সভ্য জাতি বলতে যা বুঝায়, জাতি হিসেবে আমরা বাঙ্গালিরা এখনো যে ঐ লেভেলে পৌঁছাইনি; এটি একটি অপ্রিয় সত্য। কিন্তু সভ্য হওয়ার জন্য আমরা নিজ থেকে চেষ্টা কতটুকই বা করেছি?

ফারহান রাকিব ইমনসেভডালিজা মানুষটির নাম খুব কমই শুনেছেন। না শুনারই কথা, কারণ তিনি কোনো সিনেমার হিরো-হিরোইন নন; আবার কোনো  আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিবিদও নন। সেভডালিজা হলেন একজন ইরানি বংশদ্ভূত ডাচ মিউজিশিয়ান ও ড্যান্স কোরিওগ্রাফার। আর লিঙ্গ হিসেবে বলতে গেলে তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ আমাদের প্রচলিত ভাষায় হিজড়া। 

ইরানে জন্ম হলেও ৫ বছর বয়সে বাবা-মা'র সাথে স্থায়ীভাবে নেদারল্যান্ডে চলে যান তিনি। সেখানেই কাটে তার বাকী শৈশব ও শিক্ষাজীবন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে কমিউনিকেশন সাবজেক্টের উপর তার একটি মাস্টার্স ডিগ্রী রয়েছে। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি   

অবাক হওয়ার কিছু নেই! তিনি বাবা-মায়ের সাথেই নেদারল্যান্ড গিয়েছেন, কারণ হিজড়াদেরকে সেখানকার সব মা-বাবারা হিজড়া পাড়ায় পাঠিয়ে দেয় না। তাদের ও বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট-ভিসা সবই হয়। আবার তাদেরও সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ পর্যন্ত সুযোগ আছে। অর্থাৎ, সাধারণ নাগরিক হিসেবে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বিবেচনা করার সব সুবিধাই নেদারল্যান্ডে আছে। 

সেভডালিজার প্রসঙ্গটি এসেছে কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি তার গান ও আর্কেস্ট্রা ডান্সের একজন ফ্যান। মূলত ডাচ ভাষাভাষী হলেও তিনি ইংরেজী গান করেন এবং একজন দারুণ পিয়ানো বাদকও বটে। ছবিতে দেয়া তার 'হিউম্যান' গানটির লিরিক্সে মারাত্মকভাবে তাদের করুণ আর্তনাদ ফুটে উঠেছে। তাই তা পড়ার ও বুঝার অনুরোধ রইলো। 

হিউম্যান গানের লিরিক্স 

আবার খুব অখ্যাত কেউ নন তিনি; মাত্র ৩২ বছর বয়স্ক এই শিল্পী ইতিমধ্যেই পেয়েছেন বেশ কিছু পুরষ্কার। ইউটিউব ভিত্তিক ডান্স ওয়ার্ল্ড এর অন্যতম জনপ্রিয় 'টিম মিলগ্রাম' চ্যানেলে তার 'হিউম্যান' গানটির ডান্স কাভারটিও মোস্ট ভিউড ভিডিওগুলোর একটি।

শুধুই সেভডালিজা নয়; সভ্য দেশগুলোতে তার মতো অন্যসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও কম-বেশি পড়াশুনা করে, চাকরি-ব্যবসা করে, রাজনীতি কিংবা সমাজসেবা করে, তাদের ভোটাধিকার রয়েছে, নিজেকে মেলে ধরে সমাজে প্রমাণ করে যে তারাও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। শুধু যেটা করতে পারে না তা হলো বিয়ে কিংবা বংশধর রেখে যাওয়া। 

মানুষকে সভ্য হওয়ার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে যত ধরনের সমাজ সংস্কার হয়েছে, তার বেশিরভাগই নানা ঝড়-ঝাপটার মধ্য দিয়েই করতে হয়েছে। মানুষের মাঝেও আনতে হয়েছে ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। আমাদের উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথা বিলোপ হয়েছে তো মাত্র দেড়শ বছর আগে। একটু চিন্তা করুন, একজন নিরপরাধী জীবন্ত নারীকে পুড়িয়ে মারা হতো সমাজে নিছক 'বেহায়াপনা' থেকে মুক্তি লাভের আশায়। স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের মতো মহান ব্যক্তিবর্গের নেতৃত্বে এমন নানা সমাজ সংস্কারমূলক কাজ না হলে; আরো অন্ধকার যুগে থেকে যেতো এই অঞ্চলের সমাজব্যবস্থা।

তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের দেশে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবটা দিনদিন কমলেও সুশিক্ষার অভাবটা এই সমাজের মানুষের কাছে আগের মতোই। এই তো মাত্র ক'বছর আগে উচ্চ আদালত হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়ায় অনেকের নিন্দার স্বীকার হতে হয়েছে। আর মাত্র ক'দিন আগে স্থানীয় উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ায় একশ্রেণীর কাছে তো আরো হাস্যরসের খোরাক হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের হাওয়াটা যে দলই করুক না কেন, আমি তাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাব। 

সেভডালিজা

আমাদের দেশে হিজড়াদের জীবন বলতে আমরা যা দেখি, সেটা হচ্ছে- এরা রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে পথচারী ও দোকানদার থেকে টাকা তোলে যা অনেকটা চাঁদাবাজির নামান্তর। এতে প্রায়শই সাধারণ মানুষ নানা  ভোগান্তির শিকার হয়। কিন্তু আবার তা না করে তারা বেঁচে থাকার জন্য করবেটা কী! খাদ্য কিংবা বস্ত্রের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য তো তাদেরও অর্থের প্রয়োজন হয়। তাদেরকে তো কেউ কোনো চাকরি কিংবা কাজে নেয় না। শৈশবে মা-বাবার আদর পাওয়া কিংবা পারিবারিক বন্ধন তো বাদই দিলাম। 

অথচ ওরাও কিন্ত রক্ত মাংসের মানুষ। ওদেরও আবেগ-অনুভূতি সবই আছে। শরীরে জ্বর আসলে তারাও কাঁপে, হাত-পা কেটে গেলে তাদেরও রক্ত ঝরে, চোখ থেকে পানিও ঝরে। কিন্তু তাদের নেই কোনো সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। আধুনিক হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসকরাও হিজড়াদের সেবা দিতে অপারগ। তাদের চিকিৎসা বলতে তাদের হিজড়া পাড়ায় নিজেদের প্রাথমিক চিকিৎসা যা পায়, ওইটুকুনই। অথচ এদেশে গরু-ছাগলের জন্যও ভেটেরিনারি চিকিৎসালয় রয়েছে। ধর্মকর্ম পালন কিংবা শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ তো অলীক কল্পনা তাদের। আর মৃত্যুর পর তাদের সৎকার বলতে যা হয় সেটা কেবল মাটিতে পুঁতে ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বালাই থাকে না সেখানে। 

এখনই সময়; রাষ্ট্রপক্ষের হস্তক্ষেপে তাদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার। তার আগে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে বদলানোটা আরও বেশি জরুরী। এদেশের লক্ষাধিক হিজড়াকে বোঝা না বানিয়ে রেখে তাদেরকে দিয়ে গার্মেন্টস থেকে শুরু করে নানা কাজে নিযুক্ত করানোটাও হবে সুবিবেচক সিদ্ধান্ত। 

একটু ভাবুন তারাও আপনার-আমার মতোই কোনো মায়ের গর্ভ থেকেই এসেছে; অন্য কোনো প্রাণীর নয়। হতে পারে আমি আপনিও কোনো এক হিজড়া মানুষের ভাই কিংবা বোন। এই ঘুণে ধরা সমাজের নিছক মর্যাদাহানীর ভয়ে সে ব্যাপারটি এড়িয়ে চলি। আর যে পরিবারে এমন সন্তানের জন্ম, তাদেরকে হেয় করার অসুস্থ চিন্তাভাবনা দূর করুন। আবার যে পরিবারে এমন সন্তানের জন্ম হয়, তাদেরও লজ্জিত হওয়ার কিছুই নেই। 

জাত-ধর্ম, ধন বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে আগে আমি একজন মানুষ; কেবল এইটুকুন ধারণা নিজের মধ্যে লালন করুন, তাহলে দেখবেন, ভাবনার সীমাবদ্ধতা কেটে গেছে। সমাজের অসংখ্য অমানুষের চাইতে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোকে বরং অনেক অনেক ভালো মনে হবে আপনার কাছে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা