'তারা তিনজন' ও সেন্টমার্টিনে কাটানো অন্যরকম ৫২টি দিন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
লকডাউনের কারণে শেষ জাহাজটাও সেন্টিমার্টিন থেকে ফিরে এলো, ফিরলেন না তারা। গত ৫২ দিন ধরে তিনজন পড়ে আছেন প্রবাল দ্বীপে, সেখানকার প্রকৃতি অন্যরকম রোমাঞ্চ নিয়ে ধরা দিচ্ছে তাদের সামনে...
সেন্টমার্টিনে গিয়েছিলেন তারা সাতজন। করোনার লকডাউনের কারণে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা যখন দেয়া হলো, তখন খানিকটা দোলাচলে পড়ে গিয়েছিলেন তারা। সাতজনের মধ্যে চারজন শেষ লঞ্চে ফিরে এসেছিলেন গত ১৯শে মার্চ, তিনজন রয়ে গেলেন। সেখানেই তারা আছেন গত ৫২ দিন ধরে, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির অন্য এক রূপ নিজেদের চোখে অবলোকন করছেন তারা। নীল আকাশ, সাগরের অশান্ত জলরাশি, স্থানীয় মানুষন আর পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপটাই দু'হাত ভরে ভালোবাসা আর মুগ্ধতার ভাণ্ডার উজাড় করে দিচ্ছে এই তিন পর্যটককে।
গত ১৫ই মার্চ যান্ত্রিক নগরী ছেড়ে খানিক অক্সিজেনের আশায় সেন্টমার্টিনে পাড়ি দিয়েছিলেন সাত যুবক। করোনার প্রকোপ তখনও বোঝা যায়নি সেভাবে। ১৮ই মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম বাংলাদেশীর মৃত্যু হলো, তারপর পাল্টে গেল সব হিসেব। অফিস আদালত বন্ধের সম্ভাবনা তৈরী হলো, করোনা মোকাবেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউনের দিকে হাঁটবে দেশ- বুঝে গেল সবাই। সেন্টমার্টিনে তখনও ট্যুরিস্ট সিজন শেষ হয়নি, টেকনাফ থেকে জাহাজও চালু আছে। পর্যটকদের জানানো হলো, ১৯শে মার্চ দ্বীপে থাকা সব পর্যটককে নিয়ে জাহাজের সবশেষ বহরটি দ্বীপ ত্যাগ করবে। এরপরে আর কোন জাহাজ আসবে না এখানে।
সাতজনের মধ্যে তিনজন, এনজামুল হক, আরশাদ হোসেন ও সালেহ রেজা সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা ঢাকায় ফিরবেন না। অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা এর আগেই চলে এসেছে, কাজেই ঢাকায় ফেরার তাড়া নেই। তারা ঠিক করলেন, আসছে দিনগুলো সেন্টমার্টিনেই কাটাবেন। ঝুঁকি তো ছিল। লকডাউন কতদিন স্থায়ী হয়, কবে নাগাদ এই নীল জলরাশি পেরিয়ে আবার স্থলভাগের দেখা পাওয়া যাবে, কবে জড়িয়ে ধরা হবে পরিবারের সদস্যদের, তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। তবুও এই তিনজন ঝুঁকি নিলেন একটা, অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাতলেন।
১৯শে মার্চ দলের চার সঙ্গী এবং বাকী পর্যটকদের জাহাজে তুলে দিয়ে জেটিতে দাঁড়িয়ে বিদায় জানালেন এনজামুল, আরশাদ ও সালেহ। শুরু হলো তাদের অন্যরকম এক জীবন, যে জীবনের খোঁজ তারা সবসময় করেছেন, অনিশ্চয়তার খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন দিগ্বিদিক। ট্যুরিস্ট সিজনে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য্য তারা এর আগেও দেখেছেন, কিন্ত পর্যটক শূন্য ফাঁকা দ্বীপটা যে সৌন্দর্য্য আর রহস্যের ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হতে পারে দুয়ারে- সেই রূপ দ্বীপের স্থানীয় অধিবাসী ছাড়া খুব বেশি মানুষের দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
এক দুই তিন চার করে ৫২টি দিন তারা কাটিয়ে দিয়েছেন সেন্টমার্টিনে। বেড়াতে গিয়ে তারা উঠেছিলেন দ্বীপের একটি রিসোর্টে। নির্দিষ্ট সময় পর বিনে পয়সায় সে রিসোর্টেরই একটি কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের। পর্যটক না থাকায় রিসোর্টের দুজন কর্মীর সঙ্গে এক চুলায় খাবার রান্না করে খাচ্ছেন। তাদের রুমটা একদম বিচের পাশে, ফিতা দিয়ে পরিমাপ করলে ৩০ফুটের বেশি হবে না দূরত্ব। তারা রাতে ঘুমাতে যান সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনে, সকালে ঘুম ভাঙেও ওই ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দেই!
এই তিন পর্যটকের মধ্যে আরশাদ হোসেন পেশায় ব্যবসায়ী, এনজামুল হক একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করছেন, সালেহ রেজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বয়সে সবাই আলাদা। একটি ভ্রমণ সংগঠনের সদস্য হিসেবেই আলাদা আলাদা বয়স আর জগতের এই তিনজনের পরিচয়, বন্ধুত্ব। মিল একটাই- তারা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন, অ্যাডভেঞ্চার তাদের প্রিয়। সেই বন্ধুত্বের সূত্রেই গত ১৫ মার্চ সাতজন ঘুরতে গিয়েছিলেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। আর অ্যাডভেঞ্চারকে ভালোবেসে তারা সাহস করে রয়ে গিয়েছিলেন দ্বীপে, সেই সিদ্ধান্তের ফল এখন হাতেনাতে পাচ্ছেন তারা, জীবনের সেরা সময়টা কাটাচ্ছেন নারকেল জিঞ্জিরায়।
স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেখানকারই একজন হয়ে উঠেছেন তারা সবাই। কারো বাড়িতে ভালো রান্না হলে বাটিতে করে তাদের জন্যে দিয়ে যাচ্ছে, জলসার (মিলাদ মাহফিলকে সেন্টমার্টিনের লোকে জলসা বলে) আয়োজন হলে তাদের দাওয়াত পড়ছে, তারাও স্থানীয় মানুষদের ভাষা শেখার চেষ্টা করছেন, বেশ কিছু শব্দ আয়ত্বও করে ফেলেছেন। ফেসবুকে ভ্রমণের গ্রুপে মাঝেমধ্যেই আপডেট দিচ্ছেন তারা, জানাচ্ছেন তাদের দিন কেমন কাটছে সেসব বিষয়ে। সেসব পোস্টের কমেন্টবক্সে লকডাউনে ঘরে আটকে থাকা আমাদের মতো মানুষজন গিয়ে হাহুতাশ করছে, জীবনে জীবনে কত পার্থক্য!
এনজামুল, আরশাদ ও সালেহ একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে শেখালেন আমাদের। জীবনকে উপভোগ করার জন্যে একটু সাহসী হতে হয়, প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে খানিকটা ঝুঁকি নিতে হয়, অনেককিছু পাওয়ার জন্যে অল্প একটু ছাড় দিতে হয়, অনিশ্চয়তায় ভরা পথে হাঁটার সাহসটা করতে হয়। মার্চের ১৯ তারিখে বাকী সবার সঙ্গে এই তিনজনও যদি ফেরার জাহাজে উঠে পড়তেন, এই অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের দেখা তারা কখনও পেতেন না, বদ্ধ ঘরেই কাটাতে হতো সময়। এই রোমাঞ্চকর গল্পটা লেখা হতো না, সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারতেন না 'তারা তিনজন'।
দ্বীপে আটকে থাকার যে ঝুঁকিটা তারা নিয়েছিলেন, তার কয়েকশো, বা কয়েক হাজার গুণ আনন্দ জীবন তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে গত কিছুদিনে, করোনার এই ক্রান্তিকালকে তারা পরিণত করেছেন জীবনের সোনালী সময়ে...