আপনি জানেন না সাকিব, আজ আপনার এই ক্ষমা চাওয়ার ঘটনায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কতটা আশকারা পাবে। একঝাঁক অমেরুদণ্ডী ব্যাকটেরিয়ার উৎপাতে বিরক্ত বা বিব্রত হয়ে নিজের দুর্বিনীত সাহস, আর ড্যাম কেয়ার ইমেজটা বিসর্জন দেয়ার কোন দরকার ছিল না...

প্রিয় সাকিব আল হাসান, আপনার নগন্য একজন ভক্ত বলছি। আপনার ক্রিকেটীয় প্রতিভার জন্যে আপনাকে আমি ভালোবাসিনি সাকিব, আপনাকে ভালোবেসেছি আপনার ঘাড়ত্যাড়া মানসিকতার জন্য, 'আই ডোন্ট কেয়ার' টাইপের পার্সোনালিটিটার জন্য। আপনি দেশের ক্রিকেটের প্রথম ইন্টারন্যাশনাল সুপারস্টার, দলকে অনেক কিছু দিয়েছেন, শত শত রেকর্ড আপনার পায়ে লুটায়- বিশ্বাস করুন, এগুলো বড় বিষয় ছিল না আমার কাছে, বড় ব্যাপার ছিল দিন দুনিয়ার কাউকে পাত্তা না দেয়ার যে মেন্টালিটি নিয়ে আপনি চলেন, সেটা।

আজ আপনি সেই সাহস, সেই ড্যাম কেয়ার মুডটা বিসর্জন দিলেন, প্রমাণ করলেন, আমাদের মতো আপনিও ভেঙে পড়েন, চাপের মুখে আপোষ করতে বাধ্য হন। যে কাজ আপনি করেননি, সেটার জন্য ক্ষমা চাইলেন, ভবিষ্যতে কখনও করবেন না বলেও ওয়াদা করলেন। কলকাতায় পূজা উদ্বোধনের কাজটা যদি আপনি করেও থাকতেন, তবুও সেটা ক্ষমা চাওয়ার মতো কোন অপরাধ ছিল না। এটা কোন অপরাধের কাতারেই পড়ে না, আপনি একজন সুপারস্টার, একজন তারকা, আপনি পূজার উদ্বোধন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর কাজে যুক্ত হতেই পারেন। অথচ নিজের যুক্তিতে অনড় থাকার পরিবর্তে আপনি আজ ভিডিওবার্তা দিয়ে ক্ষমা চাইলেন, বুঝিয়ে দিলেন, এই দেশে থাকতে হলে ধর্মান্ধদের সঙ্গে আপোষ করেই থাকতে হবে, এই শর্ত সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

সাকিব, আপনি কত রান করলেন, কয়টা উইকেট তুলে নিলেন, সেটার চেয়ে বেশি আমি দেখি আপনার মধ্যে থাকা হার না মানার তেজটাকে। সেঞ্চুরীর পরে আপনি যখন ব্যাট তোলেন, কিংবা উইকেট শিকারের পরে আনন্দে মাতোয়ারা হন, সেই দৃশ্যটা খুব সুন্দর। কিন্ত তারচেয়েও সুন্দর কি জানেন সাকিব? আপনি যখন ওয়াহাব রিয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে আঙুল তুলে কথা বলেন, সেটা। আপনি যখন শ্রীলঙ্কায় আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্ব দেখে দলের ব্যাটসম্যানদের মাঠ ছেড়ে উঠে আসার ইঙ্গিত দেন, সেই দৃশ্যটা। আপনার উদ্ধ্বত মূর্তি, আপনার দুর্বিনীত সাহস- এরচেয়ে সুন্দর আর কিছুই নেই।

এই যে ভিডিওতে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে কথা বললেন আপনি, জানালেন পূজা উদ্বোধন করতে যাননি, কখনও যাবেনও না, এগুলো বলে কার মন জয় করতে চাইলেন বলুন তো সাকিব? যে লোকগুলো গত এক দশক ধরে উঠতে বসতে আপনাকে আর আপনার পরিবারের সদস্যদের গালাগালি করেছে, তাদের? যারা আপনার বাচ্চা মেয়েটাকে পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলেনি, তাদের কাছে আপনি সারাজীবনই অপরাধী সাকিব, কোনকিছু না করলেও তারা আপনার দোষ খুঁজবে, আপনাকে গালি দেবে, মন্দ কথা বলবে। নিজের ইমেজের বারোটা বাজিয়ে এদের কাছে সাধু সাজতে যাওয়ার কি খুব দরকার ছিল?

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফেরার পর সাকিব আল হাসান

সাকিব, যখন থেকে আপনার নামের পাশে তারকাখ্যাতি যুক্ত হয়েছে, তখন থেকেই দেশের অনেক মানুষ আপনাকে পছন্দ করে না। সেই তালিকায় অশিক্ষিত থেকে শুরু করে এলিট সোসাইটির লোকজনও আছে। একজন ইন্টারন্যাশনাল সুপারস্টারকে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, সেটা বুঝতে মিডিয়ারও সময় লেগেছে। সাকিব, আপনি যখন হেলিকপ্টারে চড়ে মাগুরায় গিয়েছেন, তখন আপনাকে গালি দেয়া হয়েছে। আপনি যখন ভক্তের সেলফি তোলার আবদার মেটাননি, তখনও আপনাকে গালি দিয়েছে একদল। আপনি যখন আপনার স্ত্রীকে অপমান করা যুবকের ওপর চড়াও হয়েছেন, তখনও আপনাকেই খলনায়ক বানানো হয়েছে। তখন তো আপনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হননি সাকিব, আজ কেন হতে হলো? 

গত কয়েকদিন ধরে আপনাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, কটুকথা বলা হয়েছে, মিথ্যে রটানো হয়েছে- আপনি তো ভিক্টিম এখানে, আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন? আপনার তো উচিত ছিল আইনের আশ্রয় নেয়া, অমানুষগুলোর শাস্তি নিশ্চিতের উদ্যোগ নেয়া। সেই আপনি কিনা উল্টোপথে হাঁটলেন! যে আপনি দুনিয়ার কোনকিছুকে পাত্তা না দেয়ার ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, সেটাকে নিজের হাতেই এভাবে ভাংলেন? নিজের তৈরি করা পথ ছেড়ে আপোষের রাস্তায় হাঁটতে পারলেন? 

আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ, ফেসবুকের কমেন্টবক্স দেখার সময় আপনার হবে না। তবু সময় পেলে কখনও একটু ঘুরে দেখবেন কমেন্টবক্সটা, গালির পরিমান কতটুকু কমলো সেটা মাপার জন্যে। আপনি জানেন না সাকিব, আজ আপনার এই ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনাটায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কতটা আশকারা পাবে। আমরা যারা সংখ্যায় ক্ষুদ্র হয়েও এদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে দেখে আমরা অনুপ্রেরণা পেতাম। সেই জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেল আজ, আমাদের মনোবলটা ভেঙে গেল একটুখানি হলেও। না সাকিব, আমরা লড়াই ছাড়ব না, এই ধর্মান্ধতা, এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধটা চলবে। শুধু আফসোস থাকবে, এই লড়াইয়ে আপনি আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারতেন, আপনাকে আমরা পাশে পেলাম না। 

জানি সাকিব, এখানে অনেক সমীকরণ আছে, ব্যবসায়িক ব্যাপার আছে, ব্র‍্যান্ড কোলাবরেশন বা এন্ডোর্সমেন্টের ইস্যু আছে, কোটি কোটি টাকার মামলা জড়িত, হয়তো ব্র‍্যান্ডগুলোর কাছ থেকেও অনুরোধ এসেছে, ব্যাপারটা যাতে মিটমাট করে ফেলা হয়, পর্দার পেছনের গল্পটা আমরা জানিনা পুরোপুরি। আমরা ব্যবসা বুঝি না, এন্ডোর্সমেন্টের জটিল সসমীকরণ আমাদের মাথায় ঢোকে না, আমরা শুধু বুঝি, যে জিনিস আমাদের মধ্যে ছিল না, আমরা চেষ্টা করেও অর্জন করতে পারি না, আপোষ করতে হয় নানা জায়গায়, নানা পরিস্থিতিতে- সেই জেদ, সেই তেজটা আপনার মধ্যে ছিল, দারুণভাবে ছিল। একঝাঁক অমেরুদণ্ডী ব্যাকটেরিয়ার উৎপাতে বিরক্ত বা বিব্রত হয়ে সেই সাহস, সেই ইমেজটা বিসর্জন দেয়ার দরকার ছিল না সাকিব, একদমই ছিল না...

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা