শনিবার বিকেলে সিনেমায় এমন কোন ভায়োলেন্স দেখানো হয়নি, যেটা গুলশানের হোলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া নৃশংস সেই ঘটনাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। আর তাই শনিবার বিকেলকে সেন্সর বোর্ডের জিম্মি দশা থেকে মুক্তি দেয়া হোক, এই দাবী জানিয়ে রাখলাম...

অ্যামাজন প্রাইম গতকাল তাদের ২০২০ সালের প্রোজেক্টগুলোর নাম ঘোষণা করেছে। বারো মাসে মোট ১৪টা সিরিজ রিলিজ করবে তারা, এর মধ্যে একদম নতুন সিরিজ যেমন আছে, তেমনই আছে পুরনো সিরিজের নতুন সিজনও। এই ১৪টি সিরিজের মধ্যে একটি মুম্বাইয়ের জঙ্গী হামলা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে তাজ হোটেল, ছত্রপতি শিবাজী রেল স্টেশন সহ আরও কয়েকটি স্থানে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার ঘটনাগুলোই দর্শক দেখতে পাবেন টেলিভিশন বা মোবাইলের পর্দায়। 

মুম্বাই হামলা নিয়ে ভারতে কিন্ত এটাই প্রথম কাজ নয়। এর আগে কয়েকটা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা হয়েছে, এদের মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক। এবার তো ওয়েব সিরিজই নির্মিত হচ্ছে, ঘটনার প্রেক্ষাপট আর ভয়াবহতা প্রদর্শনে তারা পিছপা হবে না নিশ্চিত। অথচ আমাদের দেশে হলি আর্টিজানের নৃশংস ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানো হলে সেটা সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রই পায় না, বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকে রহস্যজনক ভাবে। কী অদ্ভুত একটা অবস্থা!

বছর দুয়েক আগে গুলশানের হোলি আর্টিজানে নৃশংস জঙ্গী হামলায় কেঁপে উঠেছিল সারাদেশ। সেই ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই শনিবার বিকেল- এর চিত্রনাট্য নির্মাণ করা হয়েছে। পরিচালকের ভাষায়- শনিবার বিকেল হোলি আর্টিজান এর ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত, কিন্তু সেই ঘটনার হুবহু পুনঃনির্মাণ নয়। এটা আগাগোড়াই ফিকশন। তবে সেন্সর বোর্ড এত জটিল ভাবনায় না গিয়ে সরাসরি নিষিদ্ধই করে দিয়েছিল সিনেমাটাকে। এক বছর পার হয়ে গেলেও, আজও কোন সমাধান হয়নি সেই রহস্যের, শনিবার বিকেল মুক্তি নিয়ে জটও খোলেনি! 

শনিবার বিকেল সিনেমায় তিশা

মজার ব্যাপার হচ্ছে, শনিবার বিকেল সিনেমাটা প্রথমবার যখন স্ক্রিনিং হয়েছিল, তখন সেন্সর বোর্ডের সদস্যরাই ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন, কারিগরি দিক থেকে এটাকে ভীষণ উন্নত সিনেমা বলেও মন্তব্য করেছিলেন তারা। চার-পাঁচ দিন পরে আবার তারাই সিনেমাটাকে নিষিদ্ধ করেছেন, স্বরাষ্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়ের রেফারেন্সও দিয়েছেন তারা। হোলি আর্টিজান একটা সেন্সেটিভ ইস্যু, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্ত তাই বলে সেটা নিয়ে সিনেমা বানানো যাবে না? নাকি এই বিষয়গুলো মানুষকে জানানো নিষেধ? 

সেন্সর বোর্ডের এমন বিমাতাসুলভ আচরণের মুখে এর আগেও অনেক সিনেমাকে পড়তে হয়েছে। রানা প্লাজার নির্মম ঘটনা নিয়ে এই নামেই একটা সিনেমা বানানো হয়েছিল, সেটা আজও মুক্তির আলো দেখেনি, কোনদিন দেখবে বলেও মনে হয় না। হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে যেখানে, সেটা অপরাধ নয়, কিন্ত সেই ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানাতে গেলেই শুধু মানুষজনের অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়! 

এর আগে বিদেশী নাগরিককে অপহরণের দৃশ্য থাকায় আটকে দেয়া হয়েছে একটা সিনেমা। অথচ কয়েকদিন আগেই চীনের এক নাগরিককে ঢাকায় নিজের বাসায় খুন হতে হয়েছে, এর আগে ইতালী বা সৌদি আরবের নাগরিকেরাও খুন হয়েছেন ঢাকায়। ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা ঠেকানো যাচ্ছে না, অথচ এরকম কিছু সিনেমায় দেখাতে গেলেই যেন অপরাধ! দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, যেন হলিউড-বলিউডের চেয়েও বাংলাদেশী সিনেমার চাহিদাটা বেশি! 

ভারতে উরির সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে সিনেমা হয়েছে, সেটা ২০১৯ সালের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমাও ছিল। পুলওয়ামা হামলা হবার পরে হিড়িক পড়ে গেছে সিনেমার নামের লাইসেন্স দেয়ার, কারণ এরকম টপিক কেউই ছাড়তে চায় না। পুলওয়ামা নিয়ে সিনেমা হলে সেখানে নিশ্চয়ই নাচগান-ফ্যামেলি ড্রামা বা নায়ক-নায়িকার অন্তরঙ্গ দৃশ্য দিয়ে সিনেমা শেষ হবে না, হামলা কীভাবে ঘটেছিল, সেটাই তুলে ধরা হবে, হামলার ভয়াবহতাটাকে সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলবেন নির্মাতা। ভারতের সেন্সর বোর্ড নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে, কিন্ত তারাও কখনও এসব সিনেমাকে জোর করে আটকে দেননি, কারণ এই কালচারটা সেখানে নেই।

অথচ আমাদের দেশে প্রথার বাইরে গিয়ে কিছু করতে চাইলে নির্মাতাদের সবচেয়ে বড় বাধার মুখে পড়তে হয় ওই সেন্সর বোর্ডেই। এই দেশে সমালোচনা করা নিষিদ্ধ, সিস্টেমের ভুল নিয়ে লেখালেখি করা নিষিদ্ধ, ধর্মের ভুলভ্রান্তি নিয়ে লিখলে এখানে কোপ খেয়ে মরে পড়ে থাকা লাগে, জঙ্গী হামলার ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানালে সেটা আটকে থাকে নিষিদ্ধের বেড়াজালে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, উত্তর কোরিয়া হবার দিকে কি এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? 

পাদটীকা- ২০১৫ সালে ব্লগার হত্যার মহোৎসব যখন চলছিল, তখন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছিলেন, নাস্তিকতার চর্চা করার চেয়ে ঢ্যাঁড়শ চাষ করা ভালো। তার উদ্দেশ্য যাই থাকুক, সেই লেখার সুরে ব্লগার হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাকে লঘুকরণের একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। ফারুকী সেদিন শিরদাঁড়া সোজা করে বলতে পারেননি যে, একটা মানুষ ভালো-মন্দ কিছু একটা বললে সেটার শাস্তি হিসেবে তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলা যায় না, কথা বলার স্বাধীনতা প্রত্যেকটা মানুষের আছে, সেখানে হস্তক্ষেপের অধিকার কারো নেই, কোপ দিয়ে কণ্ঠস্বর থামিয়ে দেয়ার ভার কাউকে দেয়া হয়নি। 

ফারুকীর সেই ফেসবুক স্ট্যাটাস

আজ ফারুকীর সিনেমা যখন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেন্সরে আটকে আছে, তখন আমি সেই ব্যালেন্স করার পথে হাঁটলাম না। আমি ব্যক্তির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, নির্মাতার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে তথ্য অধিকার আইন সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা তাই জানতে চাই, কেন শনিবার বিকেল-কে ব্যান করা হলো। সিনেমার নির্মাণে যদি পরিচালকের কোন ভুল-ত্রুটি যদি থেকে থাকে, সেটা জানানো হোক। সুনির্দিষ্ট কোন কারণ না দেখিয়ে সিনেমার মুখ চেপে ধরার চেষ্টাটা খুব ভয়ঙ্কর, সেটা সরাসরি বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে দেয়ার মতোই জঘন্য একটা ব্যাপার। 

আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, গল্পটাকে যদি বিকৃত করা না হয়, তাহলে শনিবার বিকেলে সিনেমায় এমন কোন ভায়োলেন্স দেখানো হয়নি, যেটা গুলশানের হোলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া নৃশংস সেই ঘটনাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। আর তাই শনিবার বিকেলকে সেন্সর বোর্ডের জিম্মি দশা থেকে মুক্তি দেয়া হোক, এই দাবী জানিয়ে রাখলাম...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা