবে না- এমন কোন মিথ্যে অহমিকা নেই তার মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাস গায়ে লাগিয়ে অনেকের মাটিতে পা পড়ে না, অথচ সেখানে সাইদুল নিজের শেকড়কে ভুলে যাননি, গর্বভরে বলছেন, এই সবজি বিক্রি করেই তার বাবা তাদের পরিবার সামলেছেন, তাকে এবং তার ছোট ভাইকে পড়ালেখা করিয়েছেন। এমনটা ক'জনে পারে? আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই তো নিজেদের অতীত ঢেকে রাখতেই পটু।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাইদুলের সেই স্ট্যাটাসেই একজন তাকে বাস্তবতার সবক দিয়েছেন, বলেছেন, সবজি বিক্রেতার কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দেবে না। অনেকে সেই কমেন্টদাতার সমালোচনা করলেও, সেই লোক কিন্ত ভুল কিছু বলেননি। যে স্টেরিওটিপিক্যাল চিন্তাভাবনার জগতে আমরা বাস করি, সেখানে একজন সবজি বিক্রেতার কাছে মধ্যবিত্ত ঘরের কোন বাবা-মা তাদের মেয়েকে তুলে দেয়ার কথা ভাবতেই পারেন না, যতোই তার নামের পাশে ঢাকা ভার্সিটির ডিগ্রি থাকুক না কেন। আমরা কথায় কথায় তরুণদের উদ্যোক্তা হতে বলি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলি, আর সাইদুলের মতো তরুণরা যখন বাধার দেয়াল ভেঙে উদ্যোক্তা হবার পথে নামেন, তখন তাদের 'সবজি বিক্রেতা' আখ্যা দিয়ে বাতিলের খাতায় ফেলে দেই।
কোন কাজ যে ছোট না, সেটা সাইদুল বোঝেন, কিন্ত এদেশের শতকরা আটানব্বই পার্সেন্ট মানুষ বোঝেন অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি। তারা পরিশ্রমের কদর করতে জানেন না, সততার মূল্য তাদের কাছে নেই। একজন পরিশ্রমী, সৎ সাইদুলের চেয়ে সরকারী অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর দাম এই সমাজে বেশি, সম্মানটাও বেশি। যত দিন এই ভুল ধারণাগুলো আমিরা ভাঙতে না পারব, ততদিন সাইদুলের সংগ্রামের গল্পগুলো পড়তেই ভালো লাগবে, তার জীবনটাকে কেউ আপন করে নিতে চাইবে না, দুই পয়সার সবজি বিক্রেতা বলে ছুঁড়েই ফেলবে বারবার।
সাইদুলের এই ঘটনাটার পর আরেকটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে বলে মনে হয়। এই যে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংস্কৃত, পালি, ইসলামের ইতিহাস, বুদ্ধিজ স্টাডিজ নামের সাবজেক্টগুলো পড়ানো হচ্ছে, তাও শত বছরের পুরনো সিলেবাসে, পুরনো ধ্যানধারণায়, এগুলো ছাত্রদের কতটা কাজে লাগছে? প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে বের হচ্ছে, তাদের গন্তব্য কোথায়? এই সিলেবাসে পড়াশোনা করে একজন ছাত্র বর্তমান চাকরির বাজারে নিজেকে কতটা যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে? চাকরির পাওয়াটা এখন বিশাল একটা যুদ্ধ, সেই লড়াইয়ে এসব বিষয়ের অ্যাকাডেমিক জ্ঞানটা একজন ছাত্রকে কতটুকু সাহায্য করছে?
সাইদুল বাশারের ঘটনাটা ভাইরাল হয়েছে, হয়তো সমাজের বিত্তবানদের কেউ তার পাশে এসে দাঁড়াবেন, একটা চাকরির ব্যবস্থা হবে তার। যদি সেরকম কিছু না-ও ঘটে, আমরা আশা করব, জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের যে মানসিকতাটা সাইদুলের মধ্যে এখন আছে, সেটা যেন কখনও হারিয়ে না যায়। এই লড়াকু মনোভাব দিয়েই একদিন তিনি সফল হবেন, আকাশ ছোঁবেন, এটাই আমাদের কামনা...