ছোটবেলায় বোনকে হারিয়েই করলেন প্রতিজ্ঞা- হতে হবে ডাক্তার। সেই মানুষটা আজ গোটা পৃথিবীর ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের চোখে আলো এনেছেন বিনামূল্যে!

আস্তে আস্তে বয়স যখন বাড়ে, শরীরের কলকব্জা হতে থাকে দূর্বল। কিছু কলকব্জা তো নিয়ে নেয় চিরকালীন অবসরই। কলকব্জা দুর্বল হলে বিপর্যস্ত তো লাগেই, সবচেয়ে দিশেহারাবোধ হয় তখনই, যখন চোখও নিতে চায় অবসর! বয়স ক্রমশ ষাট ছুঁইছুঁই। চোখে আস্তানা গাড়ছে ছানি। দৃষ্টি হচ্ছে ক্ষীণ। চিকিৎসা করাবেন? ট্যাঁকের জোড় আছে তো? কারণ ছানি কাটতে লাগবে যে ২০০ ডলার! গরীব মানুষেরা এই টাকার অঙ্কে যখন পিছপা হচ্ছেন ধীরে ধীরে, তখনই ত্রাতা হয়ে এলেন একজন। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে চোখের ছানি অপারেশন করাতে লাগলেন। বলতে গেলে একদম বিনা পয়সাতেই।

লোকজনের দৃষ্টি যখন ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, তিনি ত্রানকর্তা হিসেবে হাজির হওয়া শুরু করলেন। চোখের ছানি কাটার পরে যখন তিনি চোখের ব্যান্ডেজ খুলতেন, তখন সবাই প্রথম তার মুখটাই দেখতেন। তখন থেকেই তাঁর নাম- দ্য গড অব সাইট। আজকের গল্প এই মানুষটিকে নিয়েই, যিনি এখন পর্যন্ত সার্জারি করেছেন প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের! মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে যিনি ঘুরেছেন পৃথিবীর ত্রিশটিরও বেশি দেশে!

নেপালের পাহাড়েঘেরা খুব প্রত্যন্ত এক গ্রাম অলানচুঙ্গোলা। সেই গ্রামে জন্ম সান্ডুক রুইতের, যাকে আমরা 'দ্য গড অব সাইট' হিসেবে চিনি। নেপালের এই গ্রামটা এতই প্রত্যন্ত যে এখানে মাত্র ২০০ মানুষ বাস করে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১০০০ ফুট উঁচুতে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোল ঘেঁষে থাকা এই গ্রামটিতে নেই ইলেকট্রিসিটি, নেই স্কুল, নেই হাসপাতাল, নেই বসবাসের ন্যূনতম সরঞ্জামও! বছরের ৬-৯ মাসই গ্রামটি থাকে তুষারের নীচে। এরকম একটি গ্রামেই জন্ম সান্ডুক রুইতের।

গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের স্কুলটাও ছিলো এগারো দিনের হাঁটাপথ দূরত্বে, দার্জিলিং এ! পরিবার ছিলো দরিদ্র। কৃষিকাজ পেশা। রুইতেরা চার ভাই-বোন। অদ্ভুত এবং দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো- বাঁচেনি রুইতের কোনো ভাই-বোনই। অকালেই মারা গিয়েছে তারা। তবে রুইতকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা গিয়েছে ছোট বোনের মৃত্যু। পনেরো বছরের বোনটি টিউবারকিউলোসিস এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান৷ একরকম চিকিৎসার অভাবেই মারা যায় বোনটি। এই ঘটনাটি ধাক্কা দেয় রুইতকে। সে শুরু করে ডাক্তার হওয়ার জন্যে পড়াশোনা।

কিন্তু ঐ যে বললাম, রূপোর চামচ তো দূরের কথা পেতলের চামচও তো পাননি জন্মের সময়ে। লড়াইটা তাই স্রোতের বিপরীতেই ছিলো। তবে তিনিও হাল ছাড়লেন না। স্রোতের বিপরীতে গিয়েই এগোতে লাগলেন। পড়াশোনা করেন নেপালের কাঠমান্ডু, ভারতের লখনৌ ও দিল্লিতে। এরপর পড়াশোনা করতে যান নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাতেও। পরিণত হন তুখোড় এক আই সার্জনে।

অস্ট্রেলিয়াতে থাকাকালীন তার এক সহকর্মীর সাথে তিনি গবেষণা করে বের করেন চোখের ছানি অপারেশনের স্বল্প খরচের টেকনিক। পাঁচ মিনিটে চোখের ছানি অপসারণ করার এ পদ্ধতি এক যুগান্তকারী উদ্ভাবনই বলা চলে। তবে এই উদ্ভাবন করেই তিনি থেমে থাকেন না। ছড়িয়ে পড়েন নেপালের বিভিন্ন স্থানে। এরপর দেশ ছেড়ে এগোন ভারত, উত্তর কোরিয়া, চায়না সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। শুধু এ কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননা তিনি। 'তিলঙ্গা ইন্সটিটিউট অব অপথ্যালমোলোজি' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রাখেন অপরিসীম অবদান।  যারা দরিদ্র, তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক অগ্রণী অবদানই রাখছে এই ইন্সটিটিউট। এবং প্রথম থেকেই এখানে যুক্ত আছেন ড. সান্ডুক রুইত।

তিনি পুরস্কারও পেয়েছেন অজস্র। যদিও তিনি পুরস্কারের আশা ভেবে কাজ করেননি কোনোদিনই। তবুও এশিয়ার নোবেলখ্যাত 'রামোন ম্যাগসেসে' পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত থেকে 'পদ্মশ্রী' খেতাবেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, নেপাল থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন। লিখেছেন আত্মজীবনীও। 'দ্য বেয়ারফুট সার্জন' নামের বইটা হয়েছে বেশ জনপ্রিয়। ছড়াচ্ছে অনুপ্রেরণার বার্তাও।

তাঁর বয়স এখন ছেষট্টি। তাও তিনি থেমে নেই মোটেও। দৌড়াচ্ছেন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে। হিমালয়ের কোলেই বড় হয়েছেন বলেই কী না পাহাড়সম এক হৃদয় নিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন মানুষকে সেবা। বোনের মৃত্যুর ধাক্কা যাকে পরিণত করেছে আপাদমস্তক খাঁটি মানুষে। যিনি হাসতে হাসতে বলেন-

'চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়া মানে, জীবনটাকেই ফিরিয়ে দেয়া। এ কাজে ক্লান্তি আসেনা কখনো। এ কাজেই আনন্দ।'

'অন্ধজনে দেহ আলো' প্রবাদবাক্যকে সত্য করার প্রয়াসে এই মানুষটি আলোকবর্তিকা হয়ে ক্লান্তি ও বার্ধক্যকে বুড়ো-আঙ্গুল দেখিয়ে  দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চ্যাপ্টা কমলালেবুর এই গ্রহে। আমাদের গর্ব তো একটু হচ্ছেই। আপনারও হচ্ছে তো? 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা