হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের মতো একটা চমৎকার এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ যেখানে বন্ধ করে দেয়া হয়, সেখানে যদি আপনি দাবী করেন যে স্কুল-কলেজে সেক্স এডুকেশন বাধ্যতামূলক করা উচিত, তখন চারপাশে এমন একটা হুল্লোড় উঠবে, আপনার মনে হবে ভুলে বুঝি মৌমাছির চাকে ঢিল মেরে বসেছেন!
ঢাকার কলাবাগানে ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মোটামুটি উত্তাল। ভিক্টিম ব্লেমিং চলছে পুরোদমে, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত তরুণের প্রতি মায়ার ভাণ্ডার উজাড় করে এগিয়ে এসে তার পক্ষ নিচ্ছে অনেকেই। আসামী এবং ভিক্টিম দুজনই মিলেনিয়াম জেনারেশনের, এবং ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া হওয়ায় একটা অংশ আবার সামাজিক অবক্ষয়ের অভিযোগ তোলার চমৎকার সুযোগ পেয়ে গেছে। তাদের ভাষ্য হচ্ছে- পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অনুকরণ করে আমরা ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, মূল্যবোধ বিসর্জন দিচ্ছি, আমাদের উচিত আধুনিকতার নামে এমন অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা। কেউ কেউ তো সহশিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধের দাবী করছে, ছেলে-মেয়ে কীভাবে বন্ধু হয়, করোনার মধ্যে একটা ছেলের বাসায় কেন একটা মেয়ে গ্রুপস্টাডি করতে যাবে- প্রশ্নের কোন শেষ নেই।
আপনারা যারা বোকাচণ্ডীর মতো ধর্ষণ ঠেকাতে সহশিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ বা ছেলে-মেয়ের মেলামেশা বন্ধ করতে চাইছেন, তারা সম্ভবত টাইম পিরিয়ডটা ভুলে যাচ্ছেন বারবার। এটা ২০২১ সাল, এই যুগে যে এরকম কথা কতটা অবাস্তব এবং বাস্তবতাবিবর্জিত শোনায়, সেটা আপনারা হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না, পারলে এসব কুযুক্তি মুখে আনতেন না।
এখানে আলোচনা হবার কথা ছিল সেক্স এডুকেশন নিয়ে। কারন নিহতের ময়নাতদন্ত করেছেন যে চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেছেন, বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণ যৌনাচারের শিকার হয়েছিলেন সেই কিশোরী। একারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে তার মৃত্যু হয়। পরিপূর্ণ যৌন শিক্ষা না থাকলে তরুণ-তরুণীরা কি ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হতে পারে, সেটার একটা ভয়াবহ নিদর্শন হয়ে থাকার কথা ছিল এই ঘটনাটার। দাবী ওঠার কথা ছিল নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই স্কুলের পাঠ্যসূচীতে যৌনশিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার। কিন্ত বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?
এই দেশের শতকরা আশিজন পুরুষ বিশ্বাস করে, ধর্ষণ আসলে নারীদের দোষেই হয়। নারীরা ঘরের বাইরে বের না হলে, 'অশ্লীল' পোশাক পরে পুরুষকে প্রলুব্ধ না করলে, দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা পর্দার নিচে ঢাকা থাকলে যে ধর্ষণের সংখ্যা শূন্যে নেমে যাবে- এই থিওরিতে বিশ্বাসী মানুষ কোটি কোটি আছে এদেশে। এদেরকে যদি আপনি বলেন যে, পুরুষেরা ঘরের বাইরে বের না হলে, নিজের চক্ষুকে সংযত করলে, কামলিপ্সাকে নিয়ন্ত্রণ করলেও তো ধর্ষণের হার শূন্যে নেমে আসার কথা- তখন এরা মুখ বেজার করে ফেলবে।
আপনি যদি এদের জিজ্ঞেস করেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা তো কাউকে প্রলুব্ধ করে না, তারা কেন শিক্ষকদের হাতে বলাৎকারের শিকার হয়? সারাজীবন সমকামিতার কঠোর বিরোধিতা করে আসা 'ফেসবুক মুমিনেরা' তখন পায়ুযোদ্ধাদের ডিফেন্ড করার জন্য বখাট্য সব যুক্তির ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হয়ে যাবে, আকাশ সংস্কৃতি থেকে ইউরোপ-আমেরিকার লাইফস্টাইল, সানি লিওন থেকে পরিমণি সবাইকে দায়ী করবে, তারপর যুক্তিতে না পেরে শেষমেশ ফতোয়া দিয়ে যাবে যে- একজন মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানের দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা ঠিক না।
এই দেশে বসে আপনি যদি দাবী করেন যে স্কুল-কলেজে সেক্স এডুকেশন বাধ্যতামূলক করা উচিত, তখন চারপাশে এমন একটা হুল্লোড় উঠবে, আপনার মনে হবে ভুলে বুঝি মৌমাছির চাকে ঢিল মেরে বসেছেন! যৌনতাকে এখানে ট্যাবু বানিয়ে রাখা হয়েছে, এদেশে কিশোর-কিশোরীদের যৌনতার হাতেখড়ি হয় বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনে, চটি গল্প পড়ে, নয়তো পর্ন ভিডিও দেখে। তাই কোনটা দর্শক আকর্ষণের জন্য বানানো ফ্যান্টাসি ভিডিও, আর কোনটা লাভ মেকিং- সেটা অনেকেই বুঝতে পারে না। আর সেই অজ্ঞতা থেকেই ঘটে দুর্ঘটনা।
২০২১ সালে দাঁড়িয়ে আপনি দ্বার বন্ধ করে ভ্রমকে রুখতে পারবেন না, সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যেটা পারবেন, সেটা হচ্ছে সচেতনতা তৈরি করা। এদেশের কয়েকটা জেনারেশন বেড়ে উঠেছে যৌনতা সম্পর্কে ভীষণ ভ্রান্ত এবং মনগড়া কিছু ধারণা নিয়ে। সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করা সম্ভব যৌনশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে; স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, সব জায়গায়। কিন্ত এই কাজটা করতে গেলে যে পরিমাণ বাধার মুখে পড়তে হবে, সেটা অকল্পনীয়। কারণ পাঠ্যবইয়ে 'সেক্স' এর কথা থাকবে- সেটা শুনলেই তো মাথা খারাপ হয়ে যাবে একদল লোকের। সেক্স আর সেক্স এডুকেশন যে আলাদা জিনিস, সেটাই বোঝানো যাবে না এদের।
হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের মতো একটা চমৎকার এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য করা হয়েছে এখানে। পাঠ্যপুস্তক থেকে অনেক কবি-সাহিত্যিকের চমৎকার সব গল্প-কবিতা সরিয়ে নেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র লেখকের ধর্মপরিচয় বা লেখার বিষয়বস্তুর কারণে। সেসব লেখায় প্রগতিশীলতার কথা ছিল, নারীর অধিকারের কথা ছিল। সেটাই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মানতে পারেনি। এমনকি পাঠ্যবইয়ে বাচ্চা মেয়েদের ছবি থাকলেও এদের সমস্যা হয়। তাই যৌনশিক্ষা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলেই এরা রাজপথে নেমে যাবে, এটা চোখ বন্ধ করেও বলে দেয়া যায়।
আগেই বলে দিয়েছি, এই কথাগুলো শুনতে ভালো লাগবে না। আমরা বরাবরই অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাতামাতি করতে পছন্দ করি। 'কি ঘটেছে'- সেটা নিয়ে আমাদের যত মাথাব্যথা, 'কেন ঘটেছে' আর 'কী করলে ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটবে না'- এই দুটো ব্যাপার নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা থাকে না। সমস্যা নিয়ে আমরা যতটা চিন্তিত হই, সেটার সমাধান নিয়ে সেভাবে চিন্তা করি না। একটু তলিয়ে ভাবার অভ্যাস আমাদের নেই। এই ২০২১ সালে এসে আপনি আইন করে হয়তো দশ পার্সেন্ট অপরাধ কমাতে পারবেন। কিন্ত এখন থেকে সচেতনতা তৈরি করলে দশ বছর পরে গিয়ে দেখব্রন এই অপরাধের পরিমাণটাই অর্ধেকে নেমে এসেছে। কিন্ত সেই পুরনো প্রশ্নটাই আবার করি- বেড়ালের গলায় ঘন্টিটা বাঁধার সাহস আছে কার?