কেউ ধর্ষণের বিচার চাইলে আপনাদের সমস্যা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে-মেয়ে পরস্পরের সম্মতিতে একে অন্যকে চুমু খেলে আপনাদের সমস্যা, শমী কায়সার বা মিথিলা বিয়ে করলেও আপনাদের সমস্যা হয়; এত সমস্যা নিয়ে আপনারা বেঁচে থাকেন কিভাবে?
কিছুদিন আগের কথা, আমেরিকান পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের নিহত হবার ঘটনায় মাস কয়েক আগে আমেরিকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উপেক্ষা করেই লাখ লাখ মানুষ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে জড়ো হয়েছিল আমেরিকার নানা প্রান্তে, শহরে শহরে হয়েছে মিছিল, স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে পুরো আমেরিকা। তখন ফেসবুকে অনেককে দেখেছি সেই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে, আমেরিকা কত অসভ্য একটা দেশ সেটা প্রমাণের চেষ্টা করতে।
পুরো ব্যাপারটা দেখে অদ্ভুত লেগেছিল। সারাবছর মানুষকে তার গায়ের রঙ, চেহারা বা ফিগার দিয়ে বিচার করা এই উপমহাদেশের সিংহভাগ মানুষজন যখন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে, আমেরিকাকে 'রেসিস্ট কান্ট্রি' বলে ডাকে, তখন অবাক হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কয়েক মাস আগে জর্জ ফ্লয়েডের জন্য নাকিকান্না কেঁদে বুক ভাসানো অনেককেই গত দুইদিন ধরে মুখোশ খুলে আসল চেহারাটা বের করে আনতে দেখলাম। খুব বেশি বিস্মিত হইনি। হিপোক্রেসি জিনিসটা তো আমাদের রক্তেই মিশে আছে, কোন মেডিসিন বা টিকা দিয়ে এই জিনিস দূর করা সম্ভব নয়।
অভিনেত্রী শমী কায়সার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন গত পরশু। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বর-কনের বন্ধুরা, যারা বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই একদল মেতে উঠেছে নোংরা রকমের বডি শেমিংয়ে। বরের বয়স বেশি, শমী কায়সারকে ছবিতে মোটা লাগছে, এসব নিয়ে হাজার হাজার মন্তব্য পড়ছে বিয়ের ছবি আর খবরের নিচে কমেন্টবক্সে। এই গাধাগুলোকে কে বোঝাবে যে, শমী কায়সারের বয়স ৫১ বছর, এই বয়সে একজন বাঙালি নারীর বডি স্ট্রাকচার একুশ বছরের তরুণীর মতো হবে না- এটাই স্বাভাবিক।
এই কদর্য ব্যক্তি আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না শমী কায়সারের স্বামী রেজা আমিন সুমন। বডি শেমিংয়ের শিকার হচ্ছেন তিনিও। যারা কমেন্টগুলো করছে তাদের কয়েকজনের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ঘুরে এলাম। বাংলাদেশের মেয়েরা যদি ছেলেদের চেহারা-সুরত দেখে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতো, তাহলে এদের ভাগ্যে বিয়ে নামের ব্যাপারটা কখনও ঘটতো বলে মনে হয় না, অথচ এরাই কিনা নোংরাভাবে আরেকজনের শারীরিক গড়ন নিয়ে কটু মন্তব্য করছে। রেজা আমিনের বয়স মধ্যপঞ্চাশ, বা তারও বেশি। এই বয়সের একজন পুরুষ নিশ্চয়ই সিক্স প্যাক অ্যাবস আর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল নিয়ে ঘুরবেন না- এই বাস্তবতাটা এসব গণ্ডমূর্খকে কে বোঝাবে?
খবরে পড়লাম, রেজা আমিন সুমন পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি এবং শমী কায়সার পরস্পরের ভালো বন্ধু ছিলেন। বন্ধুত্ব থেকেই পরিণয়। ভালো লাগা এবং বিয়ে। একসময় র্যাংগস গ্রুপে চাকরি করেছেন, তারপর নিজেই উদ্যোক্তা হয়েছেন, নিজস্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তার। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, সুযোগ হলেই বেরিয়ে পড়েন দেশে-বিদেশের নানা ঠিকানায়। ফটোগ্রাফির শখও আছে। ভদ্রলোক ফুটবলপ্রেমীও। প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনার খেলা দেখার জন্য ন্যু ক্যাম্প পর্যন্ত ধাওয়া করেছেন তিনি। রেজা আমিনের জীবনে অর্জনের তালিকা করতে বসলে সেই তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ হওয়ার কথা। আর তাকে এবং শমী কায়সারকে নিয়ে যারা অনলাইনে নোংরামির আসর খুলে বসেছে, বাজে মন্তব্য করা ছাড়া তাদের অর্জনটা কি?
যারা গালাগালি করছে, এদের বড় একটা অংশের অভিযোগ, শমী কায়সার কেন এতবার বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন? এই নিয়ে তাকে দুশ্চরিত্রা আখ্যা দিতেও ছাড়েনি অনেকে! হ্যাঁ, এটা শমী কায়সারের তৃতীয় বিয়ে। কিন্ত একটা মানুষ কয়টা বিয়ে করলেন, সেটার ওপরে কি তার চারিত্রিক সনদ নির্ভর করে? একজন পুরুষ যখন একাধিক বিয়ে করেন, তাকে তো কেউ চরিত্রহীন বলে অপবাদ দেয় না। একজন নারীর বেলায় তাহলে চিত্রটা ভিন্ন হবে কেন? নাকি নারী তার পছন্দমতো সঙ্গী বাছাই করে নিচ্ছেন- এই স্বাধীনতাটাই গোঁড়া মানসিকতার লোকজন মেনে নিতে পারছে না?
গায়িকা এবং অভিনেত্রী মিথিলা যখন সৃজিত মুখার্জীকে বিয়ে করেছেন, তখন তাকেও এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হয়েছে। এদের ক্ষোভের বলি হয়েছেন সৃজিতও, তাকেও হজম করতে হয়েছে গালাগাল। ২০২০ সালে এসেও এই সমাজের একদল বর্বর, অবিবেচক লোক এটা মেনে নিতে পারে না যে, দুটো মানুষের মধ্যে বনিবনা না হলে তারা আলাদা হতেই পারেন, জীবনে সুখ খোঁজার জন্য অন্য কারো হাত ধরতে পারেন। এই কাজটা পুরুষ করলে কেউ কিছু বলে না, কিন্ত নারীরা করলেই শুরু হয় ব্যক্তি আক্রমণ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, শমী কায়সারের সাবেক স্বামী, কলকাতার পরিচালক রিঙ্গো কিন্ত শমীর বিয়ের সংবাদ পেয়ে তাকে শুভকামনা জানিয়েছেন। সাবেক স্ত্রীর বিয়ে নিয়ে তিনি যথেষ্ট সাপোর্টিভ। অথচ যাদের সঙ্গে শমী কায়সারের দূরতম সম্পর্কও নেই, শমী কায়সারের বিয়েতে যাদের কিছু আসার বা যাওয়ার কথা নয়, তারাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নোংরামির উৎসবে। এটাকেই বোধহয় বলে যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই।
শমী কায়সার তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মনে রাখার মতো বেশ কিছু কাজ করেছেন। এক 'নক্ষত্রের রাত' নাটকটার জন্যেই তাকে মনে রাখা যায়। 'লালন' এবং 'হাছন রাজা' নামের দুটো সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি, সেখানেও তার অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। এসব বাদ দিলেও, তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্তান, এটুকুর জন্যে হলেও সেন্সিবল কোন মানুষের পক্ষে তাকে নিয়ে নোংরামি করাটা সম্ভব নয়। কিন্ত সেই সেন্সটা যে অনেকের মধ্যেই নেই, সেটাই যেন প্রমাণীত হলো আরেকবার। ব্যক্তি হিসেবে তার ভুল-ত্রুটি থাকলে সেটার সমালোচনা করুন। তিনি কেন বিয়ে করছেন, এটা কি গবেষণার বিষয়বস্তু হলো?
দুটো মানুষ ধর্মীয় রীতিতে, সামাজিকতা মেনে একসঙ্গে সংসার করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন, সেটা নিয়েও যে কারো সমস্যা থাকতে পারে, এরকম কিছু কল্পনা করিনি। অবশ্য, এদেশের কিছু মানুষ সবকিছুর মধ্যেই সমস্যা খুঁজে পায়। কেউ ধর্ষণের বিচার চাইলে এদের সমস্যা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে-মেয়ে পরস্পরের সম্মতিতে একে অন্যকে চুমু খেলে এদের অসুবিধা হয়, শমি কায়সার বা মিথিলা বিয়ে করলেও এদের সমস্যা হয়; এত সমস্যা নিয়ে এরা বেঁচে থাকে কিভাবে, এটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন