
সেনোরার ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপনের কমেন্টবক্সে গিয়ে আমরা যদি এভাবে নিজেদের সংকীর্নমনতার পরিচয় দেই, তাহলে আবার আশা করি কীভাবে যে এখানে সামাজিক ইস্যু নিয়ে কোন নাটক-সিনেমা হবে?
মন খারাপ থাকলে আমি সাধারণত বাইরে ঘুরতে বের হই। তবে এই করোনার সময়ে তো সেটা সম্ভব নয়। এই সময়ে মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকলে আমি সাধারণত দেশের সেলেব্রিটিদের ফেসবুক পেজ আর দেশের বিভিন্ন কন্টেন্ট শেয়ার হয়,এরকম পেজের কমেন্ট সেকশনে ঘুরতে যাই। বিনোদন আর দেশের বেশিরভাগ মানুষদের রুচি সম্পর্কে মোটামুটি একটা আইডিয়া পেয়ে যাই। তবে অভিজ্ঞতাটা সবসময় সুখকর হয় না বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা হতাশায় রূপ নেয়।
সেরকমই একটা ঘটনা হল কয়েকদিন আগে। সেনোরার একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে দেখলাম বেশ আলাপ আলোচনা হচ্ছে। একটা স্যানিটারি প্যাডের বিজ্ঞাপনের কমেন্ট সেকশনে কিছু মানুষের মন্তব্য খুবই ভয়ংকর। অথচ খুবই সিম্পল আর ছিমছাম একটা বিজ্ঞাপন। বোনের পিরিয়ড হয়েছে, ক্রমাগত মুড সুইং হচ্ছে তার আর এই মুডকে ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছে তার ভাই- বোনের হাতে তুলে দিয়েছে সেনোরার প্যাড। পিরিয়ডের ইস্যু বাদেও ভাইবোনের সম্পর্কটা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সাথে কমেন্টবক্সে ফুটে উঠেছে আমাদের অনেকের মানসিকতা।
হুট করে মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। যখন দোকানে মাকে দেখতাম কি যেন একটা কেনার সময় খুব অস্বস্তিতে থাকতেন আর দোকানদার জিনিসটাকে কাগজে মুড়িয়ে দিতেন। কাগজে মোড়ানো জিনিসটা দাতা আর গ্রহীতা দুজনেই এমনভাবে দিতেন আর নিতেন, আমি ভাবতাম হয়ত কোন টাইম বোমাকে লুকিয়ে আনা হচ্ছে! টাইম বোমা না হলে তো এমন লুকোছাপার কোন কারণ দেখি না- ছোটবেলার চিন্তাটা ছিল এমনই।

সময় চলে গেল অনেক, আর অনেক পরে বুঝতে পারলাম- সেই জিনিসটা বোমার মত মারাত্মক তো ছিলই না বরং সেটা ছিল জীবনকে শান্তি দেয়া স্যানেটারি প্যাড। অথচ পিরিয়ডের মত একটা নরমাল ব্যাপার নিয়ে আমাদের সে কী লুকোচুরি!
মানুষের যেমন জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি হয়- পিরিয়ড ঠিক সেরকমই সাধারণ একটা ব্যাপার। তাহলে জ্বর, ঠাণ্ডা নিয়ে আমরা লুকোচুরি না করলেও পিরিয়ড নিয়ে কেন লুকোচুরি বা হাসিঠাট্টা করি? কারণটা সম্ভবত এটাই যে এই ব্যাপারটি যৌনাঙ্গের সাথে সম্পর্কিত। যে দেশের মানুষ যৌনতার সাথে সম্পর্কিত কোন ব্যাপার নিয়ে কথা বলা মানেই সুড়সুড়ি বা ট্যাবু মনে করে- সেই দেশের জনসংখ্যা কেন ১৮ কোটি- সেটাও একটা প্রশ্ন বটে! আকাশ থেকে তো টুপ করে পড়ি নাই আমরা, নাকি! তাহলে দিনের পর দিন, এই ২০২০ সালে এসেও আমরা কেন স্যানিটারি প্যাডের নাম শুনলে অস্বস্তিতে পড়ে যাই?
রমজানের মত পবিত্র মাসেও অনেক পুরুষকে দেখেছি নারীদের জিজ্ঞাসা করতে- রোজা রেখেছ আজকে? – এটা জিজ্ঞাসা করতে। এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য কিন্তু কোন সাধারণ কৌতূহল না। বরং এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য কোন নারীর পক্ষ থেকে “না, আমার শরীরটা খারাপ, তাই রাখতে পারিনি”- এই লাইনটা শোনা আর এরপরে কুৎসিত একটা আনন্দ লাভ করা। অথচ যারা এই ব্যাপারটি নিয়ে হাসিঠাট্টা করে,তারা সম্ভবত জানেনা যে, পিরিয়ড নামের এই ব্যাপারটা না থাকলে তাদের আজ জন্মই হত না। পিরিয়ডের মত প্রাকৃতিক ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করে, তারা পরোক্ষভাবে নিজেদের জন্ম নিয়েই হাসিঠাট্টা করে- এই ব্যাপারটাও হয়ত তারা কখনও ভেবে দেখেনি।
পুরুষের পক্ষে হয়ত কখনই পিরিয়ড চলাকালীন নারীদের যন্ত্রণাটা বোঝা সম্ভব না। কিন্তু সমব্যথী না হতে পারলেও, সহমর্মী হওয়া যাবে না- এমনটা তো নয়? মাসের এই বিশেষ সময়টায় যেন নারীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটা ঠিক থাকে, তারা যেন হাসিখুশি থাকে, প্যাড জিনিসটা যেন ছেলেরা নিজেরাই কিনে আনে তাদের জন্য- এতটুকু তো পুরুষরা করতেই পারে, নাকি? খুব বেশি চাওয়া কি এটা?

দেশের নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে আমরা একই ধরনের গল্প দেখতে দেখতে বিরক্ত। সেই ঘুরেফিরে প্রেমকাহিনী আরও কত? সামাজিক ইস্যু নিয়ে কোন আলাপ নাই কেন আমাদের কন্টেন্টে?- এই ধরনের কথাবার্তা আমরা যখন প্রায়ই বলি, তখন সেনোরার ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপনের কমেন্টবক্সে গিয়ে আবার আমরাই যদি এভাবে নিজেদের সংকীর্নমনতার পরিচয় দেই, তাহলে আবার আশা করি কীভাবে যে এখানে সামাজিক ইস্যু নিয়ে কোন কন্টেন্ট হবে? অথচ পাশের দেশে অক্ষয় কুমারের মত প্রথম সারির অভিনেতা স্যানেটারি প্যাড নিয়ে দুই ঘণ্টার আস্ত একটি সিনেমা ‘প্যাডম্যান” বানিয়ে ফেলেন।
আমরা যদি একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবি আর ন্যাচারাল জিনিসকে ন্যাচারলি নেয়ার চেষ্টা করি, তাহলে একদিন হয়ত আমরাও প্যাডম্যানের মত বা তার চেয়েও ভাল কিছু নিজেদের নাটক, সিনেমাতে দেখতে পারব। আর তার চেয়েও বেশি আনন্দের ব্যাপার এটা হবে যদি আমরা আমাদের নারীদের পিরিয়ডের ব্যাপারটা নিয়ে ছোটবেলা থেকেই সবাইকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারি। তাহলেই, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন কোন ভাই তার বোনের জন্য স্যানেটারি প্যাড কিনে আনলে বোন অবাক হবে না, বরং ভাই যদি কিনে না আনে তখন বোন গাল ফুলিয়ে বলবে- প্যাড আনতে ভুলে গেলি? কেমন ভাই তুই যে বোনের পিরিয়ডের ডেট মনে রাখিস না?