জেসিন্ডা আরদার্ন মুসলমানদের পাশে দাঁড়ালে তার দিকে কেউ আঙুল তোলে না, বরং বাহবা দেয়। ট্রুডো যখন তার দেশের মুসলমানদের সঙ্গে ইফতার করেন, কেউ বলে না যে জাস্টিন ট্রুডো তো ধর্ম পাল্টে জসিম ট্রুডো হয়ে গেছে! অথচ সাকিবের নামে পূজা উদ্বোধনের গুজব শুনেই বাঙালি ধর্মান্ধরা তাকে 'শ্রী' সাকিব আল হাসান বানিয়ে দিয়েছে...

ঘটনা এক

২০১৮ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের এক মসজিদে ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামের খ্রিস্টান এক উগ্রপন্থী যুবক বন্দুক হাতে হামলা চালিয়েছিল, পাখির মতো গুলি করে অন্তত পঞ্চাশজন মুসলিমকে হত্যা করেছিল সে। হত্যাকান্ডের পুরোটা সময় সে লাইভ সম্প্রচার করেছিল ঘটনাটা। নিউজিল্যান্ডের মানুষ শান্তিপ্রিয়, তারা এমন ঘটনার সাক্ষী কখনও হয়নি, তাই পুরো দেশ আঁতকে উঠেছিল এই বর্বরতায়। 

প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পরপরই সেদেশের সরকার সক্রিয় হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে হামলাকারী ব্রেন্টন। নিউজিল্যান্ডের সংসদে দাঁড়িয়ে সেই হত্যাকারীকে জঙ্গী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরদার্ন, অঙ্গীকার করেছিলেন, মুসলমানদের পাশে থাকার। সেদিন ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'আমরা' এবং 'তারা' বলে কোন কথা নেই, সবাইকে নিয়েই আমরা একতাবদ্ধ। 

জেসিন্ডা আরদার্ন

পরবর্তী দিনগুলোতে জেসিন্ডা নিজের কথাকে কাজে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। মাথায় কাপড় দিয়ে মুসলিম রীতি মেনে তিনি নিহতদের শোকসভায় গিয়েছেন, স্বজনহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে জড়িয়ে ধরেছেন পরম মমতায়। তার দেশের কেউ তাকে তখন 'মোছাম্মৎ জেবুন্নেসা' নামে সম্বোধন করেনি, বলেনি যে, মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে জেসিন্ডা নিজের ধর্ম বিসর্জন দিচ্ছেন। 

ঘটনা দুই

জাস্টিন ট্রুডো, কানাডার প্রেসিডেন্ট। মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। সব ধর্মের, সব মতের মানুষের কাছেই তার দারুণ জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা। নিজে খ্রিস্টান হলেও, প্রতি রমজানেই তিনি কানাডার মুসলিম সোসাইটির সাথে একদিন বসে ইফতার করেন। ঈদের শুভেচ্ছা জানান টুইটার-ফেসবুকে। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দিপাবলীর উৎসবেও তিনি তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, শিখদের ধর্মীয় উৎসবেও তিনি হাজির হন। এমনকি সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর সঙ্গেও তিনি বসেন, তাদের খোঁজখবর নেন। কারন তিনি নিজের দেশের হিন্দু-মুসলিম-স্ট্রেইট-গে-লেসবিয়ান সবার প্রেসিডেন্ট। 

মুসলিম প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডো

ট্রুডো যখন বছরে একটা দিন উপোস থেকে তার দেশের মুসলিম কমিউনিটির একটা অংশের সঙ্গে মসজিদের ভেতরে বসে ইফতার করেন, কখনও তাকে পাজামা-পাঞ্জাবিতেও দেখা যায়- তখন কানাডায় কাউকে বলতে শোনা যায় না যে, এই ট্রুডোর মুসলমানদের প্রতি এত দরদ কেন? কিংবা কেউ কটাক্ষ করেন না এই বলে যে, জাস্টিন ট্রুডো তো ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে গেছে, তার নতুন নাম জসিম ট্রুডো! কানাডার মানুষ শিক্ষিত, বিবেকবোধ সম্পন্ন, তারা জানেন, নিজেদের নোংরা নাকটা সব জায়গায় গলাতে হয় না, সবকিছু নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে হয় না। 

ঘটনা তিন

সাকিব আল হাসান কলকাতায় গিয়ে পূজা উদ্বোধন করেছেন- এরকম একটা খবর ছড়িয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। নামাজের ধারেকাছে না থাকা, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে আবার পানি ব্যবহার না করা, মেয়ে দেখলেই ইভটিজিং করা, ধর্ষণের পেছনে পোশাককে দায়ী করা, অন্যের হক মেরে খাওয়া আর ফেসবুকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়াবাজি করা একটা দল লেগে গেছে তার পেছনে। অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করা হয়েছে, তার নামের আগে 'শ্রী' শব্দটা যুক্ত করে তাকে হিন্দু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কলকাতায় পূজা উদ্বোধন করে শ্রী সাকিব আল হাসান হিন্দু হয়েছেন- এই ছিল তাদের ভাষ্য। 

