সারাহ গিলবার্ট: মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া অদম্য এক সুপারওম্যান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সারাহ গিলবার্ট লড়েছিলেন ইবোলা-সার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে, ভ্যাক্সিন আবিস্কার করে ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়। করোনার এই ক্রান্তিকালেও লড়াইটা অব্যাহত রেখেছেন সারাহ। বিশ্বমোড়লরা যখন এই যুদ্ধে হেরে বসে আছে আগেভাগে, ধর্মের ধ্বজাধারী মোল্লা-ঠাকুর-বিশপরা অসহায়, তখন আশার আলো দেখাচ্ছেন এই বিজ্ঞানীই...
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের ক্যাটেরিং গার্লজ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল সদ্য কৈশোরে পা দেয়া মেয়েটা। বন্ধুবান্ধব ছিল না কেউই, নিজের মতো চুপচাপ থাকতো। কারো সঙ্গে মিশতে পারত না আগ বাড়িয়ে। টিফিন পিরিয়ডে তাকে খুঁজে পাওয়া যেতো স্কুলের লাইব্রেরীতে, উঁচু ক্লাসের বিজ্ঞানের বই নিয়ে বসে আছে সে। ভালো ছাত্রী ছিল মেয়েটা, শিক্ষকেরাও জানতেন সেটা। কিন্ত ও লেভেলের পরীক্ষায় যখন ছয়টা সাবজেক্টে এ-গ্রেড পেয়ে গেল সে, তখন চোখ কপালে উঠলো সবার! কী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে সারাহ গিলবার্ট নামের মেয়েটা!
সত্তর দশকের যে কিশোরীর গল্প শোনাচ্ছিলাম, তিনি এখন পরিপূর্ণ নারী, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনোলোজির প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন ভদ্রমহিলা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিস্কৃত যে করোনার ভ্যাক্সিনটিকে মানবদেহে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিরাপদ বলে রায় দেয়া হয়েছে, সেটির আবিস্কারক দলের নেতা ছিলেন আমাদের এই সারাহ গিলবার্ট। করোনার থাবায় বিপর্যস্ত মানবজাতিকে রক্ষার সংকল্প নিয়ে যিনি গত কয়েকটা মাস ধরে অবিরাম কাজ করে চলেছেন, পরিবার-সংসার ভুলে পড়ে আছেন গবেষণাগারে- যাকে ঘিরে আশায় বুক বাঁধছেন সবাই, যে মানুষটার দিকে ভরসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিশ্বের রথী-মহারথী দেশ আর রাষ্ট্রপ্রধানেরা- তিনিই প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট।
বিশ্বজুড়ে যতগুলো ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণা চলছে, তার মধ্যে সারাহ গিলবার্ট এবং অক্সফোর্ড টিমের এই ভ্যাক্সিনটা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের যে দলটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সারাহ গিলবার্ট। দুই ধাপে বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন বয়স ও শারীরিক সামর্থ্যের প্রায় দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে এই টিকা।এর মধ্যে সারাহ গিলবার্টের তিন মেয়েও আছে! ট্রায়ালের পর সারাহ দাবী করেছিলেন, তারা মোটামুটি ৮০% নিশ্চিত যে, তাদের আবিস্কৃত এই প্রতিষেধক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে।
সারাহ'র দাবী এখনও পর্যন্ত সত্যি বলেই প্রমাণীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে জানাচ্ছে, মানবদেহে পরীক্ষার ৫৬ দিন পর্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবডি উৎপাদন ও টি-সেল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর এই ফল আরও বেশি হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। তবে এখনই তা পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেবে কিনা তা বলার সময় হয়নি। কারণ বড় ধরনের পরীক্ষা চলমান রয়েছে। যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে ভ্যাকসিনটির ১০ কোটি পিস অর্ডার দিয়ে রেখেছে, বাজারজাত করা শুরু হলে এই ভ্যাক্সিন যুক্তরাজ্যই সবার আগে পাবে।
মহামারীর বিরুদ্ধে সারাহ গিলবার্টের কৃতিত্ব কিন্ত এবারই প্রথম নয়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে আফ্রিকা কাঁপিয়েছিলো মার্স এবং ইবোলা নামের দুটি ভাইরাস। পশ্চিম আফ্রিকায় প্রাদুর্ভাব হওয়া এই দুই মহামারিতে প্রায় সাড়ে তেরো হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। সংখ্যাটা লক্ষাধিক হতে পারতো, টানা কয়েক বছর ধরে বিশাল এলাকাজুড়ে চলতে পারতো এর তাণ্ডব, ছড়িয়ে পড়তে পারতো এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকায়। সেটা সম্ভব হয়নি সারাহ গিলবার্টের কারণে। দুইবারই এই ভাইরাসগুলোকে রুখতে দিশা দেখিয়েছিলেন মহীয়সী এই নারী বিজ্ঞানী, সেগুলোর প্রতিষেধক আবিস্কার হয়েছিল তার হাতে।
আরও একবার মানবসভ্যতা যখন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, করোনার প্রকোপে অর্থনীতির এভারেস্ট ধ্বসে পড়েছে, লাশের স্তুপ জমেছে সর্বত্র, ইউরোপ থেকে আমেরিকা- প্রতিটা জায়গা পরিণত হয়েছে শ্মশানে, তখন আরও একবার অন্ধকারের বুক চিরে আলো হাতে সম্মুখ সমরে এসে দাঁড়িয়েছেন সারাহ গিলবার্ট। নিজের দলবল নিয়ে ঢুকেছেন ল্যাবরেটরিতে, দিনরাত এক করে চালিয়েছেন গবেষণা। মাসের পর মাস খেটেছেন, পরীক্ষা চালিয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর টিকা প্রয়োগ করে তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণার একটা পর্যায়ে সারাহ এবং তার দল বুঝতে পেরেছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসকে দমন করতে পারবে শিম্পাঞ্জির শরীরে সর্দি-কাশির ফলে জন্ম নেয়া অ্যান্টিবডি। সেভাবেই শিম্পাঞ্জির সাধারণ সর্দির ভাইরাসের দুর্বল সংস্করণ, যেটার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাডেনোভাইরাস- সেটা ব্যবহার করে ‘চ্যাডক্স-১’ নামের এই ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেছেন সারাহ গিলবার্ট এন্ড টিম।
এর আগে করোনার যেসব ভ্যাক্সিন আবিস্কৃত হয়েছে, সেগুলো বানাতে অনেক লম্বা সময় লেগেছিল। প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেই প্রচুর সময় নষ্ট করেছে সেগুলো, ফলাফলও আশাব্যাঞ্জক ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, এবারের আবিস্কারের পেছনে সারাহ গিলবার্টের নামটা আছে, যিনি এর আগে মার্স ও ইবোলাকে পরাস্ত করেছেন। তাই আশায় বুক বেঁধেছিল সবাই, সারাহ তাদের হতাশ করেননি।
আর অল্প কিছুদিন, তারপরেই আরও কয়েক ধাপে পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর ভ্যাক্সিন বাজারে আসবে, করোনাভাইরাস হার মেনে যাবে মানুষের অদম্য পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তার কাছে, সারাহ গিলবার্টের মতো মানুষগুলো যে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেখানে মানবজাতি হারতে পারে না। এই যুদ্ধে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানরা হেরে গেছে, টাকার কুতুবরা অসহায়, ধর্মের ধ্বজাধারী মোল্লা-ঠাকুর-বিশপরা সবাই পালিয়েছে- টিকে আছেন কেবল বিজ্ঞানীরা, টিকে আছেন সারাহ গিলবার্ট।
সারাহ'র এবারের আবিস্কারটাকে ধরা হচ্ছে মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার হিসেবে, এমনকি আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিস্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ লক্ষ লক্ষ প্রাণ বাঁচানোর সামর্থ্য আছে এই ভ্যাক্সিনের, যদি সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এগিয়ে যায় তবে। ভ্যাক্সিন ট্রায়ালের বাকি ধাপগুলো সফলভাবে শেষ হয়ে সত্যিই যদি এটা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানবদেহের জন্য কার্যকর হিসেবে প্রমাণীত হয়- তাহলে এবছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারটা যে সারাহ এবং তার দলই জিততে চলেছেন, সেটা নিয়ে কারো কোন সন্দেহই থাকবে না।
আগুনের এই দিন ফুরিয়ে যাবে, প্রচারবিমুখ সারাহ গিলবার্টকে তখন খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। এখন মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানুষটা চলে যাবেন আপন নিবাসে, নিভৃত এক জগতে, যেখানে তিনি থাকতে পছন্দ করেন। ক্লাস নেবেন, গবেষণা করবেন, কুকুরকে নিয়ে পার্কে হাঁটতে বেরুবেন। গবেষণাটা সফল হলে হয়তো নোবেল পুরস্কারটাও দেয়া হবে তাকে- তাতে তার জীবন বদলাবে না, তার ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবটাও বদলাবে না। অর্থ-বিত্ত-বা খ্যাতি তো সারাহদের টানে না, আবারও যদি কখনও মানব সভ্যতা এমন হুমকির মুখে পড়ে, তখনই শুধু এগিয়ে এসে যুদ্ধের ব্যাটনটা হাতে তুলে নেবেন সারাহ, তার আগে নয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন