বারবার বস্তিতে আগুন লাগে। এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। উঠে আসছে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোর আড়ালেই লুকিয়ে রয়েছে সমাধান।

একটা সহজ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি-  বস্তিতে বারাবার আগুন লাগে নাকি লাগিয়ে দেয়া হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সময়ের দাবী। নইলে প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকা বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না। প্রায় ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আজকে রাজধানী ঢাকার মিরপুরের রূপনগর বস্তিতে লাগা আগুনে। বস্তিতে আগুন কিন্তু নতুন বিষয় নয়। কথা হচ্ছে, এই বস্তিবাসীরা কি মানুষ না?  নাকি এরা শুধুই বলির পাঠা? ভোট নেবার সময় কিন্তু এদের কথা ঠিকই মনে পড়ে। তাহলে নাগরিক অধিকার দেবার সময়ে কেন বস্তিবাসীদের কথা ভুলে যাওয়া হয়? এমনিতেই দারিদ্রসীমার নিচে থাকার কারণে নাগরিক মৌলিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েই জীবন কাটিয়ে দিতে হয় এদের। তার ওপর কিছুদিন পরপর এই আগুনের উৎপাত।

সিটি কর্পোরেশন হিসেব করে দেখেছে বর্তমানে ঢাকায় ছোট বড় একশ’ বস্তি আছে। গত প্রায় চার বছরের ছোট ছোট দশটি বস্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওসব বস্তির বাসিন্দারা বড় বড় বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। ইতোমধ্যে রেলওয়ের জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে ৭০টা বস্তি। অন্যান্য বস্তি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। ঢাকায় বস্তিতে বসবাস করছেন অন্তত লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ।

ফায়ার সার্ভিসের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে চোখ বুলালে দেখা যায় সারাবছর দেশজুড়ে ১৬৫ বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায়ই ৩৩ বার বস্তিতে আগুন লাগে। ২০১৯ সালের প্রথম মাসেই ২৪বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন বস্তিতে। এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত কোটি টাকা। আগুন নিভে গেলে কিন্তু বস্তিবাসীর কাছে পড়নের কাপড়টা ছাড়া কিছুই থাকে না।     

জীবনের সব সম্বল পুড়ে ছাই 

গত ১০ বছরে শুধু কড়াইল বস্তিতেই আগুন লেগেছে ১৭ বার! ভাবা যায়? একই বস্তিতে বারবার আগুন লেগে চলেছে। এরপরেও পরিস্থিতি এতোটাই স্বাভাবিক যে পরিসংখ্যান দেখেও কারো চোখ কপালে উঠবে না। মৌসুম আসলে যেমন গাছে ফল ধরে, সেভাবেই সময় করে বস্তিতে আগুন লাগে।

বস্তিতে আগুন লাগার কিছু নির্দিষ্ট কারণ হিসেবে উঠে আসে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বিষয়টি। বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে- জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান জানিয়েছেন, নানা কারণেই বস্তিতে আগুন লাগে। এর আগে তদন্তে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপের লিক থেকে আগুনের কারণ উঠে এসেছে। তবে আগুন যে লাগানো হয়, সেটাও অমূলক নয়। বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে কোনো মহলের ইনফ্লুয়েন্স তো থাকেই।

বোঝাই যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র দুর্ঘটনাজনিত কারণে বস্তিতে বারবার আগুন লাগে না। বরং বস্তিতে আগুন লাগানোও হয়। এতে কারো কোনো সন্দেহ থাকবার কথাও না। বিশেষ করে যারা ভুক্তোগী তারা তো জানেন এই আগুনের কলকাঠি নাড়ছে কে। কুড়াল ভুলে গেলেও গাছে আঘাতের চিহ্ন রয়ে যায়। বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে নতুন করে বস্তি তৈরি করার লাভটাও নেহায়েত কম নয়। যারা বস্তির দখলে থাকেন তারাই এমন পরিস্থিতির ফয়দা লুটেন, আগুন থেকে ক্যাশ আউট করে থাকেন। কিংবা বস্তির জমিতে অন্যকিছুর পরিকল্পনা করা হলে সেক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। সবগুলো আগুনেই স্বার্থন্বেষী ক্ষমতাবান দুস্টুচক্রের জড়িত থাকার ইঙ্গিত থাকে।    

একটু সচেতনতা আর গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বস্তির অগ্নিকা- কমাতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। মূলত অসচেতনতা, সিগারেটের আগুন, রান্নার পর চুলা বন্ধ না করা, পুরনো বৈদ্যুতিক তারে শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপ লিকেজ থেকে বেশিরভাগ আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের অপারেশন্স শাখার তথ্য অনুযায়ী, দেশে থাকা বস্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার।

যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বস্তির সঠিক পরিসংখ্যান, বস্তিতে বসবাসকারীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। বেশির ভাগ সময়ই বস্তিতে আগুন লাগলে সেখানে ভারি কোন যানবাহন দিয়ে কাজ করা সম্ভব হয় না। ফলে আন্তরিকতা থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। এতে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পাশাপাশি সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, বস্তিতেই কেন বারবার আগুন লাগে?  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা