একজন মানুষ ১১ তারিখ, ১৭ তারিখ কোথায় শুটিং করবেন, কোথায় ডাবিং করবেন, কার কাছে কত টাকা পাওনা আছেন, সেটা নিজের ডায়েরিতে লিখে কীভাবে ৬ তারিখ আত্মহত্যা করেন, সেটা নিয়ে আমরা কেন প্রশ্ন তুলি না?

বাঙালির জাতীয় শোকের মাস বলা হয় আগস্টকে। আগস্টের সেই শোকের রেশ না কাটিয়ে উঠতেই সেপ্টেম্বর এসে উপস্থিত হয় আরেক দফা হাহাকার নিয়ে। এই হাহাকার, অদ্ভুত একাকীত্বের কারণটা একদম সিনেম্যাটিক, সেই কারণের নাম- সালমান শাহ। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সালমান শাহের জন্ম আর মৃত্যু একই মাসে- সেপ্টেম্বর। মানুষের জন্ম আগে হয়, এরপরে মৃত্যু আর সালমান শাহের মৃত্যুর পরে (৬ সেপ্টেম্বর) আসে তার জন্মদিন (১৯ সেপ্টেম্বর)! এখানেও তিনি বাকি সবার চাইতে আলাদা! 

ইদানিং ফেসবুকে অনেক সালমান শাহ ভক্তকে দেখা যায়, যাদের বেশিরভাগের জন্ম সালমানের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে, যারা সালমানের ক্রেজটা স্বচক্ষে দেখেননি। কিন্তু শুনে শুনেই হোক, অথবা বাকিরা ভাল বলছে দেখেই হোক, অথবা আসলেই মনের ভালো লাগা থেকেই হোক- তারা সালমান শাহ নাম শুনলেই অনেক বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তবে অতি আবেগের কারণে অনেকেই অন্যান্য দেশের অন্য নায়কদের সাথে সালমানের তুলনা দিয়ে তাকে অনেকটাই জোর করে “বড়” করে দেখাতে চান, যেটা অনেকাংশে দৃষ্টিকটু লাগে। সেই ব্যাপারেই কিছু লিখতে চাই। 

ফেসবুকে শেয়ার হওয়া খুব জনপ্রিয় একটি ছবি হচ্ছে বলিউডের ডিরেক্টর মোহিত সুরি পরিচালিত সিনেমা আশিকি ২ এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা আদিত্য রয় কাপুরের সানগ্লাস আর টুপির সাথে সালমান শাহ'র অনেক আগের একটি ছবির প্রায় মিলে যাওয়া। এ থেকে আমরা আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্তে চলে আসলাম যে মোহিত সুরি সালমান শাহ'র ছবি দেখে তার সিনেমার নায়কের স্টাইল তৈরি করেছেন! 

মোহিত সুরির জন্ম ১৯৮১ সালে (যদি না বয়স লুকিয়ে থাকেন), ৮১ সালে জন্ম নেয়া একজন মানুষ ৯৪-৯৫ সালে ঢাকাই সিনেমা দাপিয়ে বেড়ানো একজন নায়কের স্টাইল এত বছর পরে নিজের সিনেমাতে নিয়ে আসবেন- জিনিসটা শুনতে কি একটু হলেও হাস্যকর লাগে না?

জোর করে এমন মিল বের করে কি আমরা সালমান শাহকেই নিচে নামাচ্ছি না?

অথবা গুগল থেকে শাহরুখ, সালমান আর আমির খানের বিভিন্ন স্টাইলিশ ছবি বের করে সেগুলোকে অনেকটাই জোর করে সালমান শাহ'র বিভিন্ন স্টাইলের ছবির সাথে মিলিয়ে পরমানন্দ লাভ করে আবার দিন শেষে “এই দেশের সিনেমার কিছুই হবে না, শুধু রিকশাওয়ালারাই দেখে বাংলা সিনেমা” বলে ঘুমাতে যাওয়াটা কতটা যৌক্তিক? 

দয়া করে যদি মনে করেন এই লেখাটা সালমান শাহকে খাটো করার জন্য লেখা হচ্ছে, তাহলে ভুল করবেন। আমি নিজেও একজন চরম প্রকারের সালমান শাহ ভক্ত। ভক্ত দেখেই তাঁকে নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বাড়াবাড়িটা অনেক চোখে লাগে। আমাদের মনে রাখা দরকার, সালমান শাহ্‌ই কিন্তু এই দেশের একমাত্র স্টাইলিশ হিরো না, সালমানের আগেও একজন ছিলেন, যার নাম জাফর ইকবাল। ম্যাগি হাতার গেঞ্জিতে কোন পুরুষকে এতটা সুদর্শন লাগতে পারে, এটা সম্ভবত জাফর ইকবালকে না দেখলে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারতো না। বেদ্বীন নামের একটি সিনেমাতে জাফর ইকবাল একেবারেই নেগেটিভ একটা ক্যারেক্টারে একদম স্যাডিস্টিক অভিনয় করেছিলেন, যেটা এই সময়ে কল্পনাই করা যায় না। এছাড়া খ্যাতির তুঙ্গে থাকা অবস্থায়ই জাফর ইকবাল মিস লংকা সিনেমাতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। 

সালমান শাহ বিভিন্ন রকমের হ্যাট পড়তেন; অসংখ্য হ্যাট, জুতা, স্কার্ফ আর সানগ্লাসের কালেকশন ছিল তার কাছে। কিন্তু এমন না যে এই ধরনের হ্যাট এর আগে কেউ পড়েননি। চার্লি চ্যাপলিন থেকে শুরু করে তখনকার সময়ে করা শার্লক হোমসে এই ধরনের হ্যাট ব্যবহার করা হতো, যেটা সালমান শাহ পড়তেন। তাহলে কি এখন আমরা বলব সালমান শাহ এদের থেকে চুরি করেছেন?

শুধু হলিউড কেন, অন্যান্য দেশের অনেক সিনেমার নায়কই মাথায় স্কার্ফ, চুল পেছনে ঝুঁটি করে বাঁধা- এগুলো ট্রাই করতেন। আমাদের তখনকার সময়ের বাকি নায়কদের সাথে সালমানের পার্থক্য এটাই ছিল যে, সালমান এগুলো খুব দ্রুত নিজের মাঝে অ্যাডপ্ট করেছিলেন। প্রতিটা সিনেমাতেই ভিন্ন কিছু চেষ্টা করতেন। নিজের স্টাইল নিয়ে ভাবতেন, নিজের জামাকাপড় নিজেই ঠিক করতেন কোন ক্যারেক্টারের জন্য কোনটি পড়বেন। 

সালমান শাহ বিভিন্ন রকমের হ্যাট পড়তেন

সালমান শাহকে শাহরুখ, সালমান বা আমিরের সাথে তুলনা দিয়ে আমরা যেন আমাদের হীনমন্যতাই প্রকাশ করে ফেলি নিজের অজান্তে। কেন তুলনা দিতে হবে? তুলনা না দেয়া পর্যন্ত কি আমরা প্রমাণ করতে পারব না সালমান শাহ কতটা ভাল ছিলেন তার ক্ষেত্রে? যাদের সাথে তুলনা দিচ্ছি, তারা তো গত ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন, আমাদের সালমান তো চার বছরের মতো ছিলেন প্রায়, তাহলে কীভাবে তুলনাটা দেই?

এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে চার বছরে সালমান শাহ যা দেখিয়েছিলেন, বেঁচে থাকলে নিজের আরও প্রতিভা দেখাতে পারতেন। কিন্তু বেঁচে থাকা যারা এই প্রতিভাটা দেখাচ্ছেন তাদের সাথে আমাদের ক্ষণজন্মা সুপারস্টারের তুলনা করে আমরা কি এক প্রকারে সালমানকেই ছোট করছি না? সালমান সালমানের জায়গায় সেরা, সেটা অন্য কারো সাথে তুলনা দিয়ে প্রমাণের দরকার নেই- এভাবে কেন বলতে পারি না আমরা? নাকি হলিউড আর বলিউডকে এমনভাবে আমরা তুলাদণ্ড হিসেবে মেনে নিয়েছি যে, সেখানকার কারো সাথে তুলনায় না জেতা পর্যন্ত আমাদের কোন “নায়ক” কে “নায়কই” মনে হয় না?

অনেকে আবার একটু অন্য কথা বলেন, শুধুমাত্র মরে যাওয়ার কারণেই নাকি সালমানকে নিয়ে এত মাতামাতি, তা না হলে নাকি তাকে নিয়ে মাতামাতির তেমন কোন কারণ নেই! প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের আরও অনেক নায়কই তো অল্প বয়সে (সালমানের মতো এত অল্প না যদিও) মারা গেছেন বা অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন। তাদের তাহলে এত ফ্যানবেজ নেই কেন?

জাফর ইকবাল, সোহেল চৌধুরী, জসিম বা মান্না, এরাও তো মারা গেছেন, এদের মৃত্যুর পরে তাহলে এদেরকে নিয়ে এত মাতামাতি হয় না কেন? সালমান শাহ মরে যাওয়ার পরে তার যেসব সিনেমা রিলিজ হয়েছে, সেগুলো ব্যবসায়িকভাবে অনেক সফল ছিল- এরকম কপাল কি আর কারো হয়েছে? সালমানের পরবর্তী সময়ে নায়ক হয়ে আসা প্রায় সবার কাছে আইডল মানেই সালমান শাহ- সালমান যদি শুধু মৃত্যু কারণেই এত জনপ্রিয় হয়ে থাকেন, তাহলে এগুলো কী?

এদেশের আর কোন নায়কের মৃত্যুর পরে তার ভক্তরা আত্মহত্যা করেছিলেন আর সেই নিউজ টাইম ম্যাগাজিনের মতো আন্তর্জাতিক পত্রিকায় এসেছিল? এরপরেও কি তাদের কাছে সালমান শুধু মৃত্যুর কারণেই স্টার? অনেকের কাছে সালমান শাহ আবার শুধুই রোম্যান্টিক হিরো, এর বেশি কিছু না। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই যিনি বিক্ষোভের মতো রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মী সিনেমা করেছেন, সুজন সখীতে যিনি সম্পূর্ণ গ্রামের ছেলের ক্যারেক্টার করেছেন, আনন্দ অশ্রুতে যিনি পাগলের ক্যারেক্টারে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, এই ঘর এই সংসারে যিনি মধ্যবিত্ত এক ভাইয়ের ক্যারেক্টারে যেভাবে অভিনয় করেছেন- এরপরেও কি তাকে শুধু রোম্যান্টিক হিরো বলাটা মানায়?

সালমানের স্টাইল আইকন পরিচয়টা তিনি মাত্রাতিরিক্ত টানাহেঁচড়া করতে গিয়ে আমরা তার বাকি অনেক পরিচয়কেই ভুলে গেছি বা আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে।

নিজের কাছের বন্ধুদের কাছে কিন্তু সালমানের পরিচয় ছিল একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। ছায়ানট থেকে ১৯৮৬ সালে তিনি পল্লীগীতিতে উত্তীর্ণ হন। শুধু তাই নয়, নিজের সিনেমা ‘প্রেমযুদ্ধ’তে তিনি নিজের গলায় গানও গেয়েছিলেন। সিক্স প্যাক, এইট প্যাক না থাকলেও সালমানের ওয়েলবিল্ড বডি ছিল, নিয়মিত জিম করতেন।

আমাদের বাংলা সিনেমার অন্যতম প্রধান সমস্যা যেটা- যাত্রার স্টাইলে চিৎকার করে সংলাপ বলা আর অতি অভিনয় করা- সেটা সালমানের মাঝে একেবারেই ছিল না, খুবই ন্যাচারাল অভিনয় করতেন তিনি। এফডিসির সবার সাথে সালমানের ভাল সম্পর্ক ছিল, সবার খোঁজখবর নিতেন তিনি, অনেকের সংসারও চলত সালমানের দেয়া টাকায়। এই পরিচয়গুলো নিয়ে কথা বলবে কে? আমরা কি বলব? বললে কবে বলব?

পর্দার বাইরেও যে তিনি একজন নায়ক ছিলেন, সেটা নিয়ে কেন আমরা আলোচনা করি না? সালমান শাহের ক্রেজ আসলে কোন লেভেলে ছিল এটা বর্তমান প্রজন্ম চাইলেও বুঝতে পারবে না। তাদের দোষ দিয়ে খুব একটা লাভ নেই, সেটা বুঝানোর মতো যেসব সাক্ষাৎকার, ডকুমেন্টরি দরকার ছিল, সেগুলো আমরা বানাইনি বা তৈরি করলেও সংরক্ষণ করিনি।

কিছু উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা করছি সালমানের ক্রেজের। আমি যখন ছোট অনেক, তখন সালমান শাহ মারা যাওয়ার পরে মা খালারা কেঁদেছেন। তাদের মাঝে অনেকেই বলতেন- সালমান নাকি মারা যায়নি, বিদেশে গেছে কোন একটা কাজে, কয়েক বছর পরেই নাকি আবারও ফিরে আসবে। সালমান শাহ'র লাশ যখন দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে তোলা হয়, তখন নাকি সেই লাশ পচেনি- এমনটাই শুনতাম ছোটবেলায়।

সিলেটে তার লাশ নেয়া হলে সর্বস্তরের মানুষের যেই পরিমাণ ঢল নেমেছিল, সেটা নাকি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আর কোথায় পাব এমন ক্রেজ? আমাদের প্রধান অস্ত্র আমাদের আবেগ হলেও আমাদের প্রধান সমস্যাটাও এই আবেগই। আমরা জানি না আমাদের আবেগটা কোথায় দেখাতে হবে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাস আসলেই আমরা সালমান শাহকে কভার ফটো বা প্রোফাইল পিকচারে দিয়ে বা অন্য দেশের নায়কদের সাথে তুলনা দিয়ে “এই দেখ, তোদের চেয়ে আমাদের সালমান কি সেরা ছিল” বলে যেই আবেগটা দেখাই, সেটা কেন অন্য জায়গায় দেখাই না?

একজন মানুষ ১১ তারিখ, ১৭ তারিখ কোথায় শুটিং করবেন, কোথায় ডাবিং করবেন, কার কাছে কত টাকা পাওনা আছেন, সেটা নিজের ডায়েরিতে লিখে কীভাবে ৬ তারিখ আত্মহত্যা করেন, সেটা নিয়ে আমরা কেন প্রশ্ন তুলি না? সালমান যেই ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন, সালমানের রুমে অন্য ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া গিয়েছিল তার মৃত্যুর দিন- সেটা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তোলা হয় না কেন?

মৃত্যুর এত বছর পরেও কেন সালমান শাহ হত্যা মামলার কোনো সুরাহা হয় না, এই প্রশ্ন আমরা কেন একসাথে ফেসবুকে তুলি না? কেন আমরা মানববন্ধন করি না? সালমান শাহের সিনেমাগুলোর ভালো পোস্টার কিংবা তাঁর কোনো সাক্ষাৎকার কেন গুগল বা অন্য কোথাও আমরা পাই না? আমরা এই জেনারেশন যদি তাঁকে এতই পছন্দ করে থাকি, তাহলে সরকারী বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন সালমান শাহর সিনেমা নিয়ে মাসব্যাপী কিংবা সপ্তাহব্যাপী উৎসব করি না! তাঁর অভিনীত সিনেমাগুলোর ইংরেজি টাইটেলসহ ভালো মানের/ব্লুরে প্রিন্ট ইউটিউব বা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না কেন? এই নিয়ে আমরা কথা বলি না কেন?

এই যে আজ পর্যন্ত এফডিসিতে একটি সড়কের নাম সালমান শাহের নামে হয়নি, সেই ব্যাপারে আমাদের আবেগ কী বলে? নাকি তখন আমাদের আবেগ ঘুমন্ত সালমানের মতোই নীরব? আমাদের একজন সালমান ছিল- আমরা কি সারাজীবন সেপ্টেম্বর মাস আসলে এটা নিয়েই তৃপ্ত থাকতে চাই, নাকি আরও কীভাবে সালমান বানানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে চাই? 

অনেক কথা বলে ফেললাম এক দিনে। দিনটা যেনতেন নয়, সালমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৪৯, তবে এই বয়সেও তিনি আলাদা থাকতেন সেই ব্যাপারে সন্দেহ নেই। অনেক কিছুই হয়তো আলাদা হতো, অনেক কিছুই হয়তো হয়তো না। তবে এই ব্যাপারই কোন সন্দেহ নেই, সালমান শাহ একজনই, সালমান শাহ একবারই আসে। তুমি অন্তরে অন্তরে থাকবে, কেয়ামত থেকে কেয়ামত পর্যন্ত...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

আরও পড়ুন- সালমান শাহ: ভালোবাসাময় এক আক্ষেপের নাম!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা