'অসতী'র মিথ্যে অভিযোগ নিয়ে ছাড়লেন স্বামীর ঘর। জায়গা পেলেন না বাপের বাড়িতেও। বিশাল পৃথিবীতে কোলের শিশুকে নিয়ে নেমে এলেন, একা। সেখান থেকে এখন তাকে একনামে 'মাই' নামে চেনে সবাই। যার আছে হাজারের অধিক সন্তান আর অজস্র অরফানেজ, এনজিও আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান! এ গল্পের কিছু অংশ অমানবিক, কিছু অংশ অনুপ্রেরণার ও পুরোটাই ভালোবাসার!
একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে আছেন এক অল্পবয়স্ক মহিলা। বয়স বিশের দিকে। সাথে কয়েক মাসের মেয়ে। স্বামী আর বাবার বাড়ি, দুইখান থেকেই বের করে দেয়া হয়েছে তাকে। সাথে নেই একটা কানাকড়িও। কী করবেন এই বাচ্চাকে নিয়ে? দিশেহারা হয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। হয়তো স্রষ্টাকে খোঁজার আশাতেই। কিন্তু চোখ গেলো অশ্বত্থের এক ডালে। ডালের প্রায় পুরোটাই কেটে ফেলেছে কেউ। তাও এক অংশ এখনো মূল গাছের সাথে যুক্ত হয়ে ঝুলে আছে। ছায়া দিয়ে যাচ্ছে তার ও তার মেয়ের মাথায়। কী হলো কে জানে! মহিলাটি মুখে একটুখানি হাসি নিয়ে কোলের মেয়েকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভাবলেন, গাছের এই মুমূর্ষু ডাল যদি একেবারে শেষ সময়ে এসেও আমাকে ছায়া দিতে পারে। আমি কেন হতাশ হচ্ছি? নীরব বিপ্লব হয়ে গেলো একেবারে হুট করেই।
যাকে নিয়ে কথা বলছি, তাঁর নাম সিন্ধুতাই সপকল। হলফ করে বলতে পারি, সিন্ধুতাই এর পুরো গল্পটা যখন আপনি পড়বেন, এই মানুষটির জন্যে শ্রদ্ধায় আপনার মাথা আপনা আপনি নুয়ে আসবে। তাঁর জন্ম মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। এমন প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানে অশিক্ষা-কুশিক্ষা আস্তানা গেড়ে আছে আবহমান কাল ধরেই। আবর্জনা আর মেয়ে যেখানে সমার্থক শব্দ। সিন্ধুতাই এর জন্মের পরই তাই তাকে সমাজের 'যাচ্ছেতাই মানসিকতা'র বলি হতে হলো ক্রমশই। অপরাধ তো একটাই, মেয়ে হয়ে জন্মাতে হয়েছে। পড়াশোনার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মায়ের তীব্র বিরোধে পড়াশোনা হলোনা। বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েকে স্কুলেও পাঠালেন। কিন্তু মা যখন জানতে পারলেন এ ঘটনা, সিন্ধুতাইকে একরকম জোর-জবরদস্তি করেই বিয়ে দিয়ে দিলেন৷ তখন সিন্ধুতাই এর বয়স পনেরো। স্বামী তার চেয়ে বিশ বছরের বড়!
তাও মেনে নিলেন। এরপরেই ঘটলো এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। সিন্ধুতাই এর বয়স তখন বিশ। চতুর্থবারের মতন গর্ভবতী সে৷ বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় গুণ্ডাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে সোচ্চার হচ্ছিলেন। স্থানীয় এক গুণ্ডা তখন প্যাঁচ কষলেন। এলেন সিন্ধুতাই এর বাড়িতে। তাঁর স্বামীকে বললেন- 'সিন্ধুতাই এর গর্ভে যে সন্তান, সেটা তোমার না। সেটা আসলে আমার। এবং এই গ্রামের অনেকের সাথেই তোমার স্ত্রী'র অনৈতিক সম্পর্ক আছে।' এই সর্বৈব মিথ্যাচারের সবটুকুকেই বিশ্বাস করে নিলেন সিন্ধুতাই এর স্বামী। গর্ভবতী স্ত্রী'র পাকস্থলীতে বেধড়ক লাথি মারতে মারতে রক্তাক্ত করে অচেতন করে দিলেন তাকে। ভাবলেন, সিন্ধুতাই বুঝি মরেই গিয়েছে। একটু ঘাবড়ে গেলেন। টেনেহিঁচড়ে সিন্ধুতাইকে ফেলে দিলেন গোয়ালঘরের পাশে।
পরদিন সিন্ধুতাই এর বাচ্চা ভূমিষ্ট হলো। সেই গোয়াল ঘরেই। সিন্ধুতাইয়েরও ফিরে এলো জ্ঞান। সদ্যভূমিষ্ট সন্তানকে নিয়ে তিনি গেলেন বাপের বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও জায়গা পেলেন না। সেখান থেকেও প্রত্যাখাত হতে হলো তাকে।
এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা শুরু করলেন। সারাদিন ভিক্ষা করতেন। রাত কাটাতেন গোয়ালঘরে, শ্মশানে। এরকমভাবেই একদিন রাত কাটাতে গেলেন এক এতিমখানায়। সেখানে অনাথ বাচ্চাদের দুর্দশা দেখে ভাবলেন, এদের জন্যে কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কী করবেন তিনি? নিজেরই তো খেতে হয় ভিক্ষা করে! তাও বারোজন অনাথ বাচ্চার দায়িত্ব নিলেন তিনি। আগে যে সময়টুকুতে ভিক্ষা করতেন, এখন তার চার-পাচগুণ সময় ধরে ভিক্ষা করা শুরু করলেন। এরপর নিলেন আরো কিছু বাচ্চার দায়িত্ব। ভিক্ষা করতে লাগলেন প্রায় সারা দিন-রাত জুড়েই।
এভাবেই বেশ অনেক বছরের অমানুষিক চেষ্টার পর, স্বেচ্ছাসেবক ও শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের সহায়তায় তিনি অমরাবতীতে তাঁর প্রথম আশ্রম স্থাপন করলেন। একই জায়গাতেই স্থাপন করলেন তার প্রথম এনজিও। আস্তে আস্তে আশ্রম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। মহারাষ্ট্রে তাঁর নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলো এখন প্রতিদিনই হাজার হাজার অনাথ বাচ্চাকে দিয়ে যাচ্ছে আশ্রয়, শিক্ষা, খাবার। সেসব অনাথ আশ্রম থেকে বের হওয়া সন্তানেরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন স্থানে! এবং নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পরে তারাও নিচ্ছেন বিভিন্ন এনজিও ও আশ্রমের দায়িত্ব।
তাকে সবাই ডাকে 'মাই', মারাঠি ভাষার এ শব্দটির বাংলা অর্থ মা৷ এছাড়াও 'মাদার অব অরফানস' নামেও ডাকা হয় তাকে৷ ২০৭ জন মেয়ে-জামাই, ৩৬জন পুত্রবধু এবং ১০০০ জন নাতি-নাতনিদের নিয়ে তার বৃহৎ পরিবার এখন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তিনি পেয়েছেন অজস্র পুরস্কারও। পেয়েছেন- ভারতের মহিলাদের জন্যে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'নারী শক্তি এ্যাওয়ার্ড।' সুন্দর বিষয় হচ্ছে, পুরস্কারসূত্রে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তিনি নিয়মিতই নির্মান করেন নতুন নতুন অরফানেজ, স্কুল, এনজিও। তাঁর জীবনী অনুসারে নির্মিত হয়েছে মারাঠি ভাষার সিনেমা- 'মি সিন্ধুতাই সপকল।'
জন্মের পর তাকে ডাকা হতো ছিন্ধি। যার অর্থ- ছেঁড়া টুকরো কাপড়। তাকে গন্য করা হতো আবর্জনা হিসেবেই। এক সময়ে এসে হারিয়েছেন স্বামী, বাবা-মা সবই। সেখান থেকে উঠে এসে শুধুমাত্র ভালোবাসার জোড়ে গড়ে তুলেছেন এতগুলো প্রতিষ্ঠান। একটা মানুষ, শুধুমাত্র একটা মানুষ, যাকে নিগৃহীত করা হয়েছে সময়ের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে, তিনিই গড়ে দিয়েছেন ব্যবধান। এখন থেকে কেউ যদি বলতে আসে, একটা মানুষ কখনোই ব্যবধান গড়তে পারেনা, একটা মানুষ কখনোই পরিবর্তন আনতে পারেনা, তাদের সিন্ধুতাই সপকলের গল্পটি শুনিয়ে দেবেন, প্লিজ। আর কিছু বলতে হবেনা। কিচ্ছুনা।
বুকে অদম্য মনোবল আর প্রাণে নিখাদ ভালোবাসা থাকলে, পৃথিবীতে অসাধ্য বলতে নেই কিছুই। একেবারেই কিছু নেই। এই মানুষটিই তার প্রমাণ।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন