মানুষ মরলে মরুক, ঈদের শপিং মিস দেয়া যাবে না!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ইউরোপ-আমেরিকা এবার ইস্টার সানডে উদযাপন করেনি, খ্রিস্টার ধর্মাবলম্বীদের জন্যে এটা বড়সড় একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অথচ আমরা পড়ে আছি ঈদ উদযাপনে, মার্কেট খুলে দিচ্ছি, লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছি...
বাংলার ঘরে ঘরে আজ ঈদের আনন্দ। সরকারী ঘোষণা এসেছে, ঈদ উপলক্ষ্যে 'সীমিত আকারে' শপিং মল এবং বিপণী বিতান খোলা রাখা যাবে। মানুষ যাতে ঈদের কেনাকাটা করতে পারে, পারিবারিকভাবে যাতে ঈদের আনন্দটা উদযাপন করতে পারে- এজন্যেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হাততালি না দিয়ে উপায় আছে বলুন? করোনায় প্রাণ গেলে যাক, সংক্রমণ বাড়লে বাড়ুক, তবুও শপিং করা চাই! ঈদের জামা-জুতো না কিনতে পারলে বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়?
পুরো সিদ্ধান্তটা নিয়ে যে পরিমাণ সার্কাস হলো, সেটা একটা কমেডি ফিল্মের চেয়ে কম কিছু না। প্রধানমন্ত্রী জানালেন, সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সীমিত পরিসরে মার্কেট খোলা রাখা হবে। মন্ত্রীপরিষদের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হলো, বিকেল পাঁচটা নয়, চারটা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে বিপণি বিতান। রাত গড়ানোর আগেই আবার খবর এলো, আগামীকাল নয়, ১০ই মে থেকে খুলছে শপিং মল, সময় সেই দশটা-চারটাই। এই সিদ্ধান্তগুলো কারা নেয়? কেন নেয়? এতবার অদল-বদল করা লাগে কেন? এটা কি সরকারী সিদ্ধান্ত, নাকি হুমু এরশাদ, এতবার ভোল পাল্টায়!
আজ বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দশ হাজার পেরিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেদিন রোগীর সংখ্যা দশ হাজার ছুঁয়েছিল, সেদিন তারা প্রোপার লকডাউনের পথে হেঁটেছে। বৃটেন মেট্রো বন্ধ করেছে, রাস্তায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। আর আমরা কি করলাম? ঈদ উপলক্ষ্যে বিপণী বিতান আফ শপিং মলগুলো খুলে দেয়ার আদেশ দিলাম। এই ক্রান্তিকালে বেঁচে থাকাটা যখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তখন মার্কেট খুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত যে কতটা আত্মঘাতি- সেটা কি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারছেন?
গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের সংখ্যাটা ছয়শোর নিচে নামছেই না। গত ২৪ ঘন্টায়ও করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৬৮৮ জন। পরীক্ষার সংখ্যা যতো বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। এই তো, দুই তিনদিন আগের কথা, নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘন্টায় ১৬০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, এর মধ্যে ১৫০ জনেরই রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে! সংক্রমণের হার কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে- সেটা বুঝে নিতে আমাদের কষ্ট হয় না, কিন্ত যারা সিদ্ধান্তগুলো নেন, তাদের কেন এসব মাথায় ঢোকে না, সেটা তারাই ভালো জানেন।
প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, জনগণকে ঈদের কেনাকাটার সুযোগ দিতে। ঈদের কেনাকাটা করাটা কি এতই জরুরী? বিশেষ করে এই ক্রাইসিস মোমেন্টে? বেশিরভাগ মানুষজনের হাতে টাকা নেই, সামনে অনিশ্চিত একটা সময়, অনেকেই চাকরি হারিয়ে ফেলেছেন, কেউবা হারানোর অপেক্ষায় আছেন- এই সময়ে শপিং করার মানসিকতা কার আছে? যাদের আছে, তাদের সংখ্যাটা কত? অল্প কিছু মানুষকে তুষ্ট করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনার কি কোন দরকার ছিল? হ্যাঁ, লোকজন চাল-ডাল কিনতে পারে ঈদ উপলক্ষ্যে, সেমাই-জর্দাও কিনতে পারে- সেগুলোর জন্যে তো মুদি দোকান এবং বাজার খোলা আছেই। বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে শপিং মল কেন খুলতে হবে?
অনেকেই বলবেন, দোকানদার এবং কর্মচারীদেরও তো ঈদ করতে হবে, তাদেরও সংসার চালাতে হবে। সত্যবচন। তাহলে এই একটা মাসের জন্যে, বা এই ঈদের জন্য তাদের রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার আওতায় আনা যেতো না? রক্তচোষা গার্মেন্টস মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়ে কি লাভ হয়েছে সেটা আমরা দেখেছি, চাকরির হুমকি দেখিয়ে তারা অসহায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের শত শত কিলোমিটার হাঁটিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় এনেছেন, আবার ঢাকা থেকে বাড়িতে পাঠিয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকারের জন্যে চার হাজার কোটি টাকা নাকি কোন টাকাই না। তাহলে বিপনী বিতানের ব্যবসায়ীদের তালিকা করে প্রত্যেককে অল্প একটা অংক প্রণোদনা হিসেবে দেয়া যেতো না এই ঈদে?
আর এই 'সীমিত আকারে' শব্দটার মানে কী? সরকারের কি ধারণা, করোনাভাইরাস ভার্সিটির ব্যাকবেঞ্চারের মতো সারাদিন ঘুমায় আর সারারাত জেগে থাকে? সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত করোনা নিষ্ক্রিয় থাকবে- এই উদ্ভট আইডিয়া কার মাথায় এসেছে কে জানে! বিপণী বিতানগুলোর প্রবেশ পথে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা সহ স্যানিটাইজার রাখতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্ত নিউমার্কেট বা গাউছিরা মতো জায়গায় সেটা কীভাবে সম্ভব? আমাদের মতো আইন অমান্যকারী জাতি এসব নির্দেশনা মেনে চলবে- সেটাই বা সরকার কী করে ভাবলো?
শপিং মল যদি খুলেই দেবেন, তাহলে মানুষকে ঘরে থাকতে বলার আর মানে কী? দলে দলে সবাইকে বেরিয়ে আসার আহবান জানান, লকডাউন তুলে দিন, গাড়িঘোড়া চালু করুন। ব্যবসায়ীরা বেঁচে থাকবেন, পরিবহন শ্রমিকেরা তাহলে কি দোষ করলো? ইউরোপ-আমেরিকা এবার ইস্টার সানডে উদযাপন করেনি, খ্রিস্টার ধর্মাবলম্বীদের জন্যে এটা বড়সড় একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অথচ আমরা পড়ে আছি ঈদ উদযাপনে, মার্কেট খুলে দিচ্ছি, লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছি। বেচারা করোনাভাইরাসও বাংলাদেশে এসে ব্যাক্কল হয়ে গেছে, এতসব উল্টোপাল্টা নিয়ম-কানুনের বহর দেখে। হাসির চোটে ঠিকমতো ছোবলও মারতে পারছে না সে।
সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা। সরকারী সিদ্ধান্তের ভুলে এই ঈদ যেন কারো শেষ ঈদ না হয়, সেই কামনাই করি...