কমলাপুরের সরদার কলোনি- দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ মেসবাড়ি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সরদার কলোনি যেন শহরের বুকে একটুকরো বাংলাদেশ। যেখানে একই রুমে হয়ত উত্তরবঙ্গের কোনো মানুষ, নোয়াখালি, বরিশালের মানুষও একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে.....
এই শহরের বুকে, রাজধানীর ব্যস্ততম একটি এলাকা কমলাপুর। ১৯৮২ সালের কথা। সেসময় দক্ষিণ কমলাপুরে গোড়াপত্তন হলো আধুনিক সরদার কলোনি। আফির উদ্দিন সরদারের ৮ জন পুত্র মিলে শুরু করেছিলেন এই মেসবাড়ি কলোনি। মতিঝিল সংলগ্ন এই এলাকায় এমন একটি কলোনি ব্যাচেলারদের জন্যে দারুণ এক আশীর্বাদই বটে। শহরে কে কাকে দেখবে, কে জায়গা দেবে থাকার? এক টুকরো বাসস্থান মেলানো খুব ঝক্কির কাজ। তিন দিনের বেশি কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে থাকলে সেই আত্মীয় আর আত্মার মানুষের মতো ব্যবহার করে না। ব্যবহার বদলে যায়, এক্সপ্রেশনে ফুটে উঠে, অনেক খেয়েছো, থেকেছো, এবার নিজ রাস্তা খুঁজে নাও।
যত আপনই হোক, শহরে বাড়তি লোকের থাকার জায়গা দেবার জায়গা নেই কোথাও। হিসেব করা স্কয়ার ফিটের বাড়ি, বাক্সের মতো ঘরগুলো, তার ভেতরে আরো কিছু বাক্স-আলমিরা শোকেস, টেবিলে ভর্তি। দম ফেলারও ফাঁকা জায়গা নেই মধ্যবিত্ত ঘরগুলোতে। তাই, আত্মীয়তার বন্ধন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কেউ কাউকে দিনের পর দিন জায়গা ছেড়ে দিতে পারে না। এমন শহরে যার যার ব্যবস্থা তাকেই করে নিতে হয়। সেই ব্যবস্থা করারও অবস্থা কোথায়? ব্যাচেলারদের জন্য নির্বিগ্নে থাকার জায়গারও যে অভাব, অবিবাহিত সিঙ্গেল মানুষদের কেন যেন শহুরে বাড়িওয়ালারা বিশ্বাস করেন না।
ব্যস্ততম রোবোটিক, যান্ত্রিক এই শহরে ব্যাচেলারদের জন্য তাই একরকমের 'স্বর্গ' কমলাপুরের সরদার কলোনি। জায়গা খালি থাকা সাপেক্ষে এখানে যে কেউই থাকতে পারে। আধুনিক কলোনি রুপে সরদার কলোনি আশির দশকে চালু হলেও এই জায়গাটির ইতিহাস আরো পুরানো। অনেক আগে এই জায়গাটি ছিল ফসলের মাঠ, আবাদ হতো সবজিশাক। এখানে একসময় কাছ দিয়ে শুরু হলো রেলওয়ের কাজ। তখন নিম্নবর্গের মানুষজন থাকার জায়গা খুঁজছিল। তারা এসে ধরলো সরদার আফির উদ্দিনকে। আফির উদ্দিন কিংবা সরদার বংশের তখন অনেক জমিজিরাত। কমলাপুর, মুগদার অনেক জায়গা তাদের। তাই নিম্নবর্গের মানুষগুলো সরদারকে এসে বললো, তাদের থাকার জায়গা নেই। সরদার আফির উদ্দিনের সায় মেলাতেই এখানে মানুষরা থাকতে শুরু করলো।

১৯৮২ সালে প্রথম এখানে কিছু আধপাকা ঘর হয়। সেই গল্প জানা যায় আফির উদ্দিনের নাতি সরদার আকিল আহমেদের কথায়। তার বক্তব্য হলো, এটা ১৯৮২ সালের কথা। মতিঝিল তখনো রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। ব্যাংক-বিমাসহ সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অনেকে এসে তাঁর বাবা-চাচাদের কাছে অনুরোধ করলেন থাকার একটা ব্যবস্থা করার জন্য। তাঁদের কথাতেই তোলা হলো আধা পাকা কয়েকটি ঘর। ব্যবস্থা হলো কর্মজীবী মানুষের থাকার। আরও বছর চারেক পর ভিত্তি গড়া হলো বহুতল ভবনের। একে একে উঠল আটটি ভবন। গড়ে উঠল সরদার কলোনি। যে কলোনি এখনো ব্যাচেলারদের পরম নির্ভরতার জায়গা, মাথা গুঁজবার ঠিকানা!
অধিকাংশ লোক এখানে ব্যাচেলর, ৭০ শতাংশ চাকরিজীবি। তবে বিবাহিত লোকও থাকেন এখানে। ছাত্রদেরকেও দেখা যায়। কেউ কেউ এই জায়গা থাকছেন অনেক বছর যাবত। হয়ত তাদের মায়া পড়ে গেছে এই বিশাল জায়গাটির উপর। এক রশিদা খালাই এখানে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে থাকছেন, যার কেউ নেই এই ভুবনে। এখানে একটি ভবনে ৮ জনের রান্নাবান্নার কাজ করেন, এই করেই দিন চলে যাচ্ছে ষাটোর্ধ এই মানুষটির।
সরদার কলোনি আসলে একটি বাড়ি নয়, মোট ৮টি ভবন নিয়ে গড়ে উঠেছে সুবিশাল এই ব্যাচেলার কলোনি। মতিঝিলের ১৩৫ নম্বর প্লটে আটটি ভবন মিলে এই সরদার কলোনি। ভবনগুলো ১৩৫ (৪ তলা), ১৩৫/এ (২ তলা), ১৩৫/বি (৮ তলা), ১৩৫/সি (৬ তলা), ১৩৫/ডি (৫ তলা), ১৩৫/ই (৪ তলা), ১৩৫/এফ (৫ তলা), ১৩৫/জি (৫ তলা) নামেই পরিচিত। এখানে তিন হাজারের মতো মানুষের বাস, বাংলাদেশ তো বটেই গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেও এমন আর কোনো কলোনির খবর পাওয়া যায় না। এই ভবনগুলোতে থাকার খরচও খুব বেশি নয়। প্রতিটি ভবনে বিভিন্ন আকারের রুম রয়েছে। এসব রুমে আকারভেদে দুই থেকে পাঁচজন থাকতে পারেন।
ভবনগুলোতে প্রত্যেক তলাতেই টয়লেট, রান্নাঘর, বাথরুম রয়েছে। প্রতিটি রুমের আকার বিভিন্ন রকমের হলেও ডিজাইন একই ধরনের। প্রতিটি ভবনেই মাঝে রয়েছে বর্গাকার খোলা জায়গা। রুমের ভাড়া সর্বনিম্ন ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। রান্নার ব্যবস্থা হয় মেসে। বারোয়ারি রান্নাগুলো যারা পরিচালনা করেন, তাদের মেসবাসীরা খালা বলে ডাকেন। কয়েকজন খালা মিলে প্রতিটি বাড়িতে সকলের রান্নার জোগাড়যন্তর করেন।

দারুণ ব্যাপার হলো, এই মেসগুলোতে কোনো নিরাপত্তা সংকট নেই। এখানে কোনো অনিয়ম কিংবা অনৈতিক কাজ হয় এমন দৃষ্টান্তও নেই। ফলে, এই ব্যাচেলারদের মেস নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই কারো, প্রশাসনের তরফ থেকেও কখনো কোনো বিরুপ ব্যবহার পায়নি এখানকার কেউ। পুলিশ এসেও কখনো এখানে হয়রানি করে না। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান সহ জঙ্গি হামলার বীজ ছড়িয়ে পড়ার মরশুমে দেশের ব্যাচেলার মেসগুলো নিয়ে বেশ তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় পুলিশের পক্ষ থেকে। অভিযান চালানো, কোথাও মেস উচ্ছেদ করা সহ বিভিন্নমুখী তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু, তার আঁচ লাগেনি সরদার কলোনিতে।
এই কলোনিতে প্রবেশ করতে পারে না কোনো উটকো লোক। এখানে বেশিরভাগ নিবাসী চাকরিজীবি। যারা শিক্ষার্থী পরিচয়ে আসেন, তাদেরকে অভিভাবক নিয়ে আসতে হয় জায়গা প্রাপ্তির জন্য। কেউ মেহমান নিয়ে আসলে দুইদিনের বেশি রাখার নিয়ম নেই, অসুস্থ হলে একমাস পর্যন্ত রাখা যায়। ফলে, বাইরের লোকের উৎপাত নেই এখানে যা এই কলোনির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
সরদার কলোনি যেন শহরের বুকে একটুকরো বাংলাদেশ। যেখানে একই রুমে হয়ত উত্তরবঙ্গের কোনো মানুষ, নোয়াখালি, বরিশালের মানুষও একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। পরিবার থেকে দূরে থাকা মানুষদের এই মিলনমেলা থেকে যেন আরেকটি পরিবার তৈরি হয়ে উঠে সময়ের স্রোত যেতে যেতে। কলোনির ভেতরে ফেনী স্টোরের দোকানী কিংবা রান্না হওয়া ভাতের মাড় ভ্যানে করে নিতে আসা আশি বছর বয়সী তোতা মিয়া, কিংবা রশিদা খালা সবাই যেন এক নতুন বন্ধনের সূত্রে গাঁথা। এই শহরে কেউ কাউকে জায়গা না দিলেও এই সরদার কলোনি তিন হাজার পরিবার থেকে দূরে থাকা মানুষদের থাকার জায়গা দিচ্ছে। এটা এক দুর্দান্ত ঘটনা!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন