পাঁচ বছর বয়স থেকেই অনন্যার আগ্রহ মহাকাশ নিয়ে। পড়াশোনা করতে বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকায়, হয়েছেন মহাকাশ বিজ্ঞানী। সেই অনন্যাকে এবছর সায়েন্স নিউজ সেরা দশ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন হিসেবে খেতাব দিয়েছে...

এ দেশের মাধ্যমিকের নবম শ্রেণিতে ওঠার পর যারা পড়াশোনার বিভাগ হিসেবে 'বিজ্ঞান' কে বেছে নেন, তাদের অনেকেই এই কাজটি করেন, শুধুমাত্র পরিবারের চাপে পড়ে। হয়তো হিসাববিজ্ঞান, হয়তো বাংলা-ইতিহাসে ছেলেটির বা মেয়েটির ভালো দখল, কিন্তু তাও বেছে নিতে হয় বিজ্ঞান। কারন, বাসা থেকে বলেছে। বাসা থেকে কেন বলেছে এই বিভাগটি বেছে নিতে, তার পেছনেও রয়েছে কারন। ছেলেকে বিজ্ঞানে পড়ার জন্যে বাধ্য করা হয়, কারন- পাশের বাসার ভাবীর ছেলে বিজ্ঞানে পড়ে। এখন নিজেদের ছেলে যদি বিজ্ঞানে না পড়ে, তাহলে ভাবীর কাছে মান-সম্মান থাকবে না৷

তাছাড়া বিজ্ঞানে পড়লে সহজেই  রেজাল্ট ভালো করে ভালো চাকরী পাওয়া সম্ভব হবে। লাইফ সেট হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, 'ছেলে সায়েন্সে পড়ে' এই কথা বলার মধ্যে আছে একটা গালভরা শান্তির ব্যাপার। যদি মেয়েদের প্রসঙ্গে আসি, মেয়েদের বিজ্ঞানে কেন পড়তে বাধ্য করা হয়, তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারন- বিয়ের বাজারে ভালো দাম পাওয়া। মেয়ে সায়েন্সের ছাত্রী... এ কথা বললে পাত্রপক্ষের মুখে একচিলতে হাসি ফোটে। আর্টস, কমার্স... এগুলো কোনো সাবজেক্ট নাকি! আর এসব সাবজেক্টে যারা পড়ে, তারা আবার মানুষ নাকি!

আমাদের দেশে তাই বিজ্ঞান বিভাগে যারা পড়াশোনা করে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই বিষয়টি মোটামুটি এক প্রহসন হিসেবে রয়ে যায়। বরাবরই। হঠাৎ ধান ভানতে শিবের গীত কেন গাইছি! কারন আছে তারও। সম্প্রতি সায়েন্স নিউজ নামের একটি গনমাধ্যম বর্তমান সময়ের দশজন বিজ্ঞানীর একটি পরিসংখ্যান বের করেছে। 'এসএন টেনঃ সায়েন্টিস্ট টু ওয়াচ' নামের এই পরিসংখ্যানে পৃথিবীর দশ জন বিজ্ঞানীর মধ্যে সুযোগ পেয়েছে এক বাংলাদেশিও৷ বিস্মিত হওয়ার মতই বিষয়। বাংলাদেশের সাথে গবেষণা, বিজ্ঞানী... এই শব্দগুলো যখন কেউ উচ্চারণ করে, তখন একটু ধন্দ তো অবশ্যই লাগে।

সেই ধন্দ নিরসনের আগে সায়েন্স নিউজের একটু বর্ণনা দেয়া দরকার। ১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠন বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে। গত ছয় বছর ধরে তারা শুরু করেছে আরেকটি উদ্যোগ। যে উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রতিবছর তারা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকা প্রকাশ করে। যাদের বয়স চল্লিশ বছরের কম এবং যারা এখনো কোনো প্রফেশনে যান নি, তাদের মধ্য থেকেই বিজ্ঞানীদের বার্ষিক এই তালিকা করা হয়। যে তালিকার দশটি নামের মধ্যে এবার রয়েছে একজন বাংলাদেশিরও নাম।

বাংলাদেশের মেয়ে তনিমা তাসনিম অনন্যা হয়েছেন এ বছরের বাছাইকৃত দশজন বিজ্ঞানীর মধ্যে একজন। তিনি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছেন। সে সাথে কৃষ্ণগহ্বরের নিখুঁত ছবিও তৈরী করেছেন তিনি। যে ছবি প্রশংসা কুড়িয়েছে বিজ্ঞানী মহলে। ঠিক সে কারনেই তিনি পেয়েছেন এ অনন্য স্বীকৃতি।

মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে মহাকাশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে অনন্যা!

বিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশে পড়াশোনার খুব বেশি সুযোগ না থাকায় অনন্যা খুব অল্পবয়সেই চলে আসেন আমেরিকায়। ব্রায়েন মায়ার ইউনিভার্সিটি, ইয়েল ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা শেষ করে অনন্যা এখন যুক্ত আছেন ডার্টমাউথ কলেজের সাথে। তিনি মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করছেন এখন। ব্ল্যাক হোল তার অন্যতম আগ্রহের বিষয়। যুক্ত ছিলেন নাসা ও সার্নের বেশ কিছু প্রজেক্টের সাথেও। বিজ্ঞান নিয়ে যখনই যেখানে তিনি সুযোগ পেয়েছেন, লুফে নিয়েছেন। এবং এখনও নিচ্ছেন।

অনন্যা খুব অল্পবয়স থেকেই মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বয়সের সাথে সাথে সে আগ্রহে ভাটা পড়েনি কখনো। নিজের আগ্রহ নিয়েই সামনে এগোতে পেরেছে সে। যেটার এক ফলাফলই পেলো সে সম্প্রতি। আমাদের অনেকেরই এরকম বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ থাকে। ইচ্ছে থাকে। কিন্তু সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ঠিকভাবে বেড়ে ওঠার আগেই আমাদের আটকে দেয়। এটাই হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ধানক্ষেতে যদি পাটের চারা থাকে, তাহলে পাটের চারা সেখানে আগাছা। আবার পাটক্ষেতে যদি একটি ধানগাছ পাওয়া যায়, ধানগাছ তখন সেখানে আগাছা। নিজের উপযুক্ত জায়গা বাদে আমরা প্রত্যেকেই অন্য জায়গায় আগাছা। ঠিক এভাবেই আমরা অন্যের ইচ্ছেমত চলতে চলতে একটা সময় 'আগাছা' হিসেবেই মরে যাই। আমাদের আর আলাদা করে বড় হয়ে ওঠা হয় না। শিরদাঁড়া উঁচু করে আকাশ দেখা হয় না।

এরকম এক প্রহসনের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে অনন্যার জন্যে শুভকামনা ও ভালোবাসা রইলো। স্বপ্ন সত্যি হোক, এটাই কামনা।


*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা