'সততা স্টোর' নামের অভিনব কনসেপ্টের সূচনা শহিদুলই করেছিলেন বাংলাদেশে। গত ছয় বছরে স্কুল থেকে একদিনও নেননি নৈমিত্তিক ছুটি। নিজের শ্রমে স্কুলকে বানিয়েছেন 'শ্রেষ্ঠ স্কুল।' তিনি দেশসেরা প্রধান শিক্ষক হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক...

কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর একটা বই পড়ছিলাম  সেখানে লেখক খুব সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন-

আমাদের প্রত্যেকের চারপাশে প্রতিদিন এত এত অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি হচ্ছে... তাও আমরা টিকে থাকছি কীভাবে? কেন পৃথিবীটা এখনো গোল্লায় যাচ্ছেনা? এর পেছনে কারণ একটাই, পৃথিবীতে ভালো মানুষও কিছু কিছু আছে। খারাপ মানুষদের তুলনায় হয়তো তাদের সংখ্যা খুবই কম কিন্তু এই ভালো মানুষগুলোর শক্তি খুব বেশি। যে শক্তির কারণে পৃথিবী এখনো খাদে তলিয়ে যায়নি। এই মানুষগুলোই টেনে ধরে রেখেছে পৃথিবীটাকে। সাম্যাবস্থার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এরকমই একজন রাজবাড়ীর শহিদুল ইসলাম। তিনি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।  ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ–২০১৯’ উপলক্ষে তাঁকে দেশের সেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনার কারণে এবার এই ঘোষনাটি একটু দেরীতে এসেছে। তবে ঘোষণার কথা যদি বাদও দেই, শহিদুলের সবচেয়ে বড় পরিচয়, বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ও চর্চিত 'সততা স্টোর' নামের বিক্রেতাহীন দোকানের কনসেপ্ট তিনিই প্রথম চালু করেছিলেন। শহিদুলের স্কুলেই দোকানদারবিহীন 'সততা স্টোর' প্রথম কার্যক্রম শুরু করে। এখন বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই খুঁজলে এই 'সততা স্টোর' দেখতে পাওয়া যাবে। জাতীয় রোলমডেলই হয়ে গিয়েছে এই দোকানগুলো।

'সততা স্টোর' হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় রোলমডেল! 

শহিদুল শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন, তাও কম দিন হয়নি। ১৯৯৮ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন তিনি। জানা গেছে গত ২০১৪ সাল থেকে টানা ছয় বছরে তিনি নেননি কোনো নৈমিত্তিক ছুটি। বিদ্যালয়কে শুধু ক্লাসের বইয়ের মধ্যেই আটকে রাখেননি। বিদ্যালয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, গ্রন্থাগার, শহীদ মিনার, মিনা–রাজু পার্ক, পতাকামঞ্চ, ভূগোলক, রিডিং কর্নার সহ অনেক কিছু। এবং ছেলেমেয়েরা যাতে এসব উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারে, তিনি নিশ্চিত করছেন সেটিও।  স্কুলের উন্নয়নের জন্যে তিনি নিজের বেতন থেকেও টাকাপয়সা দিয়ে দেন মাঝেমধ্যে। এছাড়াও  শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্যে নৈশকালীন বিদ্যালয়ও চালু করেছেন। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবেই তিনি পেয়েছেন জাতীয়ভাবে 'সেরা প্রধান শিক্ষক' এর পুরস্কার।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমার বরাবরই অতিমানব গোছের কিছু মনে হয়েছে। তাল তাল কাদামাটির মতন শিশুদের নিয়েই তো তাদের পথচলা। শিশুদের মেরুদণ্ডটাই গড়ে দেন তারা, যে মেরুদণ্ড একদিন রূপান্তরিত হয় দেশের সেরা সেরা মানুষে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকের কাজটা তাই অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদের চেয়ে একটু আলাদা, স্বকীয়। যদিও সামাজিকভাবে 'স্কুল শিক্ষক' কথাটা শুনলে অনেকে একটু নাক কুঁচকে হাসেন, তবুও এই পেশার গুরুত্ব অন্যরকম সুন্দর। আমি এটিও জানি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও অনেক অসৎ, দুর্নীতিবাজ শিক্ষক রয়েছেন যারা ক্লাস নেন না, যারা শিক্ষার্থীদের জন্যে দেয়া খাবারও আত্মসাৎ করেন, যারা নোংরা রাজনীতির নগ্ন প্রদর্শনীতে ব্যস্ত ৷ তবু তাদের কথা এখানে বলছি না মোটেও। কারণ ভালো শিক্ষকদের কাজ ও ক্ষমতার তুলনায় তারা নেহায়েতই খর্বকায় ও উল্লেখ-অযোগ্য ৷

এই যেমন শহিদুল ইসলাম। আমি বিশ্বাস করি, এরকম শহিদুল ইসলাম আরো আছেন এ দেশে৷ এই মানুষগুলোই আমাদের ভরসা। যারা আছেন বলেই আমরা ভাবতে পারি, দেশটা এখনো ঠিক আছে। দেশটা এখনো মহাশ্মশান হয়ে যায়নি। যাদের ভরসায় আমরা এত সব অনাচারের মধ্যে এখবো বলি-

দেশ ঘুরে দাঁড়াবেই৷

এই মানুষগুলোই আমাদের আশা, ভরসা, বাতিঘর। আমাদের শক্তির জায়গা।

বিনম্র শ্রদ্ধা ও শুভকামনা রইলো।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা