ইত্যাদি থেকে উঠে আসা তুমুল আলোচিত গায়ক আকবর আবারও এসেছেন সংবাদের শিরোনামে। মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। ডাক্তাররাও একটু একটু করে ছেড়ে দিচ্ছেন আশা।

সময়টা ২০০৩। খুলনায় জন্ম নেয়া ছেলেটি রিক্সা চালাতো কাছের শহর যশোরে। কন্ঠটা বেশ দরাজ ছিলো। রিকশায় ওঠা মানুষজনকে মাঝেমধ্যেই গান শোনাতো। এছাড়া বিভিন্ন প্রোগ্রামেও গান গাওয়ার ডাক পড়তো মাঝেমধ্যেই। এভাবেই একদিন যশোর এম এম কলেজের এক অনুষ্ঠানে গান গান তিনি। সে গান শুনে এক শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে চিঠি লেখেন ইত্যাদি'কে। হানিফ সংকেত জানতে পারেন যশোরের এক রত্নের কথা, যে লুকিয়ে আছে সবার চোখের অলক্ষ্যে। 

ইত্যাদির সে বছরেরই এক পর্বে মঞ্চে আসে ছেলেটি। কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত গান 'একদিন পাখি উড়ে' গেয়ে সবাইকে মাত করে দেয়। কিশোর কুমারের সাথে গলায় কোথায় যেন বড্ড বেশি মিল। যশোর-খুলনায় মোটামুটি পরিচিত ছেলেটি হয়ে যায় সারা বাংলাদেশেরই পরিচিত মুখ। গায়ক আকবর।

এরপর চিত্রনায়িকা পূর্নিমার সাথে মডেল হয়ে আরেকটি গান গেয়ে ফেলেন, 'তোমার হাতপাখার বাতাসে'। সে গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপরে আরো গানটান গেয়েছেন। বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন সে।

এরপর আর খোঁজ রাখিনি আমরা কেউই। মিডিয়ার জগতটা এমনই, এখানে কোনো একজন মানুষের উপর বেশিক্ষণ নজর রাখা যায় না আসলে। সেই মানুষটিও যদি আলোচনায় আসার জন্যে ক্রমাগত চেষ্টা না করতে থাকে, একসময় সে হারিয়েই যাবে। নিয়তি এটাই বলে। আকবরের ক্ষেত্রেও সেটাই লক্ষ্য করি। আকবর একসময়ে এসে অদৃশ্য হয়ে যায় আলোচনার টেবিল থেকে।

আকবর আবার আমাদের চোখের সামনে এসেছেন। কিন্তু যে সংবাদের শিরোনাম হয়ে এসেছেন, তা নিদারুণ যন্ত্রনার। মৃত্যুর সাথে একরকম পাঞ্জাই লড়ছেন তিনি। কিডনিতে ঝামেলা। কিডনিতে ইনফেকশন হয়েছে। রক্তেও ইনফেকশন। ডায়াবেটিস আছে অনেকদিন ধরেই। মাঝেমধ্যে এমন হচ্ছে, শরীরই নাড়াতে পারেন না অনেকদিন। ঘরে দুই ছেলে মেয়ে, স্ত্রী। একমাত্র উপার্জনক্ষম হয়ে তিনি বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছেন। শরীরের ব্যথায় কাতর হয়ে।

হানিফ সংকেত কয়েক দফা সাহায্য করেছেন আকবরকে। আকবর নিজেও এখন লজ্জা পান হানিফ সংকেতের কাছে টাকা চাইতে। একজন মানুষের কাছে কতবার হাত পাতা যায় আসলে? টাকাও চাইতে পারছেন না, কিন্তু ওদিকে বেয়ারা রোগটাও দিনদিন গ্রাস করে ফেলছে শরীরকে। শুধু সেখানে থামলেও হতো। চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবারের সব সঞ্চয় ফুরিয়েছে। এমনও হয়েছে টাকার অভাবে পুরো পরিবারকে নিয়েই উপোস করে কাটিয়েছেন তিনি। ঘরে একমুঠো ভাতও রান্না হয়নি তার। নিজেই আক্ষেপ জড়ানো স্বরে বলেন-

রাস্তা থেকে উঠে আসা শিল্পী আমি। আমার তো কারো সাথেই পরিচয় নাই। আমাকে সাহায্য করার মানুষও খুব কম। আর এক মানুষের কাছে কয়বারই বা হাত পাতবো? তারাও বা কী ভাববে?

ঈদের পরে অসুস্থ গায়ক আকবরকে ভর্তি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। প্রথম আলোর সংবাদের সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের বেডে শুয়ে কান্নাগলায় আকবর জানাচ্ছেন-

মেয়ের জন্য আল্লাহ যেন আমাকে আরও কয়েকটা বছর বাঁচিয়ে রাখেন। আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু মেয়েটার জন্য একটু বাঁচতে চাই।

বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মেয়ে বাবার কান্না সহ্য করতে না পেরে এসে নিজ হাতে বাবার দু'চোখ মুছিয়ে দেন। হৃদয়বিদারক দৃশ্যের জন্ম হয় হাসপাতালের অপরিসর জনাকীর্ণ ওয়ার্ডে।

শরীরের ওজন এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৮ কেজি!  

আকবরের মেয়ে অথৈও ভালো গান গায়। হারমোনিয়াম বাজানোও শিখেছে। আকবর চান, মেয়ে ভালো গান করুক। বাবা হিসেবে তিনিও থাকতে চান মেয়ের পাশে, সবসময়। তিনি থাকতে চান পরিবারের পাশেও। কিন্তু এদিকে সারা শরীরে ফোস্কা উঠছে। সেগুলোতে হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণা। ওজন কমছে প্রতিদিনই। এখন ওজন মাত্র ৩৮ কেজি! সারা শরীর দুমড়েমুচড়ে একটুখানি হয়ে গিয়েছে। ডায়াবেটিসের সমস্যা তো আছেই। কিডনিও বাদ দিতে হবে হয়তো। ডাক্তাররাও সেটাই জানাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আকবরের শারিরীক অবস্থা ও আর্থিক দৈন্যদশার কথা জানতে পারেন গতবছরে। এরপরেই তিনি আকবরের পরিবারকে ডেকে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেন। সে টাকা দিয়েই চলছে আকবরের চিকিৎসা। কিন্তু অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডাক্তাররাও প্রত্যেকদিন একটু একটু করে আশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এক অনিশ্চিত পেন্ডুলাম হয়ে ঝুলছে আকবরের জীবন, দড়ির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।

মেয়ে অথৈ এর সাথে আকবর

আকবরের গাওয়া 'একদিন পাখি উড়ে' গানটির একটি লাইন এরকম ছিলো-

তারে ভেবে কারও চোখে যেন
জল না আসে

আকবরের কথা ভাবলে চোখে জল আসবে না, এমন মানু্ষ নেই। যিনি বাঁচতে চান নিজের স্ত্রী'র জন্যে। নিজের দুই সন্তানের জন্যে। নিজের পরিবারের জন্যে। নিজের মেয়েকে ভালো গান শেখাতে চান। মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে স্টেজে গান গাইবে, বাবা দর্শকসারিতে গান শুনে মুগ্ধ হবে, চোখের জল ফেলবে। অসুস্থ বাবার ইচ্ছেটুকু শুধু এতটুকুই। জানিনা বিধাতার কী পরিকল্পনা। তবে আমরা চাই, আকবর আবার ফিরে আসুক পরিবারের মাঝে। গান হয়তো আর গাওয়া হবে না। কিন্তু মেয়েকে গায়িকা বানানোর যে স্বপ্ন বাবার, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত সে মেয়ের সাথেই থাকুক ছায়ার মতন। ছায়া হওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে না যাক এই মানুষটি।

আকবর থাকুক আমাদের প্রত্যেকের দোয়া-ভালোবাসায়-প্রার্থনায়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা