কিছু বিষাদগ্রস্ত দিন, ছিল প্রেমিকার চোখে জমা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নামের পাশে ডাক্তার পদবী যোগ হয়েছিল দুজনের, ৩৩তম বিসিএসে দুজনেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নিয়োগ পেয়েছিলেন সরকারী চিকিৎসক হিসেবে। কিন্ত আচমকাই সেই সংসারে হানা দিলো কালবৈশাখী ঝড়, যে ঝড়ে টালমাটাল হয়ে গেছে এই মানুষগুলোর জীবন।
দশ বছর বয়সে মা মারা গিয়েছিল মেয়েটার। ঘরে নতুন মহিলা এলে মেয়ের অযত্ন হবে ভেবে বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজী হননি, একাই বড় করেছেন মেয়েকে। বাবা-মা দুজনের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন একাই। স্বপ্ন ছিল, মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। জেরিন নামের সেই মেয়েটা মেধাবী ছিল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিল হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে পেছনে ফেলে।
মেডিকেলে পড়ার সময়েই একই ব্যাচের একটা ছেলেকে ভালোবেসেছিল জেরিন, ছেলেটার নাম মুনতাহিদ। দুজনে কত স্বপ্ন দেখেছিল, ছোট্ট একটা ঘরের স্বপ্ন, সুখী একটা পরিবারের স্বপ্ন। নামের পাশে ডাক্তার পদবী যোগ হয়েছিল দুজনের, ৩৩তম বিসিএসে দুজনেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নিয়োগ পেয়েছিলেন সরকারী চিকিৎসক হিসেবে। সংগ্রাম আর কষ্টের প্রহরগুলো শেষ হতে চলেছে বুঝি, এমনটাই ভেবেছিলেন তারা, মালাবদল করে দুজনে পেতেছিলেন সুখের সংসার। কিন্ত আচমকাই সেই সংসারে হানা দিলো কালবৈশাখী ঝড়, যে ঝড়ে টালমাটাল হয়ে গেছে এই মানুষগুলোর জীবন।
২০১৪ সালের ২৪শে আগস্ট ছিল সানজানা জেরিনের কর্মস্থলে যোগদানের দিন। ফেনী জেলার পরশুরামে পোস্টিং হয়েছিল তার। মুনতাহিদের পোস্টিং ছিল কুমিল্লার মেঘনায়। সেদিন ভোর ছ’টার দিকে জেরিনকে পৌঁছে দিতে বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছিলেন দুজনে, রিক্সায় চড়ে। কমলাপুর স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তাটা ছিল বেশ নিরিবিলি। আচমকাই পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে যাওয়া একটা গাড়ি থেকে এক ছিনতাইকারী জেরিনের হাতে থাকা হ্যান্ডব্যাগটা ধরে প্রচণ্ড জোরে টান দেন। ব্যাগের বেল্ট ছিল জেরিনের হাতের সাথে শক্ত করে পেঁচানো, টাল সামলাতে না পেরে রিক্সা থেকে পড়ে যান জেরিন। গাড়িটার গতিবেগ বেশী থাকায় প্রায় ১০-১৫ ফুট দূরে গিয়ে পড়েন, মাথাটা গিয়ে জোরে ধাক্কা খায় পিচঢালা রাস্তায়।
গাড়িটা ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে, জেরিনের হাতের সাথে লেগে আছে ব্যাগের ছেড়া অংশ, ব্যাগটা চলে গেছে গাড়ির সাথে। ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারিয়েছিলেন জেরিন, অজ্ঞান হওয়ার আগে স্বামীকে শুধু এটাই বলতে পেরেছিলেন- “আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা, সিটিস্ক্যান করাও!” সেটাই এখনও পর্যন্ত জেরিনের শেষ কথা হয়ে আছে। না, জেরিন মারা যাননি। বেঁচে আছেন তিনি, কিন্ত সেটাকে বেঁচে থাকা বলা চলে কিনা আমার জানা নেই।
গুরুতর আহত জেরিনকে সঙ্গে সঙ্গে মুনতাহিদ নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যমে মানুষে টানাটানি হয়েছে সেখানে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের আইসিইইউতে জেরিন ভর্তি ছিলেন প্রায় দুই মাস। তারপর মুনতাহিদ জেরিনকে নিয়ে ছুটেছেন ভারতে। কলকাতা আর চেন্নাইতে চিকিৎসা করানো হয়েছে, কিন্ত ফল মেলেনি। যেখানেই আশার সামান্য আলো দেখতে পেয়েছেন মুনতাহিদ, সেদিকেই হাত বাড়িয়েছেন। কিন্ত ভাগ্য সহায় হয়নি তার। মস্তিস্কে গুরুতর আঘাত পাওয়ায় স্মৃতি হারিয়েছেন তিনি, হারিয়েছেন চলাফেরা বা কথা বলার ক্ষমতাও।
জেরিন এখনও কথা বলতে পারেন না। কারো কথা বোঝেন না, কাউকে চেনেনও না। নির্জীব একটা অবস্থা এই উচ্ছ্বল তরুণীর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার দিন কাটে, হাঁটাচলা করার সামর্থ্য তো নেই। বাচ্চাদের মতো ডায়পার পরিয়ে রাখতে হয় তাকে, চোখেমুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শুধু। স্বামী মুনতাহিদের কর্মস্থল এখনও কুমিল্লায়, ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা করেই অফিস করেন তিনি। যাত্রাবাড়ীতে ভাড়া বাসায় একটা রুমকে নার্সিংহোমের মতো বানিয়ে সেখানে রাখা হয়েছে জেরিনকে, চারপাশে চিকিৎসার যন্ত্রপাতিতে ভরা রুমটা। রাতে জেরিনের রুমেই মেঝেতে ঘুমান মুনতাহিদ, কিছুক্ষণ পরপর জেরিনের বুকে কফ জমে, তখন সেটা বের করে দিতে হয়। মুনতাহিদের বাবা-মা’ও পুত্রবধুর যথেষ্ট সেবা করেন, সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্যে রাখা হয়েছে একজন সাহায্যকারীও।
কিছুক্ষণ পরপরই শিশুদের মতো কান্নাকাটি করেন জেরিন, সেই কান্নার কোনো ভাষা নেই, বোবাকান্নার মতো। কখনও গোঙানী শোনা যায়, কখনও শুধু চোখের কোনে জল জমে থাকে। পরিবারের সদস্যেরা তখন গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন, মেয়েটা কিছুক্ষণ শান্ত থাকেন সেই আদরের ছোঁয়া পেয়ে। জেরিনের বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে, সেটা তিনি বুঝতেই পারেননি। ঘরের দেয়ালে দুজনের বিয়ের ছবি টানানো, সেগুলো এখন শুধু স্মৃতি হয়েই আছে। ছবির রূপসী মেয়েটা এভাবে বিছানায় পড়ে আছে নির্জীব হয়ে, নিজের চোখে না দেখলে সেটা কারো বিশ্বাস হবে না।
মুনতাহিদ বা তার পরিবারের সদস্যেরা কেউই জানেন না, জেরিন কখনও ভালো হয়ে উঠবেন কিনা, বিছানা ছেড়ে উঠে হাঁটতে পারবেন কিনা, সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা। তারা শুধু আশায় থাকেন। মানুষজনের সাহায্যে চলেছে চিকিৎসা, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দেয়া হয়েছিল দশ লক্ষ টাকা। সারাদেশের মানুষ টেলিভিশন বা পত্রপত্রিকার কল্যাণে জেরিনের কথা জেনেছে, মুনতাহিদের চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধটার কথা শুনেছে, সীমিত সামর্থ্য নিয়ে অনেকেই এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। ওদের দেয়া অর্থসাহায্যেই জেরিনের চিকিৎসা চলেছে। হানিমুনে যাওয়ার জন্যে যে টাকা জমিয়েছিলেন এই দম্পতি, সেই সঞ্চয়টা ভেঙে জেরিনকে নিয়ে ভারতে উড়ে গেছেন মুনতাহিদ, উন্নত চিকিৎসার আশায়। জেরিন এখনও জানতে পারেননি, নাম না জানা কত মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছে। যে মানুষটাকে ভালোবেসে তিনি ঘর বেঁধেছিলেন, সেই মানুষটা কত শক্ত করে তার হাতটা ধরে আছে, সেটা হয়তো জেরিন বুঝতেও পারেন না।
মুনতাহিদ চাইলে জেরিনকে নিজের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারতেন, আবার বিয়ে করে নিজের জীবনটা অন্যরকমভাবেই উপভোগ করতে পারতেন। স্বার্থপর হতে পারতেন, নিজের ভালোটাই বুঝতে পারতেন শুধু। সেসব তিনি করেননি। তিনি শক্ত করে ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরেছেন, তাকে ছেড়ে যাননি, প্রিয় মানুষটার অসহায়ত্বের সময়টায় তাকে ত্যাগ করেননি।
কেউ জানে না জেরিন কখনও সুস্থ হবে কিনা, ডাক্তারেরাও কোন আশা দিতে পারেননি। জেরিন কতদিন বাঁচবেন, সেটাও বলতে পারেননি তারা। মুনতাহিদ নিজেও তো ডাক্তার, তিনি শুধু ভাগ্যের দিকে আশাভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। অপেক্ষা করেন, কোনো একদিন জেরিন নিজেই বিছানা থেকে উঠে আসবে, সুস্থ স্বাভাবিকভাবে হাঁটবে, কথা বলবে, সেই কথায় মিশে থাকবে উচ্ছ্বলতা। গোছানো স্বভাবের মেয়েটা তার অগোছালো জীবনটা আবার গুছিয়ে দেবে, এই প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকেন তিনি।
দুজনের বিবাহবার্ষিকী আসে, যায়। ঈদ আসে, পহেলা বৈশাখ আসে, পেরিয়ে যায় ভালোবাসা দিবস। মুনতাহিদের অপেক্ষার শেষ হয় না। বিশেষ দিনগুলোতে তিনি নিজের হাতে সাজান স্ত্রীকে। দেয়ালে ছবি হয়ে জেগে থাকে তাদের পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো, তাদের প্রেম-বিয়ে, সংসার জীবনের অল্প-কটা দিন। সেগুলোর মধ্যেই জেগে থাকে ভালোবাসা। জেরিন মেয়েটা একদিক থেকে খুব ভাগ্যবতী। নিয়তি তার সুন্দর সাজানো জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে, কিন্ত সত্যিকারের ভালোবাসার স্পর্শও সে পেয়ে গেছে। তার ভালোবাসার মানুষটা সমগ্র পৃথিবীর সাথে লড়াই করে তার হাত ধরে আছে শক্ত করে, তাকে আগলে রাখছে। এমনটা খুব বেশী মানুষ পায় না। সবার কপালে এমন ভালোবাসা জোটেনা।
ভালোবাসা এখন কর্পোরেট হয়ে গেছে, বাজারে চাল-ডাল-তেল-নুনের মতোই ভালোবাসা বিকোয় আজকাল। এরমধ্যেও জেরিন-মুনতাহিদেরা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যান, সত্যিকারের ভালোবাসা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এখনও। আমি জানি, মুনতাহিদ যে যুদ্ধটা করছেন, তাতে তিনি বিজয়ী হবেনই। ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি দুনিয়াতে আর কিছু নেই। আর মুনতাহিদের অস্ত্র তো সেই ভালোবাসাই!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটা তিন নবছর আগের। ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে আবারও প্রকাশিত হলো। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ভালোবাসা কখনও পুরনো হয় না...
তথ্যসূত্র- প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, এটিএন নিউজ।