এটুকু হলেও মেনে নেয়া যেত, এরপরে যেটা হয়েছে, সেটা আরও ভয়ানক। সিলেটের মহসিন তালুকদার নামের এক লোক ফেসবুকে লাইভে এসে সাকিবকে বাবা-মা তুলে গালাগালি করেছেন, রামদা উঁচিয়ে তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন, কারন সাকিব নাকি পূজা উদ্বোধন করতে গিয়ে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেছেন! মহসিন তালুকদারের প্রোফাইলে গেলে দেখা যাবে, তিনি মহানবীকে নিয়ে কার্টুন আঁকায় ফ্রান্স বয়কটের ডাক দিয়েছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে 'জিহাদ' ঘোষণা করেছেন। নিজেকে নবীর উম্মত দাবী করে কেউ যদি এরকম হিংসাত্মক কাজে জড়িত হয়, বিনা অপরাধেই কাউকে এভাবে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়ে বেড়ায়, তাহলে সবচেয়ে বড় অপমান যে নবীরই হয়- সেটা বোঝার সাধ্য এই ধর্মান্ধ মাথামোটাদের নেই। 

র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে মহসিন তালুকদার

মহসিন তালুকদারকে সমর্থন দেয়ার মতো লোক কিন্ত কম ছিল না। অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছেন, খুনের হুমকি দেয়াটা ঠিক হয়নি, কিন্ত সাকিবও কাজটা ঠিক করেননি... অথচ গতকাল রাতে ভিডিওবার্তায় সাকিব জানিয়েছেন, পূজা উদ্বোধনের মতো কোন কাজে তিনি ছিলেনই না। চিলে কান নিয়েছে শুনেই সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি সাকিবের পেছনে লেগে গেছে, প্রতিবারই যেটা হয় আরকি। কোন দোষ না করেও সাকিব ক্ষমা চেয়েছেন, কারন তাকে তো পরিবার নিয়ে এদেশেই থাকতে হবে, দুটো কন্যা সন্তানের বাবা তিনি, নিজের কথা না ভাবলেও, মেয়েদের নিরাপত্তার কথা তাকে ভাবতেই হবে। 

এই হচ্ছে আমাদের হিপোক্রেসির লেভেল। জেসিন্ডা যখন মুসলমানদের জড়িয়ে ধরেন, নিহতদের স্মরণে মোনাজাতে হাত মেলান, তখন তার ধর্ম যায় না, তাকে আমরা বাহবা দেই, নিজেদের একজন ভাবি। জাস্টিন ট্রুডোকে কানাডার মুসলমানদের সঙ্গে ইফতার করতে দেখে আবেগে আমাদের অর্গাজম হয়ে যায়। অথচ 'সাকিব পূজা উদ্বোধন করেছেন'- এমন গুজবেই আমাদের জিহাদি জোশ জেগে ওঠে, ধর্মের নামে নোংরামির মহোৎসবে মেতে উঠতে আমরা একটুও দ্বিধা করি না। ধর্ম যে সহিষ্ণুতার কথা বলে, শান্তির কথা বলে, সেটা আমরা ভুলে যাই। 

নিজেকে খাঁটি মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সাকিবের মতো একজন ইন্টারন্যাশনাল সুপারস্টারকে ভিডিওবার্তা প্রকাশ করতে হচ্ছে, একজন বাংলাদেশী হিসেবে এটা যে কতটা লজ্জার, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। শুধু মনে করিয়ে দেই, এভাবে মুসলমানের নামের আগে 'শ্রী' পদবী ব্যবহার করতো পাকিস্তানীরা, এবং তাদের দোসর রাজাকারেরা। রাজাকার গোলাম আজম বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে লিখেছিলেন- “বাংলাদেশ বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হবে এই মতবাদ শ্রী তাজউদ্দিনের (দৈনিক সংগ্রাম ৮ মে, ১৯৭১)।” পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে হেলিকপ্টারে করে লিফলেট ছড়াতো- “শ্রী তাজউদ্দিন হিন্দু্‌স্থানে গিয়া হিন্দু হইয়াছেন…” 

মুসলমানের নামের আগে 'শ্রী' যোগ করে তাকে জোর করে যারা হিন্দু বানানোর চেষ্টা করে, তারা কাদের বংশধর, সেটা বুঝে নিতে একটুও কষ্ট হয় না আমাদের...

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা