সারাহ ম্যাকব্রাইড বাংলাদেশী হলে আমরা গালি দিয়ে বলতাম- 'তুই তো ব্যাটা হিজড়া!' আমেরিকাতেও হয়তো বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে তাকে, কিন্ত সেসব সারাহকে দমাতে পারেনি। আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন তিনি...

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমেরিকায় তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ সিনেটর নির্বাচিত হয়েছে। সারাহ ম্যাকব্রাইড নামে নির্বাচিত এই সিনেটরের বর্তমান বয়স ৩০ এর কাছাকাছি। জীবনে চলতি পথে যুদ্ধ করে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে তাকে। তার এই যুদ্ধটা সহজ ছিল না। বড্ড কঠিনই ছিল। স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো হয়ত। সহপাঠীরা হয়ত হাসাহাসি করতো। ছিল না কোন কাছের বন্ধু-বান্ধব। থাকবে কী করে? সে তো অন্য সবার মতো নয়!

এরপরও হয়ত যুদ্ধটা সে জারি রেখেছে এবং চিৎকার করে বলেছে- জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কিংবা নির্ধারিত জৈবিক লিঙ্গটি কেন আমার পরিচয় হবে? তারপরও হয়ত মানুষের অবহেলা, অবজ্ঞা থামেনি। রাস্তায় বের হলে সবাই তাকিয়ে থাকে, হাসাহাসি করে দূরে চলে যায়! সে কি আর মানুষ নাকি!

যাকে বাংলা ভাষায় আমরা বলি হিজড়া! আমরা বাঙালিরা তো শব্দটাকে গালি হিসেবে নিয়ে ফেলছি! "তুই তো ব্যাটা একটা হিজড়া" বলে গালি দিয়ে আমরা মজা পাই! হিজড়া হয়ে জন্ম নেয়াটা কি তাদের অন্যায় হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, এই অন্যায়ে দায় কার? অথচ আমাদের হাসাহাসি থামে না। আর গালি তো কোন দিনও থামার নয়।

কোন একটা কিছুর কমতি নিয়ে যে মানুষটা পৃথিবীতে জন্মেছে; একমাত্র সে-ই জানে পৃথিবী নামক এই গ্রহ'টা কতো কঠিন! মানুষ জামা-কাপড় কিনতে গেলে নতুন কিছু খোঁজে, ভিন্ন কিছু খোঁজে! গাড়ি-বাড়ির ক্ষেত্রে অন্যদের চাইতে আলাদা কিছু খোঁজে। একটা সামান্য কাজ করতে গেলে, মানুষ চায় অন্যদের চাইতে আলাদা কিছু করতে। কিন্তু একটা মানুষ যদি অন্যদের চাইতে আলাদা হয়ে জন্মায়; তখন তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়; নইলে যে স্কুলে অন্য ছাত্ররা পড়তে আসবে না! বন্ধু-বান্ধবরা হাসাহাসি করে কিংবা উপহাস।

সারাহ ম্যাকব্রাইড

এই সব কিছুর ভেতর দিয়েই হয়ত সারা ম্যাকব্রাইড নামের তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষটাকে যেতে হয়েছে। কিন্তু সে থেমে যায়নি। সকল বাঁধা অতিক্রম করে আমেরিকার প্রথম নির্বাচিত সিনেটর হয়েছে। সারা নামের এই মানুষটি নির্বাচিত হবার পর বলেছে- আমি আমার জন্য নয়; স্রেফ অধিকারবিহীন মানুষগুলোর জন্য আজ এই অবদি এসছি। আমার জন্য প্রার্থনা করবেন, যাতে মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করতে পারি। যেই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে; পৃথিবীর কোন মানুষকে যেন সেই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে না হয়।

কে যেন একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি তো বস্তুবাদী নন। তাহলে কেন এতো পড়াশুনা করেছেন? ভালো চাকরি বা এইসবের পেছনে ছুটেছেন? আমি কখনো বড় ডিগ্রী নিতে চাইনি। কখনো ভালো চাকরি কিংবা গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে চাইনি। কিন্তু আমি এটাও জানতাম- আমি যদি একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাতে না পারি; তাহলে আমার কথা কিংবা আমি কী বলতে চাই, সেটা কেউ শুনবে না।

এই যে আপনারা এতো মানুষ আমার লেখা পড়েন, কেন পড়েন? এটা যদি বিদেশে থাকা একজন সফল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়ে ঢাকা শহরের ছোট একটা গলিতে জন্মানো সাধারণ কেউ হতো; আপনারা কি গুরুত্ব দিতেন আমার কথার কিংবা লেখার?

যে কঠিন পথ আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে সে গল্প না হয় অন্য কোন সময় করা যাবে। সেই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মানুষ নামধারী কতো অমানুষকে দেখলাম। সমাজের চোখে এরা ধোয়া তুলসীপাতা। ভাজা মাছটা উল্টেও খেতে পারে না। অথচ পর্দার আড়ালে এমন কোন কাজ নেই করে বেড়ায় না!

সারাহ নামের এই মানুষটাকে অভিনন্দন। সে এই যুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছে। সেই সাথে আপনারা যারা এই লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়েছেন এবং জীবনে আজ অবদি যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, জেনে রাখুন- 'মানুষ কী বলবে' এটাই হচ্ছে আমাদের সব চাইতে বড় শত্রু। আপনি যখন সফল হবেন; তখন এই মানুষরাই দিনে-রাতে আপনার প্রশংসা করবে। অথচ একটা সময় এরাই হয়ত আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা