প্রাপ্তবয়স্ক দুজন মানুষের ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে নোংরামি না করলে হতো না?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভালোবাসাবাসির ছবি নিয়ে নোংরামিতে মত্ত হতে গিয়ে আপনাদের মুখ থেকে প্রগতিশীলতার মিথ্যে মুখোশটা যে খসে পড়ে গেছে, সেটা কি টের পাচ্ছেন? এই মুখে মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা কিংবা নারীর অধিকার নিয়ে বুলি শুনলেও আমাদের এখন থেকে বমি আসবে...
একটা ছবি নিয়ে অনলাইনে নোংরামি করার খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে কিছু মানুষ নেমেছে রাস্তায়, শাহবাগ সহ দেশের নানা জায়গায় ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলছে। সিলেটের এমসি কলেজ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পরপর দুটো ন্যাক্কারজনক ধর্ষণের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে দেশ। ফেসবুকে সমালোচনা না করে কিছু ছেলেমেয়ে নেমে গেছে রাস্তায়, সামনের কাতারে আছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো। আর সেই আন্দোলনকে যতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব, সেটা করার চেষ্টা করছে কিছু মানুষ।
ফটো এডিট করে আন্দোলনকারীদের প্ল্যাকার্ডে প্রধানমন্ত্রীর নামে বাজে ভাষা ব্যবহার করে ফেসবুকে গুজব রটানো হচ্ছে, গণজমায়েতে আসা এক প্রেমিক জুটির ভিডিও ভাইরাল করে নোংরামির মহোৎসবে মেতে উঠেছে একটা পক্ষ। এরা আবার নিজেদের 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি', এবং 'প্রগতিশীল' হিসেবে দাবী করে। অথচ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ঠেকানোর জন্য তারা তৎপর। প্রগতিশীলতার এই নতুন সংজ্ঞা তাদের কে শিখিয়েছে, সেটা তারাই ভালো জানেন!
ধর্ষণবিরোধী সবচেয়ে বড় জমায়েতটা হচ্ছে ঢাকার শাহবাগে, সাত বছর আগে যেখানে রাজাকারদের বিচারের দাবীতে প্রজন্ম চত্বর গড়ে উঠেছিল। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের জন্যেও সেই আন্দোলনের আঁতুড়ঘরকেই বেছে নিয়েছে আন্দোলনকারীরা। সেখানেই এই গণজমায়েতের অংশ হতে এসেছিলেন দুই তরুণ-তরুণী। তারা পরস্পরকে ভালোবাসেন, ভালোবেসেই একে অন্যের কাঁধে হাত রেখেছেন, জড়িয়ে ধরেছেন, কপালে এঁকে দিয়েছেন ভালোবাসার স্পর্শ। আর সেটা দেখেই বিরোধীতার ইস্যু পেয়ে গেছে একটা দল, আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্যে তারা উঠেপড়ে লেগেছে, ঠিক যেমন ধর্ষণের ঘটনার পরে নারীর পোশাকের দোহাই দিয়ে ভিক্টিমের চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু করে প্রতিক্রিয়াশীলরা।
জীবন আহমেদের তোলা একটা ছবির কথা মনে পড়ে গেল এই ইস্যুতে। টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে বৃষ্টিভেজা অবস্থায় চুম্বনরত এক যুগলের ছবি তুলেছিলেন এই ফটোগ্রাফার। সেই ছবি ফেসবুকে আসামাত্রই প্রতিক্রিয়াশীলরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের মোক্ষম অস্ত্র গালাগালি নিয়ে। সমাজ-সংস্কৃতি-দেশ সব উচ্ছনে গেল রব তুলেছিল তারা। তাদের মস্তিস্কে এই জিনিসটা কেউ ঢোকাতে পারেনি যে, পরস্পরের সম্মতিতে একজন পুরুষ এবং নারী একে অপরকে স্পর্শ করলে সেটা বাংলাদেশের আইনে কোনভাবেই অপরাধ নয়।
আমাদের আশেপাশে থাকা তথাকথিত প্রগতিশীল লোকজনও এখন প্রতিক্রিয়াশীলদের মতোই আচরণ করছেন। শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে আসা ছেলে-মেয়ে দুটো একে অপরকে ভালোবাসে, পরস্পরের সম্মতিতে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরবে নাকি চুমু খাবে, সেটা দেখার দায়িত্ব কেউ কারো ঘাড়ে চাপায়নি। পাবলিক প্লেসে দুটো ছেলে-মেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতেই পারে, কাঁধে হাত রাখতে পারে, চুমুও খেতে পারে। এর কোনোটাই অপরাধ নয়। অপরাধ হচ্ছে তাদেরকে না জানিয়ে গোপনে তাদের ভিডিও ধারণ করা, রগরগে ক্যাপশন দিয়ে সেই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করে বেড়ানো।
মুক্তিযুদ্ধ, নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার নিয়ে নিউজফিড গরম করে রাখা প্রগতিশীলদের একটা অংশ সেই অপরাধটাই করছে। কারন এই আন্দোলনে ক্ষমতাসীন দলের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অজস্র অভিযোগ, সেসবের বিচার চাওয়া হয়েছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবী করা হয়েছে। আর তাতেই প্রগতিশীলতার ঠুনকো মুখোশটা খসে পড়েছে অনেকের মুখ থেকে। তারা এখন প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়েও জঘন্য আচরণ করতে শুরু করেছেন!
কোনটা সম্মতির স্পর্শ, ভালোবাসার স্পর্শ, আর কোনটা জবরদস্তি বা হ্যারাসমেন্ট, সেটা অনেকেই বুঝবে না, ওইটুকু মগজ অনেককেই দেয়নি প্রকৃতি। এই বোধশক্তিটা না থাকাটা অপরাধ নয়। কিন্ত খারাপ লাগে তাদের জন্য, যারা তফাৎটা বোঝার পরেও শুধুমাত্র একটা আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, আন্দোলনকারীরা তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে প্রগতিশীলতার চাদর গায়ে জড়িয়ে নোংরামিতে মত্ত হয়। কতগুলো ছেলেমেয়ে পুলিশের মার খেয়ে ধর্ষকের বিচারের দাবীতে রাস্তায় নেমেছে। সাপোর্ট দিতে না পারেন, সমস্যা নেই, এসির হাওয়ায় বসে তাদের নিয়ে এমন নোংরামিতে মেতে ওঠাটা কি খুব জরুরী?
দলের কাছে মগজ বর্গা দিয়ে রাখলে প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীলে কোন তফাৎ থাকে না আসলে, সেটাই প্রমাণ হলো আরও একবার। আন্দোলনকারীদের কোন ভুল থাকলে সেটা নিয়ে সমালোচনা একশোবার হোক, কিন্ত নোংরামি কেন করতে হবে? কেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে একটা গণ আন্দোলনকে অকারনে প্রশ্নবিদ্ধ করার নিকৃষ্ট চেষ্টায় মত্ত হতে হবে? কে জানে, এদের কাছে হয়তো 'কনসেন্ট' সহকারে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর একে অন্যকে স্পর্শ করাটাই নোংরামি, জোর-জবরদস্তি করে কাউকে ধর্ষণ করাটাই বরং স্বাভাবিক ব্যাপার!
এই লোকগুলো হেলাল হাফিজের কবিতা হয়তো পড়েছে, কিন্ত অন্তর্নিহিত অর্থটা অনুধাবন করতে পারেনি কখনও। হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন- ‘মিছিলেও প্রেম হোক, ভেঙে যাক মোহ, তুমি সাজো ব্যারিকেড, আমি বিদ্রোহ’। এরা জানে না, প্রতিটা দ্রোহে, প্রতিটা প্রতিবাদে প্রেম থাকে। প্রতিটা বিপ্লবে পেছন থেকে শক্তি যোগায় ভালোবাসা। যে ভালোবাসতে জানে না, সে বিপ্লবও করতে জানে না, অন্যায়ের প্রতিবাদও তাকে দিয়ে হয় না। প্রেম কি শুধু রমনা পার্ক আর টিএসসিতে থাকার জিনিস? আন্দোলনে, সংগ্রামে প্রেম থাকতে পারবে না- এরকম কোন রুল কি হাইকোর্ট থেকে জারী করা হয়েছে?
দুটো প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ভালোবাসাবাসির ছবি নিয়ে নোংরামিতে মত্ত হতে গিয়ে আপনাদের মুখ থেকে প্রগতিশীলতার মিথ্যে মুখোশটা যে খসে পড়ে গেছে, সেটা কি টের পাচ্ছেন? এই মুখে এরপরে মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা কিংবা নারীর অধিকার নিয়ে ফাঁকা বুলিগুলো শুনলে আমাদের এখন থেকে বমি আসবে, বলে রাখলাম। তরুণ-তরুণীর স্বাভাবিক সম্পর্ক যাদের চোখে অস্বাভাবিক হয়ে ধরা দেয়, তারা আর যাই হোক, প্রগতিশীল হতে পারে না। তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথাও শোভা পায় না...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন