এদেশে পড়াশোনা করার স্বপ্ন মরে আগুনে পুড়ে, চাকরি করে সংসার টানার স্বপ্ন মরে ধর্ষিত হয়ে, এতিম দুই ভাই কে সৎ উপায়ে মানুষ করার স্বপ্ন পিষ্ট হয় বাসের চাকায়। আর সিনেমার স্বপ্ন? গুলিতে নিহত হয়। কোন ভাবে বেঁচে গেলেও পচে জেল হাজতে!

'সারভাইভিং ৭১' এর যখন কাজ শুরু করবো বলে ফেইসবুকে বললাম, দ্বিতীয় যেই মানুষটা আমাকে ইনবক্সে নক করে, সে হচ্ছে শিপ্রা। খুবই প্রফেশনালি বলে যে সে  প্রজেক্টটাতে কাজ করতে ইচ্ছুক। আমি ইমেইল দিলে সে রেজুমে পাঠায়। খুব সুন্দর, খুব প্রফেশনাল, খুব গোছানো। আমি তার প্রফেশনালিজম এবং কাজ এর প্রতি প্যাশন দেখে মুগ্ধ হলাম। সে আমাদের দলে যুক্ত হয়ে গেল।

আমরা যেহেতু এনিমেশন করছি, এবং খুব ছোট স্কেলে, প্রোডাকশন সাপোর্ট তেমন লাগতো না। সে কিছুদিন পরপর বলে, ভাই কিছু করতে দেন। তাকে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ দেখতে দিলাম, দেখলাম তাতে সে খুব একটা ইন্টারেস্টেড না। আসলে তার প্যাশনটা হচ্ছে একেবারে মাঠে হাতে কলমে নেমে কাজ করার প্যাশন। 

এবার যখন ডিসেম্বরে বাংলাদেশে গেলাম আমার লক্ষ্য ছিল মূল চরিত্রদের সবার ভয়েস রেকর্ড করে ফেলা। আমাদের যেহেতু খুব ছোট বাজেটের মধ্যে কাজ সারতে হবে, ঠিক করলাম ভয়েস রেকর্ডের সময় বিহাইন্ড দ্য সিন্ শুট করে ফেলবো। আমি এই দায়িত্ব পুরো দিয়ে দিলাম শিপ্রার হাতে। ওর সাথে আমার কথোপকথন হলো এরকম-
 
-ডিএসএলআর দিয়ে শুট করবো, ক্যামেরা জোগাড় করতে পারবা না, ট্রাইপড সহ? 

-ভাই পারবো।    

-এডিট সব কিন্তু তোমাকে করতে হবে, পারবা? 

-ভাই পারবো কোন সমস্যা হবে না।  

-যথারীতি বাজেট খুব কম, এই বাজেটে কাজ করতে পারবা?

-ভাই একটু বাড়াতে হবে।

-আচ্ছা তুমি বল কত হলে করা যাবে। 

-ভাই এইটা দিয়েন। 

আমি খুব ইম্প্রেসড হলাম শিপ্রার কাজের প্রতি এপ্রোচটা দেখে, বাজেট এবং বাস্তবতা সম্পর্কে তার ধারণা দেখে। আরো ভাল লাগলো যে সে মুখ ফুটে বলতে পারলো তার কি লাগবে। আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে যা অনেকেই পারে না। 

শিপ্রা সিফাত কে নিয়ে চলে আসলো আমাদের প্রথম ভয়েস রেকর্ডিং এর দিন। সেই প্রথম সিফাতের সঙ্গে পরিচয়। আমাদের তিনদিন ভয়েস রেকর্ডিং সেশন হয়। মনে হয় না এই তিন দিনে সিফাতের মুখে আমি তিনটার বেশি বাকি শুনেছি। শুধু একটু পরপর লাজুক হাসি দিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া তার আর কোন দিকে ঝোক ছিল না। 

ভয়েস রেকর্ডিং এর সময়ও শিপ্রার কাজে আমি মুগ্ধ হই। সে খুব লজিক্যালি অনেক রকম সাজেশন দেয় আমাকে। আমি বেশ কয়েকটা সংলাপে তার সাজেশন নেই। আবার লজিকের বিপরীতে পাল্টা লজিক দিলে, দেখি সে সেটা নেয়ার ক্ষমতাও রাখে। গো ধরে বসে থাকে না। শিপ্রা কে দিয়ে আমরা বেশ কিছু এডিশনাল ভয়েস রেকর্ড করাই, এবং একটি মূল চরিত্রের ডামি ভয়েসও সে দিয়ে দেয়। আমাদের এনিমেশনের কাজটা যাতে একটু সহজ হয় সেই জন্য। 

শিপ্রার সাথে আমার শেষ কথা হয় জুলাই মাসের ৩০ তারিখ। কোভিড এর কারণে আমরা বিহাইন্ড দ্য সিন্ এর এডিটিং এর কাজটা বন্ধ রেখেছিলাম। ও আবার কাজ শুরু করেছে শুনে ওকে নক করতেই ও এডিট শুরু করে দিল বিহাইন্ড দ্য সিনগুলোর। ও আমাকে পরিকল্পনার কথা বললো, কিভাবে সব করবে জানালো। কি কি লাগবে আমার কাছ থেকে চাইলো। আমি সব লোগো, পোস্টার ইত্যাদি সব দিলাম। ৩০ তারিখ, বৃহস্পতিবার ও আমাকে প্রথম কত শেয়ার করলো। বললো ভাই দেখে জানান। 

আমার উইকেন্ডে একটা বড় ডেডলাইন ছিল। বললাম কাজ শেষ করে জানাচ্ছি দেখে। তারপর ৪ আগস্ট এ নিচের সংবাদটা দেখলাম। সত্যি কথা বলতে কি এত অসহায় আমার বহুদিন লাগে নাই। গত দুইদিন ধরে তব্দা লেগে আছি। এইটা কোন কথা, এইটা কোন কথা!?! 

কিছুদিন আগে মেক্সিকোতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তিন তরুণ ফিল্ম স্কুলের ছাত্র, শুটিং করছে আউটডোরে। তার পিছনেই চলছিল ড্রাগের কারবার। ড্রাগ  ব্যবসায়ীরা ওদের দেখে ফেলে। পাছে ওরা কাউকে কিছু বলে বা ফিল্মে কিছু দেখায়, এই অজুহাতে, তিনজনকেই মেরে ফেলে তারা। একেবারে এসিড দিয়ে মেরে গলিয়ে দেয়। এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই মেক্সিকান ফিল্মমেকাররা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। 

আমি এখন ভাবছি তারা যদি আমাদের এই ঘটনাটা জানতো, তারা কি বলতো। কারণ ওদের দেশে তো ক্রিমিনাল, যারা ড্রাগের ব্যবসা করছে, তারা মারছে ফিল্মমেকারদের। আর আমাদের দেশে, রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ, যারা কিনা আমাদের রক্ষার জন্যই নিয়োজিত, তারা, আমাদের মেরে ফেলছে! গুলি করে মারছে, জেলে ঢুকিয়ে মারছে। শুধুমাত্র ভিন্ন কিছু করবার, চলচ্চিত্র নির্মাণ করবার স্বপ্ন দেখছিল বলে এদের ভুগতে হচ্ছে! এর চেয়ে ভয়ংকর কোন কিছু কি হতে পারে?      

আমি আসলে পুরো ঘটনাটায় এখন ধাতস্থ হতে পারি নাই। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করছে, আমি তাদের সাথে ১০০% একাত্বতা ঘোষণা করছি। বাংলাদেশের মিডিয়া পার্সোনালিটির প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, আমি তাদের তীব্র প্রতিবাদের সাথে ১০০ ভাগ আছি। কিন্তু, আমার ফেইসবুকের টাইম লাইনে উঠে আসছে মাত্র দুই বছর আগে পুলিশের ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া কিশোর-কিশোরীদের ছবি। নিরাপদ সড়ক এর মত অবিশ্বাস্য একটি স্বপ্ন তারা করেছিল। সেই তুলনায় আমাদের দেশে ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রের করার স্বপ্ন দেখা তো অসম্ভব! 

এক সময় আমাদের গান ছিল, আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী। খুব সম্ভবত এখন গানটার লিরিক পাল্টাতে হবে। নতুন লিরিক হবে, আমাদের দেশটা স্বপ্নের মৃত্যুপুরী...কারন এখানে পদে পদে স্বপ্নের মৃত্যু হয়। পড়াশোনা করার স্বপ্ন মরে আগুনে পুড়ে, চাকরি করে সংসার টানার স্বপ্ন মরে ধর্ষিত হয়ে, এতিম দুই ভাই কে সৎ উপায়ে মানুষ করার স্বপ্ন পিষ্ট হয় বাসের চাকায়। আর সিনেমার স্বপ্ন? গুলিতে নিহত হয়। কোন ভাবে বেঁচে গেলেও পচে জেল হাজতে!     

শিপ্রা ও সিফাতের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হোক। বিশ্বাস করুন, সিনেমা বানানো ছাড়া ওরা আর কিছু করতে চায়নি জীবনে, কিচ্ছু না। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা