শিপন মিয়ার বস্তির মানুষদের মধ্যে ভাবান্তর হয়নি কোনো। কেউ কিছু না জানার একটা সুবিধা আছে, অন্তত নিশ্চিন্তে মরা যায়। দুশ্চিন্তা করে বেঁচে থাকার চেয়ে নিশ্চিন্তে মরা ভালো।
শিপন মিয়ার কন্যার নাম বাতাসি, পুত্রের নাম বাতাসা। ছেলেমেয়েদের নাম মিলিয়ে রাখার এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। তারা ছিলেন তিন ভাই। রিপন- শিপন- দিপন। দিপন মারা গেছে বাসের চাকার নিচে। রিপন মিয়া যাচ্ছি যাচ্ছি করেও যাচ্ছেন না। তাদের তিন ভাইয়ের গ্রামে যতটুকু সম্পত্তি ছিল, জোর করে দখল করে খাচ্ছেন।
শিপন মিয়া থাকেন ঢাকার গুলশানে। আলিশান ফ্ল্যাটের পাশের লেকে যে বস্তি আছে সেখানে। লাইফ র্যাফট দিয়ে বানানো নৌকায় তারা খাল পাড়ি দিয়ে লিংক রোডে গিয়ে উঠেন। উঠেই তিনি চলে যান তার দোকানে। একটা চায়ের দোকানের সে হেল্পার। ইনকাম অতি সামান্য। তার বউ করে ছুটা বুয়ার কাজ। দুইটা ব্যাচেলর পরিবারে সে রান্না করে। দুই বাসা মিলে খাদ্য খায় ১১ পেট। এক পেটের বিল ৫০০ টাকা। শিপন মিয়ার বউ সুরেহা মানুষের হিসাব করেন না, পেটের হিসাব করেন। তার ধারণা পৃথিবীতে পেট ছাড়া আর কোনকিছুর দাম নেই।
বাতাসির বয়স তের। এই বয়সে অন্তত ক্লাস ফাইভ পাশ করার কথা ছিলো। কিন্তু সে এখনও বাল্যশিক্ষার পাঠ নেয় পথশিশুদের স্কুলে। বাতাসার বয়স প্রায় তিন বছর। এখনও মায়ের দুধ দেখলে হুঁশ থাকে না। চামড়া চাটে শুধু, দুধ বের হয় না। আটা দিয়ে সুজি রান্না করে দিলেও খেতে চায় না। মাংসের টুকরা দিয়ে ভাত মেখে দিলে মুখ খোলে।
দেশে করোনা আসার খবর তাদের বস্তিতে যেতে সময় লাগলেও শিপন মিয়ার কান পর্যন্ত আসতে সময় লাগলো না। চায়ের দোকান হলো চলমান সংসদ ভবন। সেখানে আধাঘণ্টা থাকলে দেশের সব খবর জানা যায়। শিপন মিয়া সারাদিন থাকেন। এজন্য তিনি আরও এডভান্সড। মোটামুটি আট-দশটা দেশের রাষ্ট্রপতির নাম তার মুখস্ত। চায়নার পর ইতালির মৃত্যুর খবরও তার জানা।
তার বস্তির মানুষদের মধ্যে ভাবান্তর হয় নি কোনো। কেউ কিছু না জানার একটা সুবিধা আছে, অন্তত নিশ্চিন্তে মরা যায়। দুশ্চিন্তা করে বেঁচে থাকার চেয়ে নিশ্চিন্তে মরা ভালো।
তবে কেউ কিছু না জানার একটা ভয়াবহ অসুবিধা আছে। তখন হুট করে থানকুনি পাতার খবর ভেসে আসে। সুরেহা বেগম নিজেও থানকুনি পাতা জোগাড় করেছিলেন। ছেলে মেয়েদের খাইয়েছেন। তবে শিপন মিয়া খান নি। চায়ের দোকানে আসা ভদ্রঘরের ছেলেদের মুখে তিনি শুনেছেন এই রোগের কোনো ওষুধ বের হয় নি। আমেরিকাতেও মানুষ মারা যাচ্ছে ওষুধ না পেয়ে। থানকুনি পাতার ওষুধ তাই তার বিশ্বাস হয় নি। নিজে লেখাপড়া না জানলেও লেখাপড়া করা মানুষদের কথাবার্তা তিনি সম্মান করেন।
তবে তার মধ্যে ভয়াবহ ভয় ঢুকে গেলো দোকান বন্ধ করার ঘোষণা আসার পর। তার স্ত্রীকেও রান্না করতে যেতে না করে দিয়েছে ভদ্রলোকেরা। তারা সবাই গ্রামে চলে যাচ্ছে। বস্তির মধ্যেও গ্রামে চলে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। সবাই বলাবলি করছে ঢাকা থাকলে মরার চান্স বেশি। সব করোনা রোগীর হাসপাতাল ঢাকাতে। সবার সাথে ব্যাগ গুছিয়ে শিপন মিয়াও তার পরিবার সহ রওনা হলেন। তবে বেশিদূর যেতে পারলেন না। বাস-ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে। বাস স্ট্যান্ডে ছয় ঘন্টা বসে থাকার পর সাত নম্বর ঘন্টায় একটা কনটেইনার লাগানো কাভার্ড ভ্যান পেছনের গেট খুলে দিলো। শিপন মিয়ার পরিবারের মতো প্রচুর মানুষ সেখানে উঠে পড়লো। ঘামের গন্ধে আর গরমে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। শিপন মিয়া শুনেছে করোনা হলেও নাকি এভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়।
বাড়িতে তাদের কোনো ঘর ছিলো না। পাকের ঘরের দেয়ালে আরও তিনটা শক্ত পলিথিন লাগিয়ে কোনমতে বাতাস- বৃষ্টি আটকানোর ব্যবস্থা করা গেলো। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার সময়ে তাদের পারিবারিক দূরত্ব আরও কমলো। বস্তির ঘরের চেয়েও ছোট ঘরে তাদের গাদাগাদি করা নতুন জীবন শুরু হলো।
শিপন মিয়ার পকেটে ১৭ শ টাকা ছিলো। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হয়েছে এক হাজার। আর ৭০০ টাকা তাদের শেষ ভরসা। বড় ভাইয়ের সংসার তাদের খাবার দিলো না। রান্না করার দুটো পাতিল আর ভাত খাওয়ার দুটো প্লেট দিলো শুধু। তাদের পরিবারও অসচ্ছল। চাল ছাড়া তাদের ঘরে অতিরিক্ত কোনো খাবার থাকে না। দুদিনের জন্য বাজার আর এটা সেটা কিনতে গিয়ে শিপন মিয়ার সাড়ে চারশো টাকা শেষ।
গ্রামের বাচ্চাদের সাথে বাতাসি কুতকুত খেলে। বাতাসাকে কোলে নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে থাকে। দেশে আর্মি নামার খবর শুনে বাপের কাছে আর্মি দেখার বায়না ধরে। মেয়েকে নিয়ে আর্মি দেখতে গেলেন শিপন মিয়া। অনেকের কাছেই আর্মির মার খেয়ে ফেরার গল্প শুনলেন। তবে নিজে ফিরলেন মানুষের পাড়া খেয়ে।
ঠিক আড়াই দিন পর তাদের ডাল শেষ হলো। তিন দিন পর চাল। ক্ষেতেও কেউ কাজে নিচ্ছে না। মানুষের বাড়িতেও কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের আয়ের কোনো উৎস নেই। মোড়ের দোকানের টিভিতে খবরে তিনি দেখলেন সরকারি রিলিফ আসার কথা। গরিব মানুষজন বলাবলি করছে এই রিলিফ যেন আর্মির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। সিভিলিয়ানে তাদের বিশ্বাস উঠে গেছে।
দুই তিনটা কোম্পানির রিলিফ আনতে গিয়ে পনের বিশটা ছবি তুলতে হলো তাদের। শিপন মিয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে সেই ছবিতে হাসির পোজ দিলো বাতাসি। তাকে সাইড করে দুঃখী চেহারার সবাইকে নিয়ে আলাদা ফটোসেশন করা হলো। তারপর চাল না দিয়ে তারা চলে গেলো।
সরকারি চাল আসার খবর শুনে এলাকার মেম্বার হাওয়া হয়ে গেছে। চালের বস্তাও এলো না, মেম্বারও না। গ্রামের বিত্তশালী কিছু পরিবার থেকে দুই পলিথিন চাল ডালের প্যাকেট পেয়ে তাদের আরও দুদিন চললো এভাবে।
মাংস দিয়ে খুব ভাত খেতে চাইলো বাতাসা। বাতাসির আবার মাছ পছন্দ। তবে খেতে হলো ডাল আর বেগুন ভর্তা দিয়ে। সুরেহা বেগম মেপে মেপে ভাত বাড়েন। কেউ না খেতে পারলে পাতিলে তুলে রাখেন।
বড় ভাইয়ের সাথে ভাগের জমি নিয়ে প্রায় হাতাহাতি করে খালি হাতে ফিরেছেন শিপন মিয়া। কাজ করার জন্য বন্ধ দোকানে দোকানে ঘুরেছেন। গ্যারেজ থেকে রিকশা নিতে চেয়েছেন। কোনটাই পান নি। এই দুর্দিনে নতুন করে কিছুই শুরু করা যায় না।
ঢাকা ফেরত গ্রামের শিক্ষিত ঘরের ছেলেরা তবুও প্রায়ই কিছু না কিছু খাবার পৌঁছে দিচ্ছে সবার ঘরে। একদিন পুলিশের স্যাররা এসে খাবার দিয়ে গেলো। তবুও সে খাবারে জীবন চলে না। সাবান ছাড়া হাত ধোয়া হয় না। সুতির মাস্ক দিয়ে ভাইরাস ঠেকানো যায় না। ময়লা জমতে জমতে সে মাস্কের কালার চেঞ্জ হয়ে যায়।
শিপন মিয়ার মাথায় দ্বিতীয়বার আকাশ ভেঙে পড়লো বাতাসির কাশির শব্দে। তৃতীয়বার আকাশ ভেঙে পড়লো বাতাসি যখন বললো, বাজান! শাস লইতে আমার এরুম কষ্ট হইতেছে কিল্লেইগা? শিপন মিয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বল সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে দিলেন। জ্বর মাথায় পানি ঢেলে দিলেন। ভেজা গামছা দিয়ে গলা মুছে দিলেন।
তার চায়ের দোকানে বসে তিনি করোনার লক্ষণ শুনেছিলেন সবার মুখে মুখে। সেসবের সাথে তিনি তার মেয়েকে মেলাচ্ছেন। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। নিজেরও হয়ত শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
করোনা হওয়া রোগীদের কাছে কেউ নাকি যাচ্ছে না। তাদের কবর দিতে দিচ্ছে না। কিন্তু শিপন মিয়া তো মেয়েকে কোল থেকে নামাতে পারছেন না। সম্পর্কের টানের কাছে একটা ভাইরাসকে তার তুচ্ছ মনে হয় খুব।
সুরেহা বেগম চুলায় গরম পানি জাল দিচ্ছেন। গরম পানি খেলে ভাইরাস ভালো হয় তিনি শুনেছেন। মেয়েকে তিনি গরম পানি খাওয়াবেন। বড় ভাইয়ের বউ লুকিয়ে এক আঁচল চাল দিয়ে উঠানে একটা দাগ দিয়ে গেছেন। বলেছেন, অসুস্থ পুলাপান নিয়া এই দাগ পার হবা না।
মেয়ের জ্বর আরও বাড়ার পর শিপন মিয়া নাপা ট্যাবলেট নিয়ে এলেন। কাশির সিরাপ নিয়ে এলেন। তার হাতে অবশিষ্ট থাকলো আর ৩৫ টাকা। রাতের অন্ধকার কমে আসা শুরু হলো। তবে বাতাসির জ্বর কমলো না। "বাজান আমারে জাপটাইয়া ধরো" বলে সে ধরে থাকলো তার বাবাকে।
অটো, ভ্যান কিছুই চলে না। মেয়েকে কাঁধে করে নিয়ে শিপন মিয়া গেলেন হাসপাতালে। তবে তার মেয়েকে ভর্তি করাতে পারলেন না। জ্বর ঠাণ্ডার রোগী কেউ ভর্তি নিচ্ছে না। শিপন মিয়াকে তারা টেস্ট করে আসতে বললেন। হাসপাতালের ফ্লোরে মেয়েকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন তিনি। তার চোখ থেকে পানি বের হয়ে পড়লো ফ্লোরে। তারা চলে যাওয়ার পর ডিসইনফ্যাক্ট স্প্রে করে সেই পানি মুছে ফেলা হলো।
বাড়ি ফেরার পথে দুই পিস কমলা কিনলেন শিপন মিয়া। বাড়ি ফিরে মেয়েকে পায়ের উপর বালিশে শুইয়ে দিয়ে কমলার খোসা ছাড়িয়ে মুখে তুলে দিলেন। বাতাসির চোখ দিয়েও পানি বের হলো। সেই পানির দিকে তাকানো যায় না। কমলার খোসার চেয়েও ঝাঁঝ বেশি। তাকালে চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
বিকেলের পর বাতাসির জ্বর ছাড়লো। ঘামে জামা ভিজে গেলো। জামা খুলে গা মুছে দিলেন সুরেহা বেগম। শিপন মিয়া এমপির দেয়া রিলিফ নিয়ে ফিরলেন ঘরে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শরীরে বল ফিরে পেলেন। কোথা থেকে যেন একটা লেবু এনেছে সুরেহা। লেবু চিপে ডাল দিয়ে ভাত মেখে খাওয়ালেন মেয়েকে। আচল দিয়ে ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা ডাল মুছে দিলেন।
খাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলেন শিপন মিয়া। পাটির বদলে গামছা বিছানো হয়েছে। কড়ই গাছে হেলান দিয়ে বসে মেয়েকে জড়িয়ে রেখেছেন কোলের মধ্যে। খুব গরম লাগছে বলে ভালো লাগছে তার। তিনি শুনেছেন গরমে ভাইরাস টিকতে পারে না।
তখন মধ্যরাত! ঘুম ভেঙে গেছে বাতাসির। তার খিদা লেগেছে। জ্বরের মুখে রুচি ফিরে এলে খিদে লাগে খুব। মেয়ের নড়াচড়া দেখে অন্ধকারেও ঘুম ভেঙে গেলো শিপন মিয়ার। পুকুরপাড় ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে এসে ঘরের খামে হেলান দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ঘুম ভাঙা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর নেই। বাতাসি উঠে বসে আবার একটু ঝুঁকে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। শিপন মিয়া মেয়ের পিঠ জড়িয়ে ধরলেন।
মেয়েকে বললেন, ডর লাগেরে মা? বাতাসি বললো, লাগে বাজান। শিপন মিয়া বললেন, ভাইরাসরেও ডরাও? বাতাসি বললো, না বাজান। শিপন মিয়া অবাক হয়ে বললেন, তাইলে কীরে ডরাও? বাতাসি বললো, খিদারে। আমার যদি কহনও খিদা না লাগতো তাইলে আমি কোনো ভাইরাসরেও ডরাইতাম না বাজান...