স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে পা রেখেছিলেন কিশোরগঞ্জে জন্ম নেয়া সত্যজিৎ রায়। ওয়ারির র‍্যাংকিন স্ট্রিটে মামাবাড়ির স্মৃতিচারণ করেছিলেন, জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ নিয়ে তার আবেগ আর অনিভূতির কথা...

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ও শেষবারের মতো আসেন কিংবদন্তী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। উপলক্ষ ছিল ছাত্রলীগ আয়োজিত শহীদ দিবস স্মরণে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ। 

সেদিন পল্টন ময়দানে প্রধান অতিথির ভাষণে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। পূর্ববঙ্গে বাড়ি ছিল উল্লেখ করে বলেন পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সাথে একবার এসেছিলেন। পুরোটা সময় তিনি বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসার প্রচন্ড বহিঃপ্রকাশ ঘটান।

তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেন, "আমার কুড়ি বছরের চলচ্চিত্র জীবনে বিশ্বের বহু স্থান থেকে এবং আমার নিজ দেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার, পদক এবং সম্মান লাভের সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু আজ বাংলাদেশে যে সম্মান, যে ভালোবাসা আমি পেলাম তা সবকিছুর কাছে ম্লান হয়ে গেছে। আমি কোনোদিন এই জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলব ভাবতে পারিনি। আমি বক্তা নই। আমি থাকি নেপথ্যে। ছবি আঁকি, পরিচালনা করি। আজ সকালে ঢাকায় এসে আমি যা দেখেছি তাতে আমি অভিভূত। আমি বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানএসে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না আপনারা বাংলাভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন। ভাষাকে যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন তা এখানে এসে বুঝতে পারছি। আমরাও পশ্চিমবঙ্গে বাংলাকে ভালোবাসি। কিন্তু আরো পাঁচটা সংস্কৃতি এসে কিছুটা প্রভাব পড়েছে সেখানে।

তবে আমরা বাংলাকে ভালোবাসি। আমাদের থিয়েটার, নাটক, চলচ্চিত্র ও ছবিতে বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। রেখেছি রবীন্দ্রনাথকে। আমার কাছে বহুবার অনুরোধ এসেছে অন্য ভাষায় ছবি করার জন্য। কিন্তু আমি প্রত্যাখ্যান করেছি তা। কারণ আমার রক্তে যে ভাষা তা বাংলা। অন্য ভাষায় গেলে আমার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না। কূল কিনারা পাবো না। 

আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে, পূর্ববঙ্গ নাকি আমার দেশ। আমার ঠাকুরদাদা উপেন্দ্র কিশোর রায়ের নাম হয়তো আপনারা কেউ কেউ শুনেছেন। আমার তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু শিশুকাল থেকে আমি তার রচিত ছেলে ভুলানো পূর্ববঙ্গের কাহিনী টুনটুনির বই পড়ে এসেছি। ভালোবেসে এসেছি। তার রচিত গানে আমি পূর্ববঙ্গের লোকসঙ্গীতের আমেজ পেয়েছি। যদিও আমি এ দেশে আসিনি, আমার দেশে আমি কখনো আসিনি বা স্থায়ীভাবে আসিনি; এইসব গান, এইসব রূপকথা শুনলে আমার মনে হতো যে এদেশের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ রয়েছে। 

আমি আজ অত্যন্ত আনন্দিত। কোনোদিন ভাবিনি আবার কখনো দেশে আসতে পারব। অনেক দিন আগে খুব ছোটবেলায় যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, তখন একবার এসেছিলাম আমার মায়ের সঙ্গে এই দেশে। শুনেছি আমার বাড়ি পূর্ববঙ্গে। সেই ছোটবেলায় কি দেখেছি তার অনেক কিছুই আজ আমার মনে নেই। শুধু মনে পড়ে পদ্মার ওপর স্টিমারে করে যখন আসছি আমার মা খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমাকে পদ্মার বুকে সূর্যোদয় দেখিয়েছিলেন। আর মনে পড়ে দুই নদীর মোহনার মিল দেখেছিলাম। দুটি নদী মিশে গেছে কিন্তু এর জল দু’রঙের। সেই থেকে বারবার মনে হয়েছে যে একবার নিজের দেশটা গিয়ে দেখে আসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে আশা বিশেষত দেশ বিভাগের পর ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হতে চলেছিল। 

হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল এবং আজ শহীদ দিবসে এসে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হলো। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ রেখে চলে এসেছি। এবার আর বেশিদিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে যে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে ফিরে আসব। এদেশটাকে ভালো করে দেখব। এদেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে। আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না। আমার মামার বাড়ি ছিল ওয়ারীতে, র‌্যাংকিন স্ট্রিটে। সে অনেক দিন আগে। এখন র‌্যাংকিন স্ট্রিট আছে কিনা তাও জানি না। তখনকার ঢাকার কথা আমার ঠিক মনে নেই। তবে সেই এলাকার বানরের উৎপাতের কথা এখনো মনে আছে।"

এক পর্যায়ে সত্যজিৎ রায় প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি আবার আসবেন এই দেশে। মিশবেন দেশের জনগণের সঙ্গে। তিনি ১৯৬৫ সনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসবে তার ছবি ‘মহানগর’ সম্পর্কে বাংলার মানুষের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সেই ঘটনা তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার কাজ সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করেছিল।’ ভাষণের শেষে সত্যজিৎ রায় ‘জয়বাংলা’ বলে সমাপ্তি করেন।

সেই সংক্ষিপ্ত যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর সাথেও দেখা করেছিলেন তিনি। দুই জগতের দুই মহানায়ক বন্দী হয়েছিলেন এক ফ্রেমে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায়, বিবিসি তাঁকে তেরোতম অবস্থানে রাখে। যেখানে চলচিত্র জগতের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। সত্যজিৎ সারাজীবন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। বাংলাকে অগাধ ভালোবেসেছেন তিনি, বলে গেছেন বাঙালির জীবনধারা ও স্বপ্নের গল্প। পথের পাঁচালির সেই সাদাকালো জমানায় তিনি যেভাবে গ্রামবাংলা-কে তুলে ধরেছিলেন, তা আজকের জমানাতেও কেউ পারবেন কিনা জানা নেই। 

নির্মাতা হিসেবে তিনি কেবল সিনেমার বিকাশে ভূমিকা রাখেননি, পাশাপাশি বাঙালির মনোজগতে উৎকর্ষ সাংস্কৃতিক সত্তা তৈরিতে অনন্য অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯৯২ সালে অস্কার তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেন। আজ মহান সৃষ্টিশীল এই মানুষ জন্মশতবর্ষে পা দিয়েছেন। আজও তাঁর সৃষ্টিকর্ম, তাঁর দর্শন বাঙালির জীবন ও সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে প্রাসঙ্গিক, করে প্রভাবিত। আজও উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের ন্যায় সত্যজিৎ এর চর্চা সর্বত্রই। প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তিনি স্বপ্নের কারিগর ও গল্পকথক হিসেবেই থাকবেন। শুভ জন্মদিন মহারাজা!

ভাষণের তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক ভোরের কাগজ, ২৭ এপ্রিল ১৯৯২।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা