ভাস্কর্য আছে ইরাকে, ইরানে, তুরস্কে, সৌদি আরবে, পাকিস্তানে, ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়ায়, আছে আরব আমিরাতে, আছে আলজেরিয়া, লিবিয়া, লেবানন কিংবা অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রেও। সেখানে কেউ ভাস্কর্য নদীতে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেয় না...

দেশে এখন ভাস্কর্যবিরোধিতার একটা হুজুগ তৈরি হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল, সেই খেলাটার নিয়ন্ত্রণ এখন প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা দিয়েছেন, ঢাকা ও আঙ্কারায় তারা দুটো ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন, ঢাকায় নির্মিত হবে আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য, আর আঙ্কারায় স্থাপন করা হবে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। 

ধর্মান্ধ যেসব লোকজন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছিল, তারা এখনও হাল ছাড়েনি। গতকাল রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে স্থাপিত শহীদ মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্য’র একটা অংশ ভেঙে ফেলেছে। সেটা মেরামতও করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। যুক্তিতে না কুলালেই যে প্রতিক্রিয়াশীদের 'হাত থাকতে মুখে কি' টাইপের আচরন শুরু হয়ে যায়, এটাও তার একটা দৃষ্টান্ত। 

নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে 'ইসলামবিরোধী' কোন ভাস্কর্য থাকতে পারবে না, এই স্লোগানটা কানে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বিরক্ত হয়ে একটু খোঁজ নিতে গেলাম, মুসলিম দেশগুলোর কোথায় কি ভাস্কর্য আছে। নজির দেখে মোটামুটি চক্ষু চড়কগাছ। পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কাতার, আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, লেবানন, এমনকি তুরস্ক এবং সৌদি আরবেও আছে ভাস্কর্য! এসব দেশের কোথাও ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে পরিচিতি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে না, বরং ভাস্কর্যকে শিল্পের একটা মাধ্যম, একটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

পাকিস্তানের লাহোরে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য

প্রথমে হাতের কাছে পাকিস্তানে যাই। কারন এই দেশটা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনে সিদ্ধহস্ত। অজস্র মন্দির, মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে পাকিস্তানে, ভেঙে দেয়া হয়েছে হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর। তারপরও পাকিস্তানে রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মূর্তি; আছে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য শিল্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে ষণ্ডমূর্তি, লাহোরে বাদশাহি মসজিদের পার্শ্বে মাতা মেরির ভাস্কর্য, পাঞ্জাবের জং শহরের রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়সওয়ারের ভাস্কর্য, লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস প্রাঙ্গণের নানা ভাস্কর্য।

ইরাকের বাগদাদে যোদ্ধাদের ভাস্কর্য

এবার একটু দূরে যাই, গন্তব্য সুদূর ইরাক। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সংখ্যাগুরু হচ্ছে শিয়া মুসলমানরা। সাদ্দাম হোসেন যখন দেশটার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন দেশের আনাচেকানাচে ছিল তার আবক্ষমূর্তি। সাদ্দামের পতনের পর জনতাই এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ভেঙে ফেলেছে, তবে সেটা ভেঙেছে সাদ্দামের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ থেকে। অন্যান্য ভাস্কর্যগুলো বহাল তবিয়তেই আছে, যেমন রাজধানী বাগদাদের ইন্টারন্যাশনাল জোনে হাম্মুরাবির ভাস্কর্য, আবু নুয়াস স্ট্রিটে শাহেরজাদি পার্কে আরব্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শাহেরজাদি এবং রাজা শাহরিয়ারের ভাস্কর্য, আলীবাবা স্কোয়ারে আছে আলীবাবা চল্লিশ চোরের বিখ্যাত চরিত্র মর্জিনার ভাস্কর্য।

তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য

ভাস্কর্যের বিরোধিতা যারা করে, তাদের কাছে তুরস্ক হচ্ছে আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র, এরদোয়ান হচ্ছেন সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মতো একটা কাল্ট ক্যারেক্টার। অথচ তুরস্কজুড়ে আছে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অজস্র ভাস্কর্য। এছাড়াও আছে মর্মর সাগর তীরে পোতাশ্রয়ে অপূর্ব মর্মর মূর্তি, আঙ্কারাতে ইন্ডিপেনডেন্স টাওয়ারের পাদদেশে তুরস্কের জাতীয় সংস্কৃতির ধারক তিন নারী মূর্তি ও আন্তালিয়ায় এডুকেশন অ্যাক্টিভিস্ট তুরকান সায়লানের মূর্তি। এসব মূর্তি তুরস্ক ভ্রমণে যাওয়া ভ্রমণপিপাসুদের নজর কাড়ে।

সৌদি আরবে উটের ভাস্কর্য

সৌদি আরবও এই তালিকার বাইরে নয়। যে দেশটিকে ইসলামের পূণ্যভূমি ধরা হয়, সেখানেও আছে ভাস্কর্য। শতভাগ মুসলমানের এই দেশটিতে একসময় বাহন হিসেবে উট এবং ঘোড়ার প্রচলন ছিল, মরুভূমির গভীরে এখনও আছে। তাই সেখানে দেখা যায় উট, ঘোড়া বা গাংচিলের ভাস্কর্য। রাজধানী জেদ্দার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে নগরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাংরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য।

বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করে ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানেও আছে অজস্র ভাস্কর্য। বালি, সুমাত্রা, জাভা- এসব দ্বীপে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন অজস্র ভাস্কর্য। তবে এসব ভাস্কর্যে কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না সেখানে, সবাই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, যার যার ধর্ম সে সে পালন করছে, ভাস্কর্য নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। 

এই ভাস্কর্যটি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অবস্থিত

শিয়াপ্রধান দেশ ইরান, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীও। এখানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা চালু থাকলেও, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা মিলবে ভাস্কর্যের। বেশির ভাগই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের স্মরণে নির্মিত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তেহরানের ফেরদৌসী স্কয়ারে স্থাপিত মহাকবি ফেরদৌসীর মূর্তি, ইরানের হামাদানে ইবনে সিনার মূর্তি, তেহরানের লালেহ পার্কে ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য, কবি হাফিজের ভাস্কর্য, খোরাসানের মাসাদে নাদির শাহর মূর্তি। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি বা ইমাম খোমেনির একাধিক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল আছে ইরানে। এর মাধ্যমে ইমাম খোমেনি এবং ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিপ্লবের আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে।

ইরানে খোমেনির ভাস্কর্য

ভাস্কর্য আছে মালয়েশিয়ায়, আছে আরব আমিরাতে, আছে আলজেরিয়া, লিবিয়া, লেবানন কিংবা অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রেও। সেখানে কেউ ভাস্কর্য নদীতে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেয় না, ধর্মের অপব্যখ্যা দিয়ে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করে না। কাজেই বাংলাদেশের এই ভাস্কর্য বিরোধিতা যে কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের নোংরা খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটা স্বাভবিক মস্তিস্কেই বুঝতে পারার কথা যে কারো। কিন্ত অন্ধভক্তিতে মস্তিস্ক যদি পূর্ণ হয়ে থাকে, সোজা কথাগুলোও অনেক সময় ঠিকমতো প্রবেশ করে না। এদেশের জনসংখ্যার বড়সড় একটা অংশ এখন সেই সমস্যায় জর্জরিত। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা