ভালুকের আক্রমণে যিনি মরতে বসেছিলেন, তিনিই এখন বিপদগ্রস্ত বন্যপ্রাণীর রক্ষক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বন্য ভালুকের আক্রমণে প্রাণে বেঁচে গেলেও, মুখের একটা পাশ বিকৃত হয়ে গিয়েছে, হারিয়েছেন চোখ। সেই লোকটাই শখের শিকারী থেকে হয়ে গেছেন অসহায় বন্য প্রাণীর রক্ষক, কোথাও কোন প্রাণী বিপদে পড়েছে শুনলেই ছুটে যান সিতেশ রঞ্জন দেব...
দুর্ঘটনা নাকি মানুষের জীবনকে বদলে দেয়। শ্রীমঙ্গলের সিতেশ রঞ্জন দেব এই কথাটায় খুব বিশ্বাস করেন। এক দুর্ঘটনায় তার জীবনটা যে পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল ত্রিশ বছর আগে। যে লোকটা শখের শিকারী ছিলেন, যার বাবার রাইফেলের আওয়াজে এলাকা কাঁপতো, বন্য জীব-জন্তু মারাটা যার কাছে ছিল আনন্দ, সেই সিতেশ দেব বন্য ভাল্লুকের আক্রমণে মরতে বসেছিলেন ১৯৯১ সালে। মুখের একটা পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভীষণভাবে, এক চোখ হারিয়েছেন সেই দুর্ঘটনায়, তবে বেঁচে গেছেন প্রাণে। এরপরে শিকারের পরিবর্তে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন, হয়ে উঠেছেন অসহায় প্রাণীদের আশ্রয়দাতা। শ্রীমঙ্গলে নিজ উদ্যোগেই গড়ে তুলেছেন চিড়িয়াখানা, তবে জন্ত-জানোয়ারের প্রদর্শনের চাইতে সেখানে মূখ্য বিষয় হচ্ছে অসহায় প্রাণীগুলোর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা।
সিতেশ বাবুর রূপান্তরের গল্পটা জানতে হলে সময়ের ডানায় চড়ে ফিরে যেতে হবে তিন দশক পেছনে, ১৯৯১ সালে। পাত্রখলা চা বাগানের আদিবাসীদের ফসল বন্য শূকর নষ্ট করছিল। এজন্য তারা সিতেশ বাবুর শরণাপন্ন হয়, শিকারী হিসেবে ভালো নামডাক ছিল তার। ঘটনা শুনে সিতেশ বাবুও ছুটলেন তাদের কথামতো শূকর তাড়াতে।
জানুয়ারি মাস, প্রচণ্ড শীত তখন, কুয়াশায় দুই হাত দূরের জিনিসও ঠিকমতো দেখা যায় না। খুব ভোরবেলায় ঘন কুয়াশার মধ্যে ধলই ভেলির পাত্রখলা চা বাগানের নলখাগড়ার বনের ভেতর দিয়ে চলছিলেন বন্দুক হাতে। জায়গাটি ছিল ভারতীয় সীমান্তের কয়েকশ গজের মধ্যে। চারদিকে প্রখর নজর রেখে এগিয়ে চলছিলেন সিতেশ বাবু। পেছনে পাত্রখলা চা বাগানের কয়েকজন শ্রমিকও ছিল তার সঙ্গে। বাকিরা ছিল বেশ পিছনে।
পথে চলতে চলতে হঠাৎ অনুভব করলেন, উঁচু কিছুতে পা পড়েছে তার, আর সেটি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। মাটিতে পড়ে গিয়ে যেটা দেখলেন, সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না সিতেশ বাবু, একটা ইন্ডিয়ান ভাল্লুক জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে! তিনি এসেছেন শূকর তাড়াতে, হালকা অস্ত্র নিয়ে, এই বন্দুক ভাল্লুকের কাছে খেলনা ছাড়া কিছুই না। তবে বেশি কিছু ভাবার সময় পেলেন না সিতেশ বাবু, মুহূর্তের মধ্যে বিশাল আকৃতির একটি ইন্ডিয়ান ভালুকটি থাবা দিলো তার মুখের এক পাশে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লুটিয়ে পড়লেন, তবু প্রাণের তাগিদে হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে গুলি চালালেন। মুখে গুলি লাগায় ভালুকটিও লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
গুলির শব্দ পেয়ে পেছনে থাকা সঙ্গীরা ছুটে গিয়ে মৃত ভাল্লুকের পাশ থেকে সিতেশ বাবুকে উদ্ধার করে। পাথরকলা বাগানের ম্যানেজার নিজের গাড়ি দিয়ে সিতেশবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতাল। সেখান থেকে সিএমএইচে। পরে নেওয়া হয় কলকাতা। প্রায় দুই মাস চলে যমে-মানুষে টানাটানি। ডাক্তারদের তৎপরতায় প্রাণটা বেঁচে গেলেও, ভালুকের ওই হামলায় সিতেশ বাবু একটি চোখ, নাক ও মুখের একাংশ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাতবার অপারেশন শেষে তার মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। এখন তিনি এক চোখ, মুখে লাগানো দাঁত ও নাকের একটা ফুটো দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে বেঁচে আছেন। সিতেশ বাবুর মতে এটি তার ‘দ্বিতীয় জীবন’। তবে এই দ্বিতীয় জীবনটিকে সিতেশ বাবু যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন, সেটা শুনলে অবাক হবেন যে কেউই। বন্য ভাল্লুকের আক্রমণে যার প্রাণ সংশয় হয়েছিল, চেহারাটা চিরদিনের মতো বিকৃত হয়ে গেছে, স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলেছেন; সিতেশ বাবু কিনা সেই বন্য প্রাণীদের নিয়েই কাজ করা শুরু করলেন, চিরদিনের জন্য তুলে রাখলেন বন্দুক!
বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা আহত প্রাণীদের সুস্থ করে তুলতে শ্রীমঙ্গল শহরের মিশন রোডের বাড়ির আঙিনায় তিনি গড়ে তুললেন একটি মিনি চিড়িয়াখানা। পরে পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকায় অবস্থিত বাগানবাড়িতে এটিকে স্থানান্তর করেন। সরকারের বন্য প্রাণী আইনানুযায়ী এটিকে রূপান্তর করেছেন বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে। কোথাও বন্য প্রাণী উৎপাত করছে, বা লোকালয়ে খাবারের সন্ধানে এসে ধরা পড়েছে শুনলেই ছুটে যান সিতেশ বাবু। সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তিনি, সম্ভব হলে লোকালয় থেকে দূরে বনে ছেড়ে দেন, আর যদি অবস্থা সংকটাপন্ন হয়, তাহলে সেই প্রাণীর জায়গা হয় তার বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে।
বন্য প্রাণীর জন্য সিতেশ রঞ্জন দেবের অগাধ ভালোবাসা। কখনো কোনো প্রাণীর আহত হওয়ার খবর পেলেই তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সারাক্ষণই প্রাণীর কথা ভাবেন তিনি। সিতেশ বাবুর সঙ্গে তার দুই ছেলেও এই সেবা ফাউন্ডেশনে কাজ করেন, তবে এখনও সিতেশ বাবুই সবকিছুই দেখাশোনা করেন। বোবা প্রাণীগুলোর কাছাকাছি না থাকলে তার অস্বস্তি লাগে, এরাই তার বিশ্বস্ত সহচরে পরিণত হয়েছে এখন। এই বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন থেকে অনেক প্রাণীই সুস্থ হয়ে বনে ফিরে গেছে, যাদের বেঁচে থাকার আশাই ছিল না।
অ্যাসিডে পুরো মুখ ঝলসে যাওয়া বানর, তিন পায়ের হরিণ, বৈদ্যুতিক তারে জড়ানো শকুন, লোকালয়ে এসে মানুষের দায়ের কোপে আহত অজগরসহ অসংখ্য প্রাণী এখানে চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছে বনে। শুধু এই অঞ্চলের প্রাণীই নয়, ২০১৬ সালে ঝড়ের কবলে পড়ে মৃতপ্রায় একটি গাঙচিল দিনাজপুর থেকে আনা হয় সিতেশ রঞ্জন দেবের বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে। সেই গাঙচিল এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, তাকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে মুক্ত আকাশে।
অনেকেই বলতে পারেন, সিতেশ বাবু যদি এতই প্রাণী প্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে চিড়িয়াখানা কেন বানিয়েছেন, প্রাণীগুলোকে ছেড়ে দিলেই তো পারেন! প্রথমত, এটা এখন আর চিড়িয়াখানা নেই, বন্যপ্রাণী সেবা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আর সব প্রাণীকে বাইরে ছেড়ে দেয়াও সম্ভব নয়, কারণ অনেকেই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না, খাবার না পেয়ে লোকালয়ে গিয়ে মারা পড়বে, অথবা চোরা শিকারীদের হাতে মারা পড়বে। যেসব প্রাণীকে অবমুক্ত করা সম্ভব, তাদের এখানে রাখা হয় না, উদ্ধারের পর সুস্থ হলেই জঙ্গলে ছেড়ে দেয়া হয় তাদের। এই বন্যপ্রাণী সেবা কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের জন্য বিশ টাকা করে প্রবেশ মূল্য নেয়া হয়, সেটাও প্রাণীদের খাবার এবং রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যয় হয়।
এভাবেই শখের শিকারী থেকে সিতেশ রঞ্জন দেব পরিণত হয়েছেন বন্যপ্রাণীদের রক্ষকে, প্রাণীদের বিপদ যাকে কাঁদায়, তাদের অসহায়ত্ব তাকে ভাবায়। সিতেশ রঞ্জন দেবের মতো সবাই যদি হৃদয় দিয়ে অন্য প্রাণীদের ভালোবাসতে পারতো, পৃথিবীটা তাহলে কতই না সুন্দর হতো!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন