উত্যক্তকারীর বাম্পার ফলন: দেশের সীমানা পেরিয়ে আমাদের 'সুনাম' এখন বিদেশেও!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সেলিব্রেটিদের নিয়ে নোংরামি করতে করতে নিজের দেশের সীমা ছাড়িয়ে ভারত পর্যন্ত ধাওয়া করেছে বঙ্গসন্তানেরা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, হাইকমিশনে অভিযোগ আসছে- এগুলো তো আমাদের জন্য ভীষণ গর্বের অর্জন, তাই না?
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চ্যাটার্জীকে অশালীন এবং কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠানোর দায়ে খুলনা থেকে মাহাবুবুর রহমান নামের এক যুবক গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে শ্রাবন্তীর ব্যাক্তিগত নম্বরে আজেবাজে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে- এরকম খবর প্রকাশিত হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেলিব্রেটিদের এরকমভাবে উত্যক্ত করাটা নতুন কিছু নয়। কিন্ত শ্রাবন্তীর ঘটনায় বিষয়টা এত বাজে পর্যায়ে গিয়েছে যে, শ্রাবন্তী বাধ্য হয়ে ভারতীয় হাইকমিশনে পর্যন্ত অভিযোগ করেছেন! সেকারনেই পুলিশ উদ্যোগী হয়ে বিষয়টা তদন্তে নেমেছে, এবং খুলনা থেকে মাহবুবুর রহমান নামের সেই উত্যক্তকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।
সেলিব্রেতিদের ফেসবুক পোস্টের কমেন্টবক্সে বা ইনবক্সে গালাগালি করে নিজেদের বংশপরিচয় রেখে আসা কুলাঙ্গারদের নিয়ে এর আগেও অজস্রবার এগিয়ে চলো স্বোচ্চার হয়েছে, নোংরা আচরনের প্রতিবাদ আমরা করেছি সাধ্যমতো। জয়া আহসান বা মিথিলা থেকে শুরু করে সৃজিত, শমি কায়সারের বিয়ে থেকে ক্রিকেটার সানজিদার বিয়ের ছবিতে বাজে মন্তব্য করা লোকগুলোর সমালোচনা আমরা করেছি। খুব স্পষ্ট ভাষায় আমরা বলার চেষ্টা করেছি, সেলিব্রেটিদের গালাগালি করার অধিকার কারো নেই, তারকা মানেই পাবলিক প্রোপার্টি নন।
এসব প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেরাও গালি খেয়েছি, আমাদেরকে দালাল বলা হয়েছে, প্রশ্ন এসেছে, কেন সেলিব্রেটিদের পোস্টের বাজে কমেন্ট নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা? আজ বুঝতে পারছেন, মাথাব্যথাটা কেন ছিল? সেলিব্রেটিদের নিয়ে নোংরামি করতে করতে নিজের দেশের সীমা ছাড়িয়ে ভারত পর্যন্ত ধাওয়া করেছে বঙ্গসন্তানেরা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, হাইকমিশনে অভিযোগ আসছে- এগুলো তো আমাদের জন্য ভীষণ গর্বের অর্জন, তাই না? ঠাট্টা-ফাজলামি ভেবে যে নোংরামিগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন আপনারা, বা মজার ছলে আশকারা দিয়ে দিয়ে বড় করেছেন, তাদের কীর্তিতে আজ বুক ফুলে উঠছে তো?
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটা পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে শ্রাবন্তীকে উত্যক্ত করার খবর। এমনকি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও জায়গা করে নিয়েছে এই খবর। শ্রাবন্তীর ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বর যোগাড় করে ওই নম্বরে বিভিন্ন সময় কল করতো মাহাবুবর রহমান নামের এই ব্যক্তি। শ্রাবন্তী অপরিচিত নম্বরের কল না ধরায় তাকে নানা ধরনের আপত্তিকর ও কুপ্রস্তাব লিখে মেসেজ দিতো মাহাবুব। একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে নায়িকা শ্রাবন্তী ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিচার চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তার ফলশ্রুতিতেই আজ গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাহাবুবকে।
আমি শতভাগ নিশ্চিত, এই লেখার কমেন্টবক্সেও কিছু মন্তব্য আসবে, শ্রাবন্তী নিজে তিনবার বিয়ে করেছেন, একটা সংসারও টেকেনি, তিনি একজন দুশ্চরিত্রা নারী- এসব উল্লেখ করে। বিশ্বাস করুন, একটা মানুষ তিনটা কেন, ত্রিশটা বিয়ে করলেও তাকে দুশ্চরিত্রা বলার অধিকার আমার-আপনার বা অন্য কারো নেই, যতক্ষণ না তিনি কারো ক্ষতি করছেন। পুরুষ সেলিব্রেটিরা তিন-চারটা বিয়ে করলে তো কারো মাথাব্যথা হয় না, তাহলে শ্রাবন্তী তিনটা বিয়ে করলেন নাকি চারটা করলেন, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার কি আমাদের? বড় ব্যাপার হচ্ছে তার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে একজন বাজে ব্যবহার করেছে, অশালীন আচরণ করেছে, সচেতন নাগরিক হিসেবে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। শ্রাবন্তীর আমলনামা ঘেঁটে বেড়ানোর দায়িত্ব কাউকে দেয়া হয়নি, সেই অধিকারও কেউ রাখে না।
আমাদের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশের যে কমনসেন্স বলে কিছু নেই, সেটার প্রমাণ পাবার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয় না, নিউজ বা মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর ফেসবুক পেজের কমেন্টবক্সে চোখ রাখলেই হয়। গায়িকা-অভিনেত্রী মিথিলা কাকে বিয়ে করলেন, যশোরের জনৈক তরুণী কেন মোটরসাইকেলে করে গায়ে হলুদের ছবি তুললেন, শমি কায়সার এই বয়সে এসে কেন বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন, জয়া আহসান কেন সিনেমায় 'খোলামেলা দৃশ্যে' অভিনয় করলেন, কিংবা একজন নারী কেন বোরকা পরে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেললেন- সব ইস্যুতেই বিচ্ছিরিভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করার জন্য একটা দল মুখিয়ে থাকে।
এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই আক্রমণের শিকার বেশিরভাগ সময় হন নারী সেলিব্রেটিরাই। এতদিন এটা দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল, এখন আমাদের নোংরামির নিদর্শন কাঁটাতার পেরিয়ে সীমান্তের ওপাড়েও চলে গেছে। কি অদ্ভুত আর বিচিত্র মানসিকতা নিয়ে বিচরণ করছি আমরা! এটা তো মজা করার মতো কিছু নয়, এটা স্পষ্টতই মানসিক বিকারগ্রস্থ আচরণ৷ সমস্যাটা সেলিব্রেটিদের মধ্যে না। সমস্যাটা আসলে আমাদের নিজেদের।
অনেকে বলে, সেলিব্রেটি হলে এসব তো একটু সইতেই হবে। সেলিব্রেটিদের গালাগালি করা যাবে, বাজে মন্তব্য করা যাবে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে- কোন সংবিধানে লেখা আছে এটা? আপনি অমুক সেলিব্রেটির নাটক-সিনেমা দেখেই যদি তার মাথা কিনে নিয়েছেন ভেবে থাকেন- তাহলে সমস্যাটা আপনার মাথার মধ্যেই। পাবলিক ফিগার আর পাবলিক প্রোপার্টি যে এক নয়, এই সহজ জিনিসটাই অনেকের মাথায় ঢোকে না।
আমরা ভেবে নেই, সেলিব্রেটিদের সঙ্গে বুঝি এমনই আচরণ করতে হয়! তাদের গালিগালাজ করলে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নোংরা কথা বললে হয়তো কিছুই হয় না৷ আসলেই কিছু হয় না, কেউ তো এসে বাজে কমেন্টের জন্যে আপনাকে শাস্তি দিচ্ছে না, গালাগালি করার জন্যে জরিমানা করছে না৷ আর তাই আমাদের কাছে এগুলো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা তো মজা পেলাম কমেন্টটা করে, তাই না? দু-চারশো লাইকও জড়ো করলাম হয়তো। নিজেদের মধ্যেই একটা ‘মুই কি হনুরে’ টাইপের ভাব চলে আসে এতে!
কিন্ত আমরা ভুলে যাই, সেলিব্রেটিরাও মানুষ, তারা অন্ধ নন। এসব মন্তব্যের অল্প কিছুও যদি তাদের চোখে পড়ে, কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের চোখে পড়ে, তাহলে তাদের কেমন লাগতে পারে, সেটা আমরা ভাবি না, আমাদের বোধশক্তি অতদূর কাজ করে না, কমনসেন্সের ওয়াইফাই জোন যে বড়ই সীমাবদ্ধ আমাদের! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একদল লাইফলেস মানুষ এগুলো করে বেড়াচ্ছে, তাও বুক ফুলিয়ে, আরেকদল এদের বাড়তে দিচ্ছে প্রতিবাদ না করে, ফোঁড়া হয়ে যাদের জন্ম হয়েছিল, তারা এখন ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। কোথায় কখন থামতে হয়, নিজেদের নোংরা নাকটা কোথায় গলাতে হয় আর কোথায় হয় না, সেটা আমরা জানি না, বুঝিও না। এই মানসিক বিকৃতির শেষ কোথায় সেটাও আমাদের জানা নেই...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন