শতাব্দী রায় নামের এক পরীক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতে রিট করেছেন। আর সহপাঠী বীরপুঙ্গবেরা নেমে গেছে তাকে ভার্চুয়ালি ধর্ষণ করার জন্য। শতাব্দীর জায়গায় এই রিটটা যদি কোন ছেলে করতো, তাহলে সেই ছেলেকে কেউ ধর্ষণের হুমকি দিতো না, বরং তার মা-বোনকে ধর্ষণ করতে চাইতো...

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারনে এবছর এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না, এই সিদ্ধান্ত গত বুধবারই জানিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরীক্ষার্থীদের জেএসসি ও এসএসসির ফলের গড় অনুযায়ী এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। অর্থাৎ এবছরের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যারা জেএসসি এবং এসএএসি- দুটো পরীক্ষাতেই জিপিএ-ফাইভ পেয়েছিল, এইচএসসিতেও তাদের রেজাল্ট জিপিএ-ফাইভই আসবে। 

এসব নিয়ে গত পরশু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব। কেউ পক্ষে কথা বলছেন, তো কেউ বিপক্ষে; কেউ সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক বলে দাবী করছেন তো কেউ সমালোচনায় মত্ত হচ্ছেন। কিন্ত এই আলোচনা-সমালোচনা ছাপিয়ে গতকাল থেকেই অসুস্থ এক ব্যক্তি আক্রমণে মেতে উঠেছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের একটা অংশ। এরা সবাই পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় খুশি, আর তাই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা যারা করছে, তাদের নোংরাভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের এই সময়টাতেই অনলাইনে দেয়া হচ্ছে ধর্ষণের হুমকি। 

গতকাল শতাব্দী রায় নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী পরীক্ষা বাতিলের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রিট করেছেন হাইকোর্টে। নোটিশে এই শিক্ষার্থীর পক্ষে তার আইনজীবী বলেছেন, তার মক্কেল জেএসসিতে জিপিএ-৫ পেলেও এসএসসি চলাকালীন অসুস্থতার কারণে পূর্ণ প্রস্তুতি না নিতে পারায় তিনি জিপিএ ৪.২২ প্রাপ্ত হন। জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের গড় প্রস্তুত করলে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জিপিএ-৫ আসবে না। এতে তিনি ভবিষ্যতের হতাশায় রয়েছেন। 

জঘন্যভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করা হচ্ছে শতাব্দীকে

শতাব্দী রায় নামের এই শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করায় কলেজের প্রি-টেস্ট এবং টেস্ট উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এমতবস্থায় জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের গড় করলে তার ভালো ফলাফল করার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা উভয়ই বাধাগ্রস্ত হবে এবং তাকে তা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। নোটিশে শতাব্দী রায়ের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে, করোনার কারণে যদি পরীক্ষা একেবারেই গ্রহণ না করা যায়, সে ক্ষেত্রে স্ব স্ব কলেজে অনুষ্ঠিত টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে করে যাতে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রস্তুত করা হয়। তাহলেও অন্তত যারা এই দেড় বছর পড়ালেখা করেছে, তাদের পরিশ্রমের মূল্যায়ন হবে। 

এই সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পাণ্ডবেরা নেমে পড়েছে শতাব্দীকে ভার্চুয়ালি ধর্ষণ করার জন্য। তার শরীর নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হচ্ছে প্রকাশ্যে, তার ধর্ম এবং পরিবারকে টেনে নোংরা গালিগালাজ করা হচ্ছে, এমনকি তাকে ধর্ষণের হুমকিও দিচ্ছে অনেকে। এদের সবাই এইচএসসি-২০২০ ব্যাচের পরীক্ষার্থী। কারো হয়তো এ-প্লাস নিশ্চিত হয়ে গেছে, কেউবা ফেল করার হাত থেকে বেঁচে গেছে। তাদের সুখনিদ্রায় শতাব্দী কেন বাম হাত ঢোকাতে গেলেন, এতেই শতাব্দীর ওপর তাদের ক্ষোভ।

অথচ বাংলাদেশের আইন, বাংলাদেশের সংবিধান শতাব্দীকে অধিকার দিয়েছে যে কোন সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা চ্যালেঞ্জ করার। সেই অধিকার নিয়েই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে সরকারী সিদ্ধান্তের বদল হবে কিনা, সেটা আদালত আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক করবে। কিন্ত এই যে রিট করার অপরাধে শতাব্দী রায় নামের তরুণীটিকে ন্যাক্কারজনক নোংরামির সামনে পড়তে হলো, সেটা কোন মন্ত্রণালয় দেখবে? কোন আদালত এর বিচার করবে? 

এই হচ্ছে নোংরামির নমুনা!

যারা এসব জঘন্য কমেন্ট করেছে, গালাগাল দিয়েছে, ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে, এদের কারো বয়সই ১৭/১৮ বা এর বেশি নয়। এই বয়সের একটা ছেলে কিভাবে প্রকাশ্যে একটা মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দিতে পারে? রিট করে তাদের দৃষ্টিতে শতাব্দী অপরাধ করেছেন, আর সেই অপরাধের সাজা ধর্ষণ- এটাই হচ্ছে এদের মেন্টালিটি। কি অদ্ভুত একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে চোখের সামনে! মেট্রিকে বা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় কারো সাথে ঝগড়া হলে আমরা তাকে হুমকি দিতাম 'আমাদের এলাকায় আসিস, বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো' বলে, আর এরা কিনা ধর্ষণের হুমকি দেয়! 

ধর্ষণের পেছনে যারা নারীর পোশাক, পর্দা বা আকাশ সংস্কৃতি আর অশ্লীলতার দোষ খুঁজে পান, তারা একবার বলুন, এখানে শতাব্দী রায় কি এমন কাজটা করেছেন, যাতে তাকে ধর্ষণের ইচ্ছে জেগে উঠেছে এই পশুগুলোর মনে? মানুন আর না মানুন, বিচারহীনতার পাশাপাশি এদেশে ধর্ষণের সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে ক্ষমতার দম্ভ। সেই দম্ভে অন্ধ হয়ে একজন নারীকে ধর্ষণ করতে চাইছে কতগুলো হায়েনা। আজ শতাব্দীর জায়গায় এই রিটটা যদি কোন ছেলে করতো, তাহলে সেই ছেলেকে কেউ ধর্ষণের হুমকি দিতো না, বরং তার মা-বোনকে ধর্ষণ করতে চাইতো।

এরা নাকি শিক্ষার্থী!

এদেশে ধর্ষণটা হচ্ছে পাওয়ার প্র‍্যাকটিসের মোক্ষম অস্ত্র। জায়গা-জমি নিয়ে কারো সাথে ঝামেলা আছে? সেই পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ করো, ওদের মেরুদণ্ড এমনিতেই ভেঙ্গে যাবে। কেউ প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি? তুলে এনে রেপ করো, কত বড় সাহস, আমার মতো ছেলেকে মুখের ওপর না বলে! পাহাড়ে আদিবাসী নারীরা যে বাঙালি সেটেলারদের হাতে ধর্ষিত হয়, সেটার কারনও পাওয়ার প্র‍্যাকটিস, সেই অঞ্চলের মানুষকে বাঙালি জাতির শক্তি সম্পর্কে জানান দেয়া, তাদের জায়গা জমি দখল করে তাদেরকে আরও গভীর অরণ্যে ঠেলে দেয়া। 

ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বেড়ানো এই হায়েনাগুলোর বিচারের দাবীতেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নারীবান্ধব করতে না পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। আজ শতাব্দীকে হুমকি দেয়া এই পটেনশিয়াল রেপিস্টগুলোকে থামানো না গেলে কাল এরা রাস্তায় কাউকে পেলে ধর্ষণ করে বসবে, ধর্ষকের জন্ম এভাবেই হয়। সাপ ফণা তোলার আগেই বিষদাঁতটা ভেঙে ফেলা দরকার, দেরী হয়ে গেলে এই দেশের ক্ষতি, এই সমাজের ক্ষতি...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা