একটি ৩৫ বছরের পুরুষ যদি ২৫ বছরের নারীকে বিয়ে করে, তাতে যেমন সমাজের অন্যদের নাক গলানো উচিৎ নয়, তেমনি একটি ৩৫ বছরের নারীও যদি ২৫ বছরের কোন পুরুষকে বিয়ে করতে চায়, তাতেও আমাদের বাধা দেয়া তো নয়ই, এমনকি টিটকারি-মশকরা করাও গ্রহণযোগ্য নয়।
বিয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয় যে বিষয়টি, তা হলো বয়স। অনেককেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা যায় যে সমবয়সী কাউকে বিয়ে করাটা ঠিক হবে নাকি দুইজনের মধ্যে বয়সের কিছুটা হলেও ব্যবধান রাখা উচিৎ হবে। এক্ষেত্রে ব্যবধান বলতে শুধু আমাদের দেশেই নয়, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও স্বামীর বয়স স্ত্রীর থেকে বেশি হবে এমনটিই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হয়। স্ত্রী যদি কোনভাবে স্বামীর চেয়ে একদিনেরও বড় হয়, প্রতিবেশে সেটি একটি চাঞ্চল্যকর, রসালো আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। এই যেমন বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথাই চিন্তা করে দেখুন। সাবেক বিশ্বসুন্দরী ও বর্তমানে সমানতালে বলিউড-হলিউড দাপিয়ে বেড়ানো প্রিয়াঙ্কা চোপড়া যেই না ঘোষণা দিলেন যে তিনি গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছেন নিজের চেয়ে বছর দশেকের ছোট নিক জোনাসের সাথে, তখন থেকেই ঢি ঢি পড়ে গেল চতুর্দিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মানুষের হাসি-তামাশা ও টিটকারিতে টেকা একপ্রকার দায় হয়ে পড়েছে। আজকের দিনে স্বামীর বয়স যে স্ত্রীর চেয়ে কম হতেই পারে, এই অতি স্বাভাবিক বাস্তবতাটিও তারা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু কী আর করা, এই সব মানুষের রসবোধ যে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা তো আমরা তাদেরকে অস্ট্রিয়া প্রবাসী সিফাতউল্লাহ সেফুদা, ক্রিকেটার নাসির হোসেনের কথিত প্রেমিকা সুবাহ প্রভৃতিকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতি থেকেই আন্দাজ করে নিতে পারি।
তাই সে-সব কথা না হয় বাদই দিলাম। বরং আলাপ করা যাক বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বয়স আসলেই খুব বড় কোন ভূমিকা রাখে কি না সে ব্যাপারে। অনেকেই হয়ত জেনে অবাক হবেন যে, বয়সের বিষয়টি আসলেই বিয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আর যে ক্ষেত্রে সেটি সবচেয়ে বেশি তাৎপর্য বহন করে তা হলো গড় আয়ু নির্ধারণে। প্রথমেই একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, বিয়ে কিন্তু নারী-পুরুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এ কথা বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত যে যেইসব নারী-পুরুষ বিয়ে না করে আজীবন সিঙ্গেল কাটিয়ে দেয়, তাদের চেয়ে বিবাহিত নারী-পুরুষের জীবন বেশ খানিকটা দীর্ঘ হয়ে থাকে। মূলত একাকীত্বই অবিবাহিত নারী-পুরুষকে দ্রুত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। তবে এবার আসা যাক বয়সের বিষয়টিতে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল বলছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি বেশ বড় একটা বয়সের ব্যবধান থাকে, তবে তা তাদের গড় আয়ুর ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। একটি নারী যদি তার চেয়ে বয়সে ছোট কোন পুরুষকে বিয়ে করে এবং তাদের মধ্যকার বয়সের ব্যবধান অন্তত সাত বছর হয়ে থাকে, তবে ওই নারীর মৃত্যুহার শতকরা ২০ ভাগ বেড়ে যায়।
তবে শুধুমাত্র এই একটি তথ্য থেকেই যেন কেউ সিদ্ধান্তে পৌঁছে না যান যে তবে নারীদের উচিৎ বয়সে বড় পুরুষকেই বিয়ে করা। কারণ সেখানেও বিপদ আছে। স্বামীর বয়স যদি স্ত্রীর চেয়ে অন্তত পাঁচ বছর বেশি হয়, তাহলেও স্ত্রীর আয়ু উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। প্রায় বিশ লক্ষ ড্যানিশ দম্পতির উপর পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালিয়ে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একজন নারীর পক্ষে সবচেয়ে ভালো হয় যদি তিনি তার সমবয়সী কোন পুরুষকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রায় একই। কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর চেয়ে সাত থেকে নয় বছরের বড় হয়ে থাকে, তবে তার মৃত্যুর হার, যে স্বামীর বয়স তার স্ত্রীর সমান, তার থেকে অন্তত ১১ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে।
এখানে আরেকটি বিশেষ ব্যাপারে নজর এড়িয়ে গেলে চলবে না যে, কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর চেয়ে বয়সে বড় হয়, তাহলে সে স্বামীর চেয়ে বয়সে ছোট নারীদের থেকে কম দিন বাঁচে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষকরা বলেছেন, কম বয়সী স্ত্রীদের জীবনে তার স্বামী ছাড়াও বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকে, যাদের সাথে তারা ভালো সময় কাটাতে পারে এবং নিজেদের মনের কথা শেয়ার করতে পারে। যেমন আমাদের দেশে কোন নারী যদি যৌথ পরিবারে বিয়ে করে, তবে বিয়ের পর সে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ননদ বা সমবয়সী জা-দের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে পারে। এছাড়া তার বিবাহ-পূর্ব জীবনেরও অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকে যাদের কাছে সে তার সব সুখ-দুঃখের কথা নির্দ্বিধায় খুলে বলতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর বয়স যদি স্বামীর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সাধারণ শ্বশুরবাড়িতে সমবয়সী বন্ধু কাউকে পাওয়ার সুযোগ সে হারায়। বিবাহ-পূর্ব তেমন কোন বন্ধুও তার জীবনে থাকে না।
তাই স্বামীর চেয়ে বয়সে বড় স্ত্রীরা প্রবল একাকীত্ব ও মানসিক চাপের কারণে দ্রুত মারা যেতে পারে। এতক্ষণ তো কেবল আয়ুষ্কাল নিয়ে কথা বললাম। এবার দাম্পত্যজীবনের সুখ নিয়েও কথা বলা জরুরি, যার অভাবে সম্পর্কে বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রেও সমবয়সী স্বামী-স্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে থাকে। গবেষণার ফলাফল জানাচ্ছে, সমবয়সী স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে ডিভোর্সের প্রবণতা সবচেয়ে কম দেখা যায়। স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য যদি এক বছর হয়, তাহলে তাদের মধ্যে ডিভোর্সের হার ১ শতাংশ বেড়ে যায় (সমবয়সী স্বামী-স্ত্রীদের তুলনায়)। যদি তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য পাঁচ বছর হয়, তাহলে ডিভোর্সের হার বেড়ে যায় ১৮ শতাংশ। আর তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য যদি ১০ বছরের হয়, তাহলে ডিভোর্সের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশ। এছাড়াও বয়সের ব্যবধান ২০ বছর হলে ডিভোর্সের হার হয় ৯৫ শতাংশ, আর বয়সের ব্যবধান ৩০ বছর হলে তো ডিভোর্সের হার ১০০ শতাংশই ছাড়িয়ে যায়। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা প্রফেসর টেরা ম্যাককিনিশ বলেন, “যেসব পুরুষ তাদের চেয়ে বয়সে ছোট নারীকে বিয়ে করে তারা সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট থাকে, আর যেসব পুরুষ তাদের চেয়ে বয়সে বড় নারীকে বিয়ে করে তারা সবচেয়ে কম সন্তুষ্ট থাকে। এদিকে যেসব নারী তাদের চেয়ে বয়সে বড় পুরুষকে বিয়ে করে তারা কিছুটা কম অসন্তুষ্ট থাকে, আর যেসব নারী তাদের চেয়ে বয়সে ছোট পুরুষকে বিয়ে করে তারা বেশি অসন্তুষ্ট থাকে।”
তাহলে এমন কী উপায় রয়েছে যাতে করে স্বামী-স্ত্রী দুজনের পক্ষেই সমান সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ওয়াং শেং লি। তিনি বলেন, “সমবয়সী দম্পতিরাই পারে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হতে। যেহেতু তারা উভয়েই নিজেদের ক্যারিয়ার ও সামগ্রিক জীবনের একই পর্যায়ে অবস্থান করে, তাই তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোও একই রকম হয়ে থাকে।” সুতরাং একটি বিষয় এখানে দিনের আলোর মত পরিষ্কার, স্বামী বয়সে বড় হোক কিংবা স্ত্রী, দুইটির কোনটিতেই দাম্পত্যজীবন পুরোপুরি সুখী হতে পারে না, যেটি কেবল সমবয়সী স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবনেই দেখা যায়। তাই এতদিন ধরে যারা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ছিলেন যে সমবয়সী বিয়ে কখনও সুখের হয় না, এবার নিশ্চয়ই তাদের ভুল ধারণা ভাঙবে।
তবে দিনশেষে সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিয়ে এমন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেখানে অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষের সিদ্ধান্তই মুখ্য ও চূড়ান্ত হওয়া উচিৎ। একটি ৩৫ বছরের পুরুষ যদি ২৫ বছরের নারীকে বিয়ে করে, তাতে যেমন সমাজের অন্যদের নাক গলানো উচিৎ নয়, তেমনি একটি ৩৫ বছরের নারীও যদি ২৫ বছরের কোন পুরুষকে বিয়ে করতে চায়, তাতেও আমাদের বাধা দেয়া তো নয়ই, এমনকি টিটকারি-মশকরা করাও গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যের সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখাতে শিখুন। সব বিষয় নিয়ে মজা করতে গিয়ে নিজেদেরকেই ছোট করবেন না। তথ্যসূত্র- গার্ডিয়ান, হাফিংটন পোস্ট, দ্য আটলান্টিক