আমরা ফেসবুকে আন্দোলন করি সরকারী চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্যে, আর সেই বয়সে ম্যারিন একটা সভ্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসে আছেন!

রাজনৈতিক সচেতনতা তার সঙ্গী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই, বিতর্কে দারুণ মনযোগী ছিলেন, সেটাই হয়তো সমাজ আর রাজনীতি সম্পর্কে তাকে সচেতন করে তুলেছিল। নিজের পরিবারের প্রথম গ্র‍্যাজুয়েট ছিলেন তিনি, ত্রিশ বছর বয়সে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাওয়ার দিনও হয়তো ভাবতে পারেননি যে, চার বছরের মাথায় তিনি দেশটার প্রধানমন্ত্রীই হয়ে যাবেন! ৩৪ বছর বয়সে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়ে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে তো দিয়েছেনই, সেইসঙ্গে কণিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হবার রেকর্ডটাও গড়েছেন সানা ম্যারিন! 

ফিনল্যান্ডের সরকার গঠিত হয়েছিল দুটো দলের কোয়ালিশনে। কিন্ত সম্প্রতি ডাকবিভাগের কর্মীদের ধর্মঘটের জের ধরে সেন্টার পার্টি সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন তুলে নেয়ায় পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টি রিনে। সেই শূন্য আসনেই ম্যারিনকে নির্বাচিত করেছেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা। দুইশো জন সাংসদের মধ্যে ১১৭ জন আস্থা রেখেছেন তার ওপর, অল্প ব্যবধানেই ভোটে জিতে ম্যারিন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন। 

শ্রমিক পরিবারে জন্ম, অর্থকষ্টের সঙ্গে পরিচয় একদম ছোটবেলা থেকেই। মা ছিলেন সমকামী, ফিনল্যান্ডে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। বাবার অভাবটা বুঝতে দেননি মা আর তার সঙ্গী। পড়ালেখায় ভালো ছিলেন, আর তাই আর্থিক অনটন স্বত্বেও তাকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়েছেন মা। ১৯৮৫ সালে জন্ম নেয়া সানা ম্যারিন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সায়েন্সের ওপর গ্র‍্যাজুয়েশন করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ট্যাম্প্রে থেকে। 

সানা ম্যারিন

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই রাজনীতির হাতেখড়ি, বা রাজনীতি নিয়ে ভাবনার শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার তিন বছর বাদে চাকুরি ছেড়ে নাম লেখালেন ফুলটাইম পলিটিক্সে। ট্যাপ্রে সিটি কাউন্সিলের মেম্বার হলেন, তারপর পেলেন চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, যে রাজনৈতিক দলের হয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে, সেই দলের সেকেন্ড ডেপুটি চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হলেন ২০১৪ সালে। 

পরের বছর ফিনল্যান্ডের সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীতা করলেন ম্যারিন, টেলিভিশন বিতর্কে সাড়া জাগালেন। বিপক্ষ দলগুলোকে আক্রমণ করলেন বেকারত্ব আর জীবনমানের উন্নয়নের প্রশ্নে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিতর্কের সহজাত প্রতিভাটা তাকে ভীষণ সাহায্য করেছিল তখন। নির্বাচনে নিজের আসন থেকে বেশ বড় ভোটের ব্যবধানে জিতে গেলেন ম্যারিন, শপথ নিলেন সাংসদ হিসেবে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গড়া হলো না সোশালিস্ট পার্টির, বিরোধী দল হিসেবে সংসদে রইলো তারা।

এবছরের জুন মাসে ম্যারিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যোগাযোগ ও পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। এর মাস পাঁচেক পর তো ধর্মঘটের জেরে ফিনল্যান্ডজুড়েই অচলাবস্থার শুরু হলো। তার জেরে পদত্যাগ করতে হলো সরকারপ্রধানকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দল হিসেবে সোশালিস্ট পার্টি প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিলো ৩৪ বছরের সানা ম্যারিনকে। কারণ ফিনল্যান্ডের রাজনীতিতে বংশীয় অনুক্রম অনুসরণের কোন ব্যবস্থা নেই, আর তাতেই ৩৪ বছরের ম্যারিনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে নিজের দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছে যাওয়া। ভোটাভুটিতে ১১৭ জন সাংসদ আস্থা রাখলেন তার ওপর, আর তার ফলেই বিশ্বের সর্বকণিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন ম্যারিন।

ম্যারিনের সামনে এখন বিশাল চ্যালেঞ্জ, উদযাপনের ফুরসৎ নেই একদমই। ডাকবিভাগের ৭০০ কর্মীর বেতন ছাঁটাই নিয়ে এখনও অচলাবস্থা রয়েছে ফিনল্যান্ডের একাংশে। যে আন্দোলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, সেটা তো ছোটখাটো কোন ইস্যু নয়! এখন রিনের উত্তরসূরি হিসেবে যাবতীয় পরিস্থিতি সামলাতে হবে কনিষ্ঠতম এই প্রধানমন্ত্রীকে। ম্যারিন অবশ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। স্পষ্ট করে বলেছেন, 'বয়স বা লিঙ্গ নিয়ে আমি কোনও দিন ভাবিনি। কেন আমি রাজনীতিতে এসেছি, সেটাই ভাবি। ভাবি, কেন দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে। যথাযথ ভাবে নিজের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব, এইটুকু নিশ্চিত করতে পারি।'

বিশ্বটা এখন তরুণ নেতৃত্বের দিকে ঝুঁকছে ক্রমশ, কানাডার জাস্টিন ট্রুডো, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রোরা যে মিছিলটা শুরু করেছিলেন, সেই মিছিলে যোগ দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের জেসিন্দা আরদার্ন, ইউক্রেনের অ্যালেক্সি হোঞ্চারক- দুজনের বয়সই চল্লিশের নীচে। আর সেই তালিকায় সবশেষ সংযোজন সানা ম্যারিনের নামটা। বাংলাদেশে তরুণরা ফেসবুকে আন্দোলন করে চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্যে, আর সেই বয়সে ম্যারিন একটা সভ্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসে আছেন- কী বিশাল পার্থক্য বাংলাদেশ আর ফিনল্যান্ডের মধ্যে, তাই না? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা