একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু যখন মাত্র চব্বিশ কিংবা আটচল্লিশ ঘন্টা, তখন আপনার পরিবারকে নিরাপদ রাখুন। খেসারির ডাল আর আলু ভর্তার হাত থেকে তাদের বাঁচান...

বাদল সৈয়দ: 

আমরা মোটামুটি করোনার আগের অবস্থায় ফিরে গেছি। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। মাস্ক নেই, চলাফেরায় সাবধানতা নেই, আবার গেট টুগেদার, দাওয়াত, মেজবান, বিয়ের উৎসব- সবকিছু শুরু করেছি।

যার যার স্বাধীনতার ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না।। আমি শুধু বলবো, করোনা বিদায় নেয়নি। এখনো এর ভয়াল থাবায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, কারো যেন এমন না হয়। তবে যদি হয় তবে কী ঘটবে তার একটি সত্য উদাহরণ দেই।

করোনার শুরুতেই  পরিচিত মধ্যবিত্ত এক ভদ্রলোক মারা গেলেন। বন্ধুবাৎসল্যের জন্য তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ফেইসবুকে দেখলাম তাঁকে ঘিরে অসংখ্য শুভার্থীর শোকার্ত পোস্ট। মন খারাপ হলেও স্বাভাবিকভাবেই কয়েকদিন পরই ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। সপ্তাহখানেক পর একটি ফোন পেলাম, করেছেন মৃতের ভাই।

তিনি বললেন, 'স্যার আপনি তো আমার ভাইকে চিনতেন। তিনি খুব স্বচ্ছল না হলেও অস্বচ্ছল ছিলেন না। যা ছিলো তা দিয়েই ভালোই সময় যাচ্ছিলো। আকাশ ভেঙে পড়েছে তিনি মারা যাওয়ার পর।  জমা কোনো টাকা নেই। ফ্যামিলি চলার কোনোই উপায় নেই। দয়া করে কিছু করা যায়?' আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওনার বন্ধুরা কিছু করছেন না? উত্তর এলো- 'স্যার, ওনারা মারা যাওয়ার পর কয়েকদিন এসেছিলেন, এখন আর কেউ খোঁজ নেন না, আমি স্যার স্কুল শিক্ষক, তাই সামর্থ্য নেই কিছু করার'।

পুরো ব্যাপারটি জেনে 'পে ইট ফরোয়ার্ড ' এর একজন শ্রদ্ধেয় ডোনার, খুবই উচ্চ পদস্থ একজন পরিবারটিকে এককালীন কিছু টাকা  দিলেন। যাতে অন্তত কয়েকমাস চলে যায়। তারপর ব্যাপারটি আমিও ভুলে গেলাম। কদিন আগে ডোনার ভদ্রলোকই ফোন করে বললেন, 'বাদল, অমুকের ফ্যামিলির খবর কী? যে টাকা দিয়েছিলাম, তাতো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা'। আমি খুব লজ্জা পেয়ে বললাম, "স্যার, আমি খুব দুঃখিত, আর খবর নেওয়া হয়নি। আমি নিয়েই জানাচ্ছি।'

খবর নিতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। তাঁর ভাইয়ের নাম্বার সেইভ করা হয়নি। তখন আমি মৃত মানুষটির সব বন্ধুদের ফোন করলাম এবং অত্যন্ত বেদনার সাথে আবিষ্কার করলাম, তাঁরা কেউ-ই পরিবারটির খবর জানেন না। তাঁদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যে বাসায় তাঁরা থাকতেন সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখি, অনেক আগেই তাঁরা বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িওয়ালা জানেন না কোথায় গেছেন।

করোনায় আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ঢাকা ছেড়েছে অসংখ্য মানুষ

খুবই আশ্চর্য হলাম! ভদ্রলোকের এত বন্ধু, এত ফেইসবুকে আড্ডার ছবি, অথচ তাঁর পরিবারটি শহর ছেড়ে কোথায় উধাও হলেন কেউ জানেন না!

ভাগ্য ভালো ভদ্রলোকের ভাই যে স্কুলে কাজ করতেন তার নাম জানতাম, তা আবার আরেক শহরে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে বের করে পরিবারটিকে আবিষ্কার করলাম প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। হতদরিদ্র অবস্থা। বাচ্চারা শহরের আধুনিক স্কুল ছেড়ে ভর্তি হয়েছে গ্রামের অপরিচিত স্কুলে। তাদের মা কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিলেন না, কান্না ভেদ করে যা জানলাম, তা হচ্ছে, তাঁদের দেখার কেউ নেই, চট্টগ্রামে কেউ তাঁদের খোঁজ নেয়নি। পরে তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুর তাঁদের গ্রামে নিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর কোনো আয় নেই। 

দেবর স্কুল শিক্ষক, নিজেই চলতে পারেন না, তবু সামান্য কিছু টাকা পাঠান, সেটা দিয়ে না বাঁচার মতোই বেঁচে আছেন তাঁরা। সবচেয়ে কষ্ট বাচ্চাদের। বাবা তাদের কোনোদিন অভাব বুঝতে দেননি, এখন প্রতিদিন আলু ভর্তা আর খেসারির ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে খাওয়ার কথা শুনলেই তারা কান্না শুরু করে। দুটো ঈদ গেলো, জামা তো দূরের কথা, এক টুকরো মাংসও তাদের মুখে ওঠেনি। প্রায় ভগ্নদশা স্কুলে যাওয়ার সময় পুরানো স্কুলের কথা মনে করে তাঁরা চোখের জল লুকায়।

এটাই বাস্তবতা। আমি-আপনি চলে গেলে ইচ্ছে থাকলেও কেউ আমাদের পরিবারের পাশে থাকতে পারবেন না। এটা পারা যায় না। আসলে পরিবারের জন্য আপনার কোনো বিকল্প নেই। অতএব, একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু যখন মাত্র চব্বিশ কিংবা আটচল্লিশ ঘন্টা তখন আপনার পরিবারকে নিরাপদ রাখুন। খেসারির ডাল আর আলু ভর্তার হাত থেকে তাদের বাঁচান। বাচ্চাদের পুরোনো স্কুল টিকিয়ে রাখুন। করোনাকে ভয় করুন। আপনার জন্য না হলেও পরিবারের জন্য। প্লিজ সেইভ ইয়োর ফ্যামিলি।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা