সুখী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতাই কি আমাদের অসুখী হওয়ার মূল কারণ?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
শো-অফ ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে এক্সপেক্টেশন বাড়িয়ে দেয়। অন্যের শো-অফের জীবন দেখে এক সময় জড়িয়ে গেলেন সম্পর্কে, চলে আসলেন এক ছাদের নিচে। বেশ কিছুদিন পর দেখা গেল সেই জীবন আর এই জীবন তো এক না...
সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত জীবনে শো-অফ করাকে আমার কাছে চিনির মতো মনে হয়। চিনি খেতে মিষ্টিই লাগে, কারো কাছেই তিতা মনে হবে না। কিন্তু যদি ভুলে কেউ ডায়াবেটিস বাধিয়ে বসে, চিনির স্বাদ যতই মিষ্টি হোক, সেটা কিন্তু তখন বিষ হয়ে যায়।
এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে চারপাশে অজস্র মানুষকে সুখী হবার এক অসম্ভব কম্পিটিশন করতে দেখি। নিজের জীবন অন্যের চেয়ে ভালো, নিজের সঙ্গী অন্যের চেয়ে বেশি সুন্দর-যোগ্য, নিজের চাকরি অন্যের চেয়ে ভালো, বাসা ভালো, পোশাক ভালো এমনকি নিজের পাতের খাবারটাকেও অন্যের চেয়ে বেটার দেখানোর কী প্রাণান্তকর চেষ্টা চোখে পড়ে!
বলবেন, কেউ যদি নিজেকে বেটার প্রমাণ করতে চায় তাতে কার ক্ষতি হলো? না, তাতে কারোরই ক্ষতি হলো না। ক্ষতি যদি হয় তবে সেটা যে শো অফ করল তার হবে।
শো-অফ ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে এক্সপেক্টেশন বাড়িয়ে দেয়। আপনি যখন একটা দামী পোশাক পরে সেটাকে অনভিপ্রেতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শো করলেন, আপনার প্রতি মানুষের এক্সপেক্টেশন বেড়ে গেল। শুনতে সিলি শোনাবে, তাও বাস্তবতা হচ্ছে হয়তো আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী এই দামী পোশাকটি দেখেই আপনার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে গিয়েছে। ক্যামেরা-এ্যাপে নিজেকে সময় নিয়ে সুশ্রী বানিয়েছিলেন, সেটাই হয়তো কাউকে প্রভোক করে ফেলেছে। প্রেম বা সংসার জীবনে সঙ্গী অনেক ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার চার্মিং ও স্মার্ট লাইফ স্টাইল দেখেই নির্বাচন করা হয়। প্রেম খুব কম ক্ষেত্রেই সরাসরি স্বর্গ থেকে আসে।
এক সময় জড়িয়ে গেলেন সম্পর্কে, চলে আসলেন এক ছাদের নিচে। বেশ কিছুদিন পর দেখা গেল সেই জীবন আর এই জীবন তো এক না। এখানে ক্যামেরার ফাংশান- এ্যাপ ব্যবহার করে সুন্দরী হওয়া যাচ্ছে না। এখানে প্রতিদিনই দামী পোশাক পাওয়া যাচ্ছে না। মাইডের ছবির খাবারের মতো খাবার রান্না হচ্ছে না।
কেবল বস্তুগত ব্যাপার না, আচরণ ও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেও অনেক সময় পার্থক্য ধরা পড়ে। যে মেয়ে কবিতা ছাড়া কোনো ছবি আপলোডই দিত না, দেখা গেল সে আসলে কবিতার কিছুই বোঝে না। জীবনানন্দকে স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভেবে সে বসে আছে। মোটিভেশনের থুবড়ি ছোটানো ছেলে হয়তো তরকারিতে লবণ কম হলেই চিল্লাপাল্লা শুরু করে।
এক সময় এক্সপেক্টেশন ভেঙে একাকার হয়ে যায়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় শো-অফ করা জীবন ও বাস্তবের যে জীবন তার বিয়োগফল হিসেবে অনেক সময় বিচ্ছেদ আসে। এটা জেনারালাইজড থিওরী না। সবার শো অফের রেজাল্ট নেগেটিভ আসে তাও না। শো অফের সাথে রিয়েল লাইফের পার্থক্য সব ক্ষেত্রে ঘটেও না।
কিন্তু কিছু মানুষের সাথে এই ব্যাপারটা অবশ্যই ঘটে। শবনম ফারিয়াকে আমি চিনি না, উনার ডিভোর্সের কারণ ব্যাপারে আমার আইডিয়া নাই। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় বেশ কিছু মানুষকে কেবল এক্সপেক্টেশন ভেঙে যাবার কারণেই বিচ্ছেদ করতে দেখেছি। আরো কিছু মানুষ এখন বিচ্ছেদের চূড়ান্ত সীমায় আছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় সম্পর্কের শো-অফে কিছুটা সময় নেয়া উচিত। কাউকে চূড়ান্তভাবে বোঝার আগেই "আমরা অমরসঙ্গী" টাইপ সিদ্ধান্তে আসা উচিত না। সিদ্ধান্তে আসলেও ঘটা করে অহেতুক জানান দেয়ার দরকার নেই। বিয়ের এক ত্রিশ দিনের মাথায় সঙ্গীর কাঁধে মাথা রেখে ষাটটা ছবি আপলোড দিলেন ফেসবুকে, লোকে জানল আপনার ভীষণ সুখী। কয়েকশ শুভেচ্ছা কমেন্ট পেলেন৷ এই কমেন্টগুলোই বুকের ওপর ভার হয়ে যাবে যখন আরো পনের দিন পর তীব্র ঝগড়া হবে আপনাদের মাঝে। বারবার মনে হবে, এই যে ঝগড়া করতেছি- লোকে জানলে কী হবে? লোকে তো জানে আমরা সুখের সাগরে ভাসছি।
সম্পর্কে হতাশা, অবিশ্বাস, ভুল-বোঝাবুঝি সবই বাস্তবতা। কিন্তু এসব কিছু সব সময় বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট না যদি না আপনার ওপর বাড়তি কোনো বোঝা না থাকে। সেই বাড়তি বোঝাটাই হলো শো-অফজনিত ভার। নিজে তিনশ গ্রাম সুখী, কিন্তু বাইরে তিনশ কেজি সুখ দেখালে বাড়তি চাপ তো আসবেই।
আমার ব্যক্তিজীবনে অনেক ইমম্যাচিউরিটি আছে। কিন্তু অন্তত একটা জায়গায় আমি অনেক আগে থেকে ম্যাচিউর। এই শো-অফকে আমি জীবনে কখনো জায়গা দিইনি। হ্যাঁ, শো-অফের এলিমেন্ট আমার কাছে খুব একটা নাই। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাইলে তো শো-অফ করাই যায়। আমি এই পথে কখনো যাইনি। শো-অফ না করার কারণে বহু লোকের কাছে ক্ষ্যাত উপাধী পেয়েছি, কিন্তু একটা লাভ অন্তত হয়েছে। নিজের ওপর বাড়তি চাপ কখনো অনুভব করি না।
আমি চাইলেই যেকোনো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে পারব, কারণ কেউ আমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়া নিয়ে শো-অফ করতে দেখেনি।
জীবনে দুর্দিন আসলে আমি ছেঁড়া ফাঁটা জামা নির্দ্বিধায় পরতে পারব, কারণ কখনো বোঝাইনি আমি দামী জামা পরে অভ্যস্ত। ফেসবুকে ঘষামাজা করে প্রো পিক না দিয়ে যা ইচ্ছা তাই দিই, তাতে অন্তত রিয়েল লাইফে আমাকে দেখে কেউ চোখ কপালে তুলে না বলে- এইটারে কী ভাবতাম আর কী দেখা যায়! এমনকি ফেসবুকে মানুষ হিসেবে আমাকে যেমন দেখা যায়, হলফ করে বলতে পারি বাস্তব জীবনে আমাকে তারচেয়ে বেটার হিসেবেই পাওয়া যাবে।
দুইটা ব্যাপার ক্লিয়ার করি।
ডিভোর্স বা সম্পর্কের বিচ্ছেদ হিসেবে একমাত্র কারণ হিসেবে আমি শো-অফকে দায়ী করছি না। বহু কারণ আছে জানি। আমি কেবল বিচ্ছেদের এই একটা কারণ নিয়েই বলতে চেয়েছি।
আর পরিমিত শো-অফকে আমি নেগেটিভভাবে দেখিও না। আমার ব্যক্তিগত জীবন অনেক বেশি রেস্ট্রিক্টেড করে রাখি, এই প্যারামিটারে অন্যকে মাপছি না।
আমি কেবল চাই, মানুষ নিজে যা সেটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করুক। অন্য কেউ সুখী বলে আমাকে জোর করে সুখী প্রমাণ করার দরকার নেই। আমার জীবন আমার। আমার সুখ আমার, দুঃখটাও আমারই। অন্যের সাপেক্ষে নিজেকে মাপার কোনো কারণ দেখি না।
সত্যিই যদি সুখে থাকিও- সেটাকে এত বেশি জানান দেবার তো দরকার নেই। খুব তাড়াহুড়ো করে জানানোরই বা কী প্রয়োজন? এত হাপিত্যেশ কেন? সুখ প্রকাশ না করলে পালিয়ে যাবে এমনও তো না। কিছু জিনিসকে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলেই বরং সেটা আরো বেশি সুন্দর হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার পরিপাটি ও স্মার্ট জীবনের সাথে বাস্তব জীবনের মিল থাকুক। ক্যামেরার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময়ের হাসিটা বাস্তব হোক৷ ছবির ক্যাপশন বা পোস্টগুলো নিছক ধার করা বাক্য না হোক।
সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ- টিভিতে প্রচার হওয়া একটা বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইনের মতোই হোক যার যার জীবন। সুখ মন-শরীর ও জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা মাল্টিফ্যাক্টরাল আউটকাম। প্রতিযোগীতা করে সুখী হওয়ার ভান করা যায়, সুখী হওয়া যায় না। বরং ক্ষতি যেটা হয়- ত্রিশ কেজি ওজন তোলার সাধ্য যার সে যদি তিনশ কেজি ওজন জোর করে তুলতে যায়...তখন মাজা বা বুকের পাজর তো ভাঙবেই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন