কারও পছন্দের পাত্র হয়ে ওঠার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো তাকে হাসাতে পারা, আর সেজন্য চাই উচ্চ সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী হওয়া। সত্যিকারের সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী হয়ে উঠতে চাইলে আমাদের কী করতে হবে? এখন আপনাদের সেরকমই কিছু অব্যর্থ উপায় বাতলে দেব, যেগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করলে আপনাদের প্রকৃত সেন্স অফ হিউমারওয়ালা হয়ে ওঠা কেউ ঠেকাতে পারবে না। 

যে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পাঁচ ধরনের সেন্স থাকে। কোনো কিছু দর্শনের সেন্স, কোনো শব্দ শ্রবণের সেন্স, কোনো কিছু স্পর্শ করে অনুভূতি লাভের সেন্স, কোনো কিছুর স্বাদ গ্রহণ করার সেন্স আর কোনো জিনিসের ঘ্রাণ নিতে পারার সেন্স। এই পাঁচ ধরনের সেন্সের বাইরেও আজকাল অন্য আরেকটি সেন্সের কথা অনেক বেশি শোনা যায়। সেটি হলো সেন্স অফ হিউমার। সেন্স অফ হিউমারের সহজ বাংলা হতে পারে রসবোধ। অর্থাৎ মজার কোন কিছুর রসাস্বাদন যেমন সেন্স অফ হিউমার, ঠিক তেমনই নিজে মজার কিছু বলে অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারাও সেন্স অফ হিউমার। বর্তমান বিশ্বে এই সেন্স অফ হিউমারের গুরুত্ব অপরিসীম।

আজকাল প্রায় সব মানুষই কোনো না কোনো কারণে নিজেদেরকে দুঃখী মনে করে, আর প্রায় সময়ই অবসাদগ্রস্ত থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, গড়পড়তা মানুষের জীবনে আনন্দিত হওয়ার উপলক্ষ্য খুব কমই আসে। তাই তারা সবসময়ই আশায় থাকে রসবোধ সম্পন্ন কারও সংস্পর্শে আসার, যার সাথে কথা বলে তারা কিছু সময়ের জন্য হলেও হাসতে পারবে। সুতরাং কারও পছন্দের পাত্র হয়ে ওঠার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো তাকে হাসাতে পারা, আর সেজন্য চাই উচ্চ সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী হওয়া। 

বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে হয়ত জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে পয়সাওয়ালা মানুষদেরকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু পশ্চিমাবিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অবস্থা একদমই ভিন্ন। যেহেতু সেসব দেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বিতা রয়েছে, তাই জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সুন্দর চেহারার পরই তারা যে জিনিসটি কামনা করে, তা হলো উচ্চ সেন্স অফ হিউমার। তাছাড়া আজকাল কর্পোরেট দুনিয়ায় বসের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠতেও সেন্স অফ হিউমার দারুণ কাজ করে। পরিসংখ্যান বলছে, যার সেন্স অফ হিউমার যত ভালো, অন্যদের চেয়ে তার দ্রুত পদোন্নতির সম্ভাবনা তত বেশি। 

তাহলে পাঠক বুঝতেই পারছেন, সেন্স অফ হিউমার জিনিসটি আজকের দিনে কত বেশি জরুরি। কিন্তু সমস্যার বিষয় হলো, অধিকাংশ মানুষই সেন্স অফ হিউমারের প্রকৃত সংজ্ঞা জানে না। তাই প্রায় সকলেই নিজেদেরকে উচ্চ সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী মনে করে। আর আমাদের দেশে তো রীতিমত সেন্স অফ হিউমার নিয়ে কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবও প্রচলিত রয়েছে।

আমাদের দেশে টিভিতে 'সেন্স অফ হিউমার' নামে একটি অনুষ্ঠানও প্রচারিত হয় যেখানে আমরা দেখতে পাই উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয় সবাইকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মজা নিচ্ছেন। আসলে আমরা অনেকেও সেন্স অফ হিউমার বলতে অন্যকে খোঁচানো বা খোঁটা দেয়াকেই বুঝি। এছাড়া আরেকশ্রেণীর মানুষ আছে যারা কথায় কথায় একই জাতীয় বুলির পুনরাবৃত্তিকে সেন্স অফ হিউমার বলে মনে করে। যেমন আজকাল প্রতিনিয়ত আমরা শুনতে পাই, 'কী, হিংসে হয়?', 'গুজবে কান দেবেন না', 'আমি ঘুমে থাকি, আমার হিসাব থাকে না' জাতীয় কথাগুলো। এগুলোকেই আমরা সেন্স অফ হিউমারের দৃষ্টান্ত বলে মনে করি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, এগুলো কখনোই প্রকৃত সেন্স অফ হিউমারের দৃষ্টান্ত নয়। তাহলে সত্যিকারের সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী হয়ে উঠতে চাইলে আমাদের কী করতে হবে? এখন আপনাদের সেরকমই কিছু অব্যর্থ উপায় বাতলে দেব, যেগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করলে আপনাদের প্রকৃত সেন্স অফ হিউমারওয়ালা হয়ে ওঠা কেউ ঠেকাতে পারবে না। 

* অন্যকে নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়ে মজা করতে হবে * 

আমাদের মনে রাখতে হবে, অন্যকে ছোট করা বা তাকে নিয়ে মজা করা মোটেই সেন্স অফ হিউমারের বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং এর মাধ্যমে আমাদের মানসিক দৈন্যতাই প্রকাশ পায়। তাই নিজের রসবোধ জাহির করার জন্যও অনবরত কাউকে অপমান করে যাওয়া উচিৎ নয়। প্রায়শই আমরা দেখি, কোনো একটি গ্রুপে সবাই মিলে খালি একজনকেই খুঁচিয়ে যাচ্ছে, তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। এমনটা করা কখনোই উচিত নয়। এরচেয়ে নিজেদের সেন্স অফ হিউমার প্রদর্শনের জন্য আমরা অন্য আরেকটা পন্থা অবলম্বন করতে পারি, তা হলো নিজেকে নিয়ে মজা করা। মানুষকে হাসানোই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অন্য কাউকে বলির পাঠা কেন বানাব, তারচেয়ে নিজেকে নিয়ে মজা করাই তো ভালো।

অন্যকে নিয়ে মজা না করে নিজেদের নিয়ে মজা করা ভাল

নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারা কিন্তু সহজ কোনো কাজ নয়। এই কাজটি যদি কেউ ঠিকমত করতে পারে, তাহলে তার সেন্স অফ হিউমার নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশই থাকে না। নামিদামি স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানদের কমেডি শো-তে দেখবেন, তারা অন্যদের নিয়ে যতটা না মজা করে, তারচেয়ে নিজেদের নিয়ে মজা বেশি করে। ফলে তাদের কথায় মানুষ যেমন প্রাণখুলে হাসতে পারে, তেমনি কারও মনে আঘাত লাগার আশঙ্কাও থাকে না। 

নিজেকে নিয়ে মজা করার আরেকটি সুবিধা হলো, নিজেই যদি আমি নিজেকে নিয়ে ক্রমাগত মজা নিতে থাকি, তাহলে অন্য কেউ আর আমার মজা নিতে পারবে না। বিষয়টা দারুণ না? তবে একটি ব্যাপারে সচেতন থাকবেন যে সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে মজা করতে করতে না আবার নার্সিসিস্ট হয়ে যান। তখন কিন্তু আবার লোকে আপনাকে দেখেই দূরে পালাবে আর বলবে, "ওর কাছে যাওয়া যাবে না, ও সারাদিন কেবল নিজেকে নিয়েই বকবক করে!" 

* বেশি বেশি বই পড়া, মুভি-সিরিজ-কমেডি শো দেখা * 

সেন্স অফ হিউমার মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ঠিকই, কিন্তু এটিকে আরও বেশি শাণিত করার জন্য বেশি বেশি চর্চার প্রয়োজন। ঠিক যেমন পরীক্ষায় ভালো করতে বেশি বেশি পড়াশোনা করা প্রয়োজন। তো, সেন্স অফ হিউমারের উন্নতি ঘটাতে গেলে আমাদের বেশি বেশি বই পড়তে হবে। লেখকরা কোনো ঘটনাকে কীভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে, রমণীয়ভাবে উপস্থাপন করছেন সেদিকে খেয়াল করতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা সঠিক শব্দচয়নের মাধ্যমে কোনো হাস্যকর ঘটনার কথা ব্যক্ত করার শিক্ষাও লাভ করব।

এছাড়া মুভি বা সিরিজ দেখাও আমাদেরকে অনেক বেশি সাহায্য করবে কীভাবে ন্যাচারাল কনভার্সেশনের মাধ্যমে হাস্যরসের আদান-প্রদান করা যায় তা রপ্ত করতে। মুভি বা সিরিজের চরিত্ররা কিন্তু স্রেফ লোক হাসানোর জন্যই সংলাপ বলেন না। তারা সংলাপের মাধ্যমে একটি কাহিনীও এগিয়ে নিয়ে যান। ঠিক আমরাও যেমন দৈনন্দিন জীবনে যখন কারও সাথে কথা বলি বা আড্ডা দিই, তখন হাসানোটা আমাদের মূল লক্ষ্য থাকে না, মূল লক্ষ্য থাকে নিজেদের কথোপকথনকে এগিয়ে নেয়া। সেটি করার ফাঁকেও কীভাবে হাস্যরসের বিনিময় সম্ভব, সেটি আমরা শিখতে পারব মুভি-সিরিজ দেখে। 

আর কমেডি শো-গুলোতে যেহেতু একেবারে সচেতনভাবেই মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করা হয়, এখান থেকে আমরা শিখতে পারি সঠিক সময় পাঞ্চলাইন ডেলিভারি দেয়ার বিষয়টি। কারণ একটি জিনিস খেয়াল করুন, কমেডি শো যখন আমরা দেখতে বসি, আমরা কিন্তু আগে থেকেই জানি যে এখানে আমাদের হাসানোর চেষ্টা করা হবে। তবু সঠিক সময়ে কমেডিয়ানদের কমেডি ডেলিভারির ফলেই আমরা না চাইতেও হাসতে বাধ্য হই। এখানে টাইমিংটাই সবচেয়ে জরুরি। টাইমিং যদি ঠিক না থাকে, তাহলে খুব মজার কোনো কথা বললেও মানুষ সেটি শুনবে হাসবে না। তাই এই টাইমিং শেখার জন্য বেশি বেশি কমেডি শো দেখা, কমেডিয়ানদের বাচনভঙ্গি লক্ষ্য করা আর তাদের দেখে কোনো ঘটনা বা কাহিনী উপস্থাপনের কৌশল আয়ত্ত করার বিকল্প নেই।

টাইমলি কমেডি ডেলিভারি অত্যন্ত জরুরি বিষয়

* নিজে খুশি থাকা আর সুখী মানুষের সঙ্গে থাকা * 

মানুষকে হাসিয়ে তাদের মন ভালো করার আগে নিজের মনকে ভালো রাখা, স্বচ্ছ রাখা আর খুশি থাকা অনেক বেশি প্রয়োজন। আমি নিজেই যদি খুশি না থাকি, অবসাদে ভুগি, কথায় কথায় বিরক্তি প্রকাশ করি, তাহলে অন্যকে কী করে হাসাতে সক্ষম হবো? তাই অন্য আর সবকিছুর আগে নিজের খুশি থাকাটা আবশ্যক। এছাড়া মানুষের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো, সে খুব সহজেই প্রভাবিত হয়ে যায়। এই জিনিসটি আপনার আমার সবার মধ্যেই কিন্তু কমবেশি পাওয়া যাবে। 

যেমন মনে করুন আমরা কোনো একটি কাজ করতে যাচ্ছি। সকলে যদি সেই কাজে সমান উৎসাহী থাকে, তাহলে খুব সহজেই আমরা কাজটিতে হাত দিতে পারি, সফল হবো না ব্যর্থ হবো সে বিষয়ে খুব বেশি উৎকণ্ঠিত হই না। কিন্তু আমাদের সঙ্গী হিসেবে যদি একজন হতাশাবাদী মানুষ থাকে, তাহলে তার সংস্পর্শে এসে আমাদের মনের ভিতরও নেতিবাচকতা জাঁকিয়ে বসতে পারে। ঠিক একইভাবে আমরা যদি কোনো গোমড়ামুখো মানুষের সাথে চলি, তবে তার দেখাদেখি আমাদেরও মন খারাপ হয়ে যাবে। শত চেষ্টা করেও নিজেই প্রাণ খুলে হাসতে পারবো না, অন্যকে হাসানো তো পরের কথা। 

একটি গবেষণার ফল বলছে, প্রতিটি ব্যক্তির চরিত্র হলো তার সবচেয়ে কাছের পাঁচজন ব্যক্তির চরিত্রের গড় মানের সমান। তাহলে আমার সবচেয়ে কাছের পাঁচজন মানুষ যদি হাসিখুশি হয়, আমিও সেরকম হতে বাধ্য। অনুরূপভাবে আমাদের সবচেয়ে কাছের পাঁচজন মানুষ যদি গোমড়ামুখো হয়, তাহলে আমাদেরও একই রকম হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই কাছের মানুষ নির্বাচনে অনেক বেশি সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

উপরের নিয়মগুলো যদি মেনে চলা যায়, তাহলে খুব সহজেই সময়ের সাথে সাথে আমাদের সেন্স অফ হিউমারের উন্নতি ঘটবে। তবে একটি কথা আমাদের সকলেরই মনে রাখা দরকার যে, সেন্স অফ হিউমার হলো একটি গিভ অ্যান্ড টেকের বিষয়। সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী হওয়া মানেই যে আমি গোটা বিশ্বসংসারকে হাসানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফেলেছি, তা কিন্তু নয়। অন্যকে হাসানোর পাশি আমাদেরকেও অন্যদের কথায় হাসতে হবে, তাদের বলা হাস্যরসকে এপ্রিসিয়েট করতে হবে।

আমি নিজেই যদি কারও সামান্যতম রসিকতাকেও সিরিয়াসলি নিয়ে বসি, মাইন্ড করে বসি, তাহলে আমার কখনোই আশা করা উচিৎ হবে না যে অন্যরা আমার বলা রসিকতার যথার্থ মর্ম বুঝে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে। তাছাড়া সকলের সেন্স অফ হিউমার যেহেতু সমান না, তাই আমার বলা রসিকতায় কেউ যদি মজা না-ও পায়, সেটিকে আমার খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতায় গ্রহণ করতে হবে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা