যে ইউরোপে চলছে তীব্র ইসলামোফোবিয়া, বাড়ছে মুসলিম-বিদ্বেষ, সেই ইউরোপেই এক মুসলিম দম্পতি লড়ে যাচ্ছেন করোনার ভ্যাক্সিন আবিস্কার করে মানুষকে বাঁচানোর জন্যে। ৩য় ধাপের পরীক্ষায় তাদের আবিস্কৃত টিকা ইতিমধ্যেই ৯০% কার্যকারিতা দেখিয়েছে...

বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকদিন অনেককিছু হচ্ছে। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে তুচ্ছ কারণে আক্রমণ করছে। মানুষ মরছে খোলামকুচির মতন। চুন থেকে পান খসলেই হচ্ছে তীব্র সংঘর্ষ। ফ্রান্সে সহিংসতা হচ্ছে। মুসলমানরা ভারতে মরছে। বাংলাদেশে তারাই আবার মারছে। এমন কোনো দিন যাচ্ছেনা, ধর্মীয় উগ্রবাদের দুই একটা ঘটনা আমরা পাচ্ছি না। আমরা না চাইতেও অথবা আমাদের অজ্ঞাতেই আমাদের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম। এক অদ্ভুত বিশালাকার জীব হয়ে সে গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষকে। পান থেকে চুন খসলেই খসে যাচ্ছে আমাদের মুখোশ। আমরা হয়ে উঠছি আমাদের মানসিকতার নগ্ন চেহারা। এভাবেই চলছে।

হঠাৎ করে ধর্ম নিয়ে এত কথা বলছি কেন? কারণ আছে। জার্মানিতে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছেন জার্মান প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক ও মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফাইজার। এটা অনেকেই জানেন। তাদের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা করোনাভাইরাসের এ টিকা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে, এটাও বাসী খবর। আমাদের মূল খবরও এটা না। যেটা গুরুত্বপূর্ণ খবর, তা হচ্ছে, জার্মান প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের প্রতিষ্ঠাতা দুইজন ইসলাম ধর্মের মানুষ! তারা সেই ইউরোপে বসে মানুষকে বাঁচানোর টিকা আবিষ্কার করছেন, যে ইউরোপের মানুষজনই তীব্র ইসলামোফোবিয়ায় ভুগছেন। যে ইউরোপেই ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ নবীকে নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হয়েছে। যে ইউরোপের নাগরিকদের কেউ কেউ  এই ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের দেখে শিউরে উঠেছেন। সেরকম এক সময়ে দাঁড়িয়ে এই দুইজন মানুষের কর্মকাণ্ড যেন প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমের মধ্যে একপশলা বরফকুচি দমকা বাতাস। হুমায়ুন আহমেদ যাকে বলতেন, লিলুয়া বাতাস।

উগুর শাহিনের জন্ম তুরস্কে হলেও বাবা-মা'র সাথে সে খুব ছোটবেলাতেই চলে আসেন জার্মানিতে। এখানে এসে মেডিসিন ও গনিত নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাহিন এরপর চিকিৎসক হিসেবে কাজও করেছেন কোলোন এ। কাজ করেছেন হামবুর্গেও।  এরপর তিনি যুক্ত হন জারল্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে। সেখানে তিনি মলিকিউলার মেডিসিন এবং ইমিউনোলজি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কারের জন্যে তিনি কাজ করতেন এখানে। ওদিকে ওজলেম টুরেসির জন্ম জার্মানিতে। যদিও তার বাবা-মাও তুর্কি। টুরেসি'র পড়াশোনা হামবুর্গে। সেখানেই চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তিনিও ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্যে কাজ করতেন। কাজের সূত্রেই একসময়ে দেখা হয় শাহিনের সাথে টুরেসির। এরপর বিয়ে। এরপর ২০০৮ সালের দিকে এসে বায়োএনটেক প্রতিষ্ঠা করেন তারা। ক্যান্সারের ওষুধের আবিষ্কার করার জন্যে গবেষণা চলতো এখানে। শুরুর পর থেকেই।

এই বায়োএনটেকেই করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছেন এই মুসলিম দম্পতি! 

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার পরে শাহিন ও টুরেসি কোভিড-১৯ এর টিকা বানানোতে মনোযোগী হন। এখন পর্যন্ত তাদের বানানো টিকার ট্রায়ালে অংশ নিয়েছে প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার মানুষ! যেখানে ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে এসে তাদের সফলতা নব্বই শতাংশেরও বেশি!  এরইমধ্যে ফাইজার ও বায়োএনটেক, আমেরিকাতে টিকা সরবরাহের জন্যে ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থের চুক্তি করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপানের সাথেও চুক্তি সই হয়েছে। আস্তে আস্তে বায়োএনটিকের টিকাতে আগ্রহী হচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত। এভাবেই দুইজন মুসলিম মানুষ হয়ে যাচ্ছেন মানুষ বাঁচানোর কান্ডারী।

গতকাল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পরে একটা জাতীয় দৈনিকের ফেসবুক পেইজের সেই মৃত্যুসংবাদের নীচে একজন মন্তব্য করলেন, পার্মানেন্ট জাহান্নাম সিওর হয়ে গেলো এই লোকের। আমি অবাক হলাম না। আমরা আজকাল এতই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়েছি, এতটাই বিচক্ষণ হয়েছি, ঘরে বসেই আজকাল মানুষের জান্নাত-জাহান্নাম নির্ধারণ করে দিচ্ছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছি, তিন বেলা মন্দিরে গিয়ে পূজা করছি আর বাইরে এসে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছি। মানুষ মারছি। রক্তে হাত লাল করছি। আবার সেই একই পৃথিবীতে এই দুইজন মানুষ, মানুষকে বাঁচানোর জন্যে লড়াই করে যাচ্ছেন।

কে বেশি ধার্মিক? কে আসলে ধর্মকে ঠিকঠাক বোঝে? কে আসলে নিজ ধর্মকে ভালোবাসে? ধর্মের প্রকৃত সম্মান আসলে কার উপরে ন্যস্ত? উত্তর জানেন কী? উত্তর জানেন কেউ?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা