২২ জুলাই দুপুরবেলা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ মিনিটের ফোনালাপের পর থেকেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। তিন দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় উঠে আসে।

প্রথম আলোতে ইউএনবি'র বরাত দিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়, সেখানে লেখা হয়: "বুধবার বেলা একটার দিকে টেলিফোন করে কুশলাদি বিনিময় করে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন ইমরান খান।" মূলত প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম যা জানিয়েছেন, সেটিই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের ট্রিবিউন পত্রিকায় অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তানের বরাত দিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়, সেখানে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির উপর ভিত্তি উল্লেখ করা হয়: "ইমরান খান 'ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর সংকট' ও আঞ্চলিক সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন।" অথচ বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শুরুতে এই বিষয়টির একদমই উল্লেখ ছিল না।

ইত্তেফাকের দিল্লি প্রতিনিধি অঞ্জন রায় চৌধুরী এই পার্থক্যটি ছাড়াও আরো দুইটি পার্থক্য তুলে ধরেন। প্রথমত, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই আলোচনা নিয়ে ৯ অনুচ্ছেদের একটি বর্ণনা প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশের দেয়া বিবৃতিতে ছিলো মাত্র দুইটি অনুচ্ছেদ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তান সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও এ বিষয়ে তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

এদিকে মানবজমিনে তাদের কূটনৈতিক প্রতিবেদকের করা সংবাদ অনুযায়ী, "বেশ কদিন ধরে ইসলামাবাদের তরফে দুই প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপের সময় চাওয়া হচ্ছিল। অবশেষে ঢাকা রাজি হয়।"

বাংলাদেশের দেয়া অতি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনুল্লেখ এবং ফোনালাপে ইসলামাবাদেরই বেশি বারবার উদ্যোগী হওয়া, এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, ইসলামাবাদেরই বেশি আগ্রহ বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নতি করায়।

শেখ হাসিনা-ইমরান খান

ইনকিলাব পত্রিকা দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই ফোনালাপকে অভিহিত করেছে "শুভ বার্তাবহ" হিসেবে। তারা লিখেছে, "পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এই ফোনালাপের প্রয়াসে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। দুই নেতার ফোনালাপে ইমরান খান করোনাভাইরাস মহামারী ও বন্যা মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নানা উদ্যোগ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোতিার ক্ষেত্রে সার্কের গুরুত্ব এবং ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মির পরিস্থিতি ও পাকিস্তানের অবস্থান সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর এই ফোনালাপ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে শুভ ইঙ্গিতবাহী।"

ভয়েস অফ আমেরিকার সংবাদেও বাংলাদেশের অবস্থানের এক প্রকার প্রশংসাই করা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতামত তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, "এটা ভাববার কোন কারণ নেই যে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব ফেলার প্রয়াশ একেবারেই নিরীহ। উভয় দেশই বাংলাদেশকে তাদের কক্ষফুটের মধ্যে রাখতে চাইছে। যখন ভারতীয় মূলনীতি কেবলমাত্র স্বল্পমেয়াদী চিন্তা দ্বারা পরিচালিত এবং তা একদল কেন্দ্রিক চীন তখন বাংলাদেশে একটা দীর্ঘমেয়াদী খেলা খেলছে।"

এবার আসা যাক ভারতের সংবাদমাধ্যমে হাসিনা-ইমরান ফোনালাপকে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা পাকিস্তানি বার্তা সংস্থার বিবৃতি অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুটিতেই গুরুত্বারোপ করেছে। কিন্তু পাশাপাশি তারা এটিও উল্লেখ করতে ভোলেনি, "ঢাকার সরকারি বার্তাসংস্থাগুলো কাশ্মীর ইস্যুতে নীরবতা অবলম্বন করেছে।"

সরকারিভাবেও দিল্লি জানিয়েছে যে ঢাকার কাশ্মীর অবস্থানে তারা খুশি। ভারতীয় সকল গণমাধ্যমেই সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবের বিবৃতি তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, "ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং সময়ের দ্বারা পরীক্ষিত। শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ চলছে। আমরাও তার অংশীদার। জম্মু ও কাশ্মীর যে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এটা বাংলাদেশেরও অবস্থান। তাদের সেই অবস্থানকে আমরা সম্মান করি।"

বিবিসি বাংলা অবশ্য শুরু থেকেই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্কের আরো গভীরে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২১ জুলাই তারা একটি সংবাদ প্রকাশ করে যার শিরোনাম: "বিএসএফ-বিজিবি প্রকাশ্য রেষারেষি: বৃহত্তর কোনো বিরোধের ইঙ্গিত?" সেই সংবাদে তারা এটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যে "চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চুপ থাকার জন্য বাংলাদেশের ওপর ভারত হয়তো কোনো চাপ তৈরির চেষ্টা করছে।"

এর পরদিনই যখন হাসিনা-ইমরান ফোনালাপের মাধ্যমে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য বিনিময় হয়, তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে এখান থেকেও হয়তো বিবিসি বাংলা আরো নিগূঢ় কোনো বিষয় বের করে আনার চেষ্টা করবে। বাস্তবিকও তা করেছে তারা। তবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে এবার উন্নতি হতে চলেছে, এমন আশাবাদ যারা ব্যক্ত করছে, তাদের উৎসাহে খানিকটা জল ঢেলে দিতেও ভোলেনি।

"পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর হতে যে পাঁচটি বাধা" শিরোনামের একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা, যেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার শীতল সম্পর্কের পেছনে তারা শনাক্ত করেছে এই ইস্যুগুলোকে: ১. ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং পাকিস্তানের শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক, ২. বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের স্বাভাবিকতা এবং পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্যের অসম্ভাব্যতা, ৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব, ৪. '৭১-এর কৃতকর্মের জন্য পাকিস্তানের সরাসরি ক্ষমা না চাওয়া, ৫. পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে আটকে পড়া নাগরিকদের ফিরিয়ে না নেয়া।

অবশ্য পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশি হাই কমিশনার সোহরাব হোসেনের বক্তব্যের মাধ্যমে বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনটির এভাবে উপসংহার টেনেছে, " (পাকিস্তান) তারা যদি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন না হওয়ার কোন কারণ দেখছি না, বরং উন্নয়ন হওয়ার কথা।"

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা