এস এম সুলতান: যে কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনের গল্প পরিপূর্ণ হয়ে আছে ট্র্যাজেডিতে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সৎ মায়ের অত্যাচার সইতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটাই পরে নিজেকে পরিণত করেছেন অসামান্য এক চিত্রশিল্পীতে। পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, মাতিস, ব্রাক ও ক্লীর মতো বিশ্বনন্দিত শিল্পীদের চিত্রকর্মের পাশাপাশি একসঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে এসএম সুলতানের আঁকা ছবিও! অথচ তার পুরোটা জীবন কেটেছে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে...
বুকের ভেতর একাকীত্ব আর শূন্যতার স্রোতস্বিনী এক নদী জিইয়ে রেখে তিনি আঁকতেন ছবি, তার হাতের রঙ-তুলি জীবন্ত হয়ে ফুটতো ক্যানভাসে। সারাটা জীবন তিনি দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, অবহেলিত হয়েছেন, পাননি প্রাপ্য সম্মান বা মর্যাদা- তবু নিজেকে বদলাননি, যে জীবন তিনি যাপন করতে চেয়েছেন, সেখান থেকে সরে গিয়ে চাকচিক্যের আলো ঝলমলে জগতে ঢুকে পড়েননি। তিনি কষ্টকে আপন করেছেন, ভালোবেসে বরণ করে নিয়েছেন, সেই কষ্টই তার শিল্পের দুনিয়ায় সৌন্দর্য্যের ফুল হয়ে ফুটেছে, বেদনাকে ঢেলে দিয়েছেন ক্যানভাসের ওপর, ছবি হয়ে ফুটে উঠে সেসব তাকে খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে, পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মানুষটা নিজেকে পরিণত করেছিলেন এই বঙ্গে জন্ম নেয়া সর্বকালের সেরা চিত্রশিল্পীতে। নাম তার শাহ মোহাম্মদ সুলতান, এস এম সুলতান নামে যাকে দেশের মানুষ চেনে।
নড়াইল জেলাটা এখন বিখ্যাত মাশরাফি বিন মুর্তজার কারণে। তবে গত দশকের আগেও নড়াইলকে লোকে চিনতো এসএম সুলতানের শহর হিসেবে। ১৯২৩ সালে, আজ থেকে ঠিক সাতানব্বই বছর আগে মাছিমদিয়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন মানুষটা। বাবা নাম দিয়েছিলেন লাল মিয়া নামে। রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন বাবা, তবে লাল মিয়ার কাছে তার বাবা ছিলেন শিল্পী, শিক্ষাগুরু। জমিদার প্রথা তখনও বিলুপ্ত হয়নি, স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে বেশ কিছু নকশার কাজ করেছিলেন লাল মিয়ার বাবা মেছের, বাবার সঙ্গী হয়ে তখনই আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁকটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট লাল মিয়ার। যেখানেই ফাঁকা জায়গা পেতেন, বসে পড়তেন ছবি আঁকতে। কাগজ-কলম বা রং-তুলি তখন বিলাসী ব্যাপার। আঁকতেন দেয়ালে, মাটিতে, কাঠ-কয়লা ছিল তার তুলি।
অভাবের সংসার ছিল, চার সদস্যের পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, তবু মেছের তার ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, বাপের ভাগ্য যাতে ছেলের না হয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন যাতে বিপর্যস্ত না হয়ে যায়। কিন্ত ভাগ্যে যেটা লেখা আছে, সেটা বদলায় কি করে! হুট করেই অজানা অসুখে মারা গেলেন লাল মিয়ার মা, ছোট্ট ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ করার জন্য মেছের আবার বিয়ে করলেন, তাতে হিতে বিপরীত হলো। সৎ মা সংসারে এসে লাল মিয়া আর তার ছোট বোন ফুলমণির ওপর শুরু করলেন অত্যাচার। সেই অত্যাচার সইতে না পেরে বাড়ি থেকে পালালেন লাল মিয়া। সঙ্গে নিলেন তিন আনা বারো পয়সা, একটি ছাতা, গুটিকয় জামা-কাপড় আর একটি ঠিকানা। পেছন পেছন এলো ফুলমণি, লাল মিয়া তাকে ফেরত পাঠালেন বাড়িতে, বললেন, 'তুই বাড়িত যা, আমি আসমু।' সেই আসা হয়েছিল দীর্ঘ এক যুগ পরে!
নড়াইল থেকে লঞ্চে চড়ে কলকাতা গেলেন লাল মিয়া, খুঁজে বের করলেন নড়াইলের তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুরের বাড়ি, যে ঠিকানাটা তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। বাবার সঙ্গে এই জমিদারের বাড়িতে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলেন লাল মিয়া, আঁকাআঁকির প্রতি তার আগ্রহের কথা জমিদারবাবু জানতেন। জমিদারবাড়ির দেয়ালে কাঠ কয়লা দিয়ে লাল মিয়ার আঁকা চমৎকার সব চজবি ধীরেন্দ্রনাথ দেখেছেন। তার বাড়িতে লাল মিয়ার আশ্রয় হলো, তিন বেলার খাবার, বিনিময়ে ফাইফরমাশ খাটা। জমিদারের ছোট ভাইয়ের কাছে লাল মিয়া খবর পেলেন, কলকাতায় নাকি একটা আর্ট কলেজ আছে, সেখান থেকে ডিগ্রি না নিলে শিল্পী হওয়া যায় না। সেই কলেজে শুধু আঁকাআঁকিই শেখানো হয়।
শুনে লাল মিয়া ছুটলেন খবর নিতে, কিন্ত গিয়ে হতাশ হতে হলো। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে হলে মেট্রিক পাশ করতে হবে, লাল মিয়া তো ক্লাস সেভেনেই লেখাপড়া ছেড়েছেন! তাহলে উপায়? একটা উপায় বাতলে দিলেন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ, বললেন, সোহরাওয়ার্দির কাছে যা। উনি সুপারিশ করে দিলে হয়তো তোকে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে দেবে। লাল মিয়া ছুটলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির বাসভবনে।তাকে খুলে বললেন নিজের জীবন আর সমস্যার কথা। একটা মিথ্যা কথাও বললেন সেখানে, জানালেন, তিন কুলে তার কেউ নেই।
সোহরাওয়ার্দী তার ব্যাপারে সুপারিশ করে দিলেন, শুধু তাই নয়, লাল মিয়াকে নিজের পরিবারের সদস্যও বানিয়ে নিলেন! নতুন নাম দেয়া হলো তার, শাহ মোহাম্মদ সুলতান, যে নামে তাকে গোটা উপমহাদেশ চিনবে একসময়। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হলেন সুলতান, সাল ১৯৪১। সোহরাওয়ার্দির বাসায় বিশাল লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক হলেন তিনি,সেখানেই থাকতেন। শিল্প আর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসাটা গাঢ় হতে থাকল দিনকে দিন। সুলতানকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী৷ সেই বাড়িতে কোনোকিছুরই অভাব ছিল না তাঁর৷
আর্টস কলেজে গোটা কোর্সের মেয়াদ ছিল ছয় বছর৷ সুলতান প্রথম বছরের পরীক্ষায় দ্বিতীয় এবং পরের দুই বছর পর পর প্রথম হলেন৷ ভালোই চলছিল সবকিছু, কিন্তু ছয় বছরের কোর্সে চার বছরের মাথায় এসে হাঁপিয়ে উঠলেন সুলতান৷ আচমকাই যেন শেখ মোহম্মদ সুলতানের ভেতর হঠাত্ করে জেগে উঠল মাছিমদিয়ার দুরন্ত লাল মিয়া৷ তিনি শিল্পী হতে চেয়েছেন শিল্পী তো হবেন বাউন্ডুলে, তিনি কেন নয়টা-পাঁচটার বাধ্যগত জীবনে অভ্যস্ত হবেন? সুলতান তখন বুকের ভেতর অনুভব করলেন ঘুর্ণির টান, সেই টানের প্রাবল্যে সবকিছু ছেড়েছুড়ে পালালেন তিনি। ১৯৪৪ সালের ঘটনা সেটা। আর্টস কলেজ ছাড়লেন, কলকাতা ছেড়ে পাড়ি জমালেন সুদূর দিল্লি, উদ্দেশ্য, গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে দেখবেন।
অস্থির একটা সময় তখন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, সুলতান ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিল্লি থেকে লক্ষ্মৌ, সেখান থেকে পাহাড়ি হিমাচল। সুলতান ভারতের শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর পাঁচ দশ টাকার বিনিময়ে ইংরেজ সৈন্যদের ছবি আঁকছেন৷ ভয় নেই, ভাবনা নেই, দুশ্চিন্তা নেই, নেই কোনো দায়-দায়িত্ব, আছে শুধু সুন্দরের প্রতি সুতীব্র টান আর ছুটে চলার গতি৷ হিমাচল থেকে পাঞ্জাব হয়ে কাশ্মীর গেলেন সুলতান, সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে গেলেন তাদের ছবি আঁকবেন বলে। ততদিনে খানিকটা নাম কামিয়েছেন, মিসেস হাডসন নামে কানাডীয় এক মহিলার উদ্যোগে ১৯৪৫ সালে ভারতের শিমলাতে সুলতানের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল৷ শিমলা আর কাশ্মীরে আঁকা ছবিগুলোই হাজির ছিল সেই প্রদর্শনীতে।
দেশ ভাগ হলো, সুলতান চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। করাচী আর ইসলামাবাদে বেশ কয়েকটা প্রদর্শনী শেষে ফিরলেন নিজের বাসভূমে, কিন্ত পৈত্রিক ভিটায় তার জায়গা হলো না। ঢাকায় গেলেন, সেখানেও তার গুণের কদর কেউ করলো না। তিনি ফিরে গেলেন করাচীতে, একটা আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন৷ আর পাশাপাশি চলছিল তার ছবি আঁকা৷ ঢাকায় তার মর্যাদা কেউ বুঝলো না, অথচ সেই সময়ে তার ছবির প্রদর্শন চলছিল আমেরিকা আর বৃটেনের বিভিন্ন আর্ট গ্যালারিতে। পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, মাতিস, ব্রাক ও ক্লীর মতো বিশ্বনন্দিত শিল্পীদের চিত্রকর্মের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে এসএম সুলতানের আঁকা ছবিও! এসব একক ও সম্মিলিত প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুলতান প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের চিত্রকলার জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন, পেয়েছিলেন খ্যাতি, পরিচিতি।
শুরু থেকে এস এম সুলতানের ছবির মূল বিষয় ছিল নিসর্গ৷ পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তার আঁকার বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আসে৷ ল্যান্ডস্কেপে আসে ফসলের জমি, বাংলার কৃষি জীবন ও মানুষ৷ ষাটের দশকের শেষ দিকে এসে তার চিত্রকর্মে উপজীব্য হয়ে উঠল মানুষের দেহাবয়ব৷ ল্যান্ডস্কেপের পরিবর্তে মানুষই হয়ে উঠল তার ছবির একচ্ছত্র অধিপতি৷ এই যে দুম করে নিজের আঁকার বিষয়বস্তুটাই বদলে ফেলা- একজন শিল্পীর জন্য এটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জিং, ক্ষেত্রবিশেষে আত্মঘাতিও। কিন্ত সুলতান সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, তাতে দারুণভাবে উতরেও এসেছিলেন।
আবারও দেশে ফিরলেন, গেলেন নড়াইল। তবে পৈত্রিক ভিটায় নয়, জমিদার বাড়ির পরিত্যাক্ত শিবমন্দিরে বসত গড়লেন তিনি। গ্রামের লোকে অবাক হলো ভীষণ, সাপখোপের ভয়ে যেদিকটায় লোকে খুব দরকার না পড়লে যায় না, সেখানে কিনা থাকছেন পাগলাটে এই লোকটা! সুলতান সাপের ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাননি৷ পরম মমতায় এসব সাপকে লালন পালন করছেন, রোজ এদের দুধ কলা খাওয়ান৷ এ যেন এক অন্য সুলতান৷ একজন অসম্ভব প্রাণীপ্রেমী মানুষ৷ জীব-জন্তু নিয়েই যেন তাঁর জীবন৷ লম্বা ছিপছিপে গড়ন, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল; সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, না হয় কোথাও বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন৷ তিন কুলে তার তখন কেউই নেই, বিয়েও করেননি৷ দিনে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতেন, বাঁশি বাজাতেন আর রাতে শিবমন্দিরে ঘুমাতেন৷ এটাই ছিল ষাটের দশকে তার জীবন।
কিছুদিন পরে সংসার বড় হলো, তিনি এসে উঠলেন জমিদার বাড়ির পরিত্যাক্ত দোতলা ভবনে। তার সংসারে সদস্য হচ্ছে কয়েক ডজন গিনিপিগ, ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, বাঁদর ও নানারকম পাখি৷ এরা তাঁর সন্তানের মতো৷ রোজ এদের খাবারের জন্য প্রয়োজন হয় পাঁচ সের দুধ, কয়েক ডজন কলা, মাছ, মাংস- এসব জোগাড় করতে হিমশিম খান তিনি। নিজে খালি অভুক্ত থেকে এই প্রাণীগুলোর খাবার জোগাড় করতে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়িয়েছেন সুলতান। ক্ষিধে পেলে কারো বাড়িতে একবেলা খেয়েছেন, অথবা কারো কাছে হাত পেতে ধার চেয়ে নিয়েছেন। সেই ধারের টাকা কবে কিভাবে শোধ করবেন কিছুই জানতেন না। গ্রামের সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ ও শিশুদের সাথে তার ছিল আশ্চর্য্য রকমের বন্ধুত্ব৷ এভাবেই কেটে গেল প্রায় দেড় যুগ৷ এই দীর্ঘ সময়ে তুলিতে কখনো রং লাগাননি সুলতান৷ ১৯৫১ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত দীর্ঘ পঁচিশটা বছর তার কোন চিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত হয়নি কোথাও- ভাবা যায়?
১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে শিল্পকলা অ্যাকাডেমির গ্যালারিতে পঁচাত্তরটিরও বেশি চিত্রকর্ম নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সুলতানের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হলো৷ ততদিনে ঢাকায় সুলতানের ছবির ভক্ত অনেক বেড়েছে৷ সেই সময় প্রয়োজনের তাগিদেই ভাঙা বাড়ির সংসার রেখে ঢাকায় চলে এসেছিলেন সুলতান৷ কিন্তু থিতু হতে পারেননি৷ নাগরিক জীবনের সাথে একেবারেই মানিয়ে নিতে পারেননি মানুষটা৷ চিত্রার স্রোতে সাঁতার কেটে যিনি বড় হয়েছেন, ঘিঞ্জি এই শহরে তার মন বসে কি করে? তাই পরিত্যক্ত বাড়িটাতেই ফিরে গেলেন আবার৷ পাখি, মানুষ আর শিশুদের নিয়ে সারা দিন ঘুরে বেড়ান, শিশুদের ছবি অাঁকা শেখান, আড্ডা দেন৷ এমনি করেই কাটান আরও কয়েক বছর৷ এসএম সুলতানের নামটা বাংলাদেশে তখন চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রখ্যাত, সবাই তাকে এক নামে চেনে৷
সেসময়ের উচ্চপদস্থ সরকারী আমলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন তার শিল্পকর্মের ভক্ত। তার পাগলাটে জীবনধারা সম্পর্কে তারা জানতেন, জানতেন তার আর্থিক দৈন্যতার কথা। তাদের চেষ্টায় শিল্পকলা একাডেমি থেকে এসএম সুলতানকে শিল্পকলা অ্যাকাডেমির আবাসিক শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো, সরকার আর্থিক ভাতায় ও সরকারি খরচে তার ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করলো। এই সুবিধার বিনিময়ে সুলতানকে প্রতি বছর ছয়টি করে শিল্পকর্ম শিল্পকলা একাডেমিতে জমা দিতে হতো। এ ছাড়া চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলার উপর বছরে একটি করে বক্তৃতা দেবেন- এই শর্তও ছিল৷ অর্থাভাবে সুলতান যেন ছবি আঁকা বন্ধ করে না দেন- এটাই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। এর মাঝেই ১৯৮২ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছিল।
সুলতান তখন এঁকে চলেছেন এক মনে। চর দখল, পৃথিবীর মানচিত্র, জমি কর্ষণ-১, জমি কর্ষণ-২, হত্যাযজ্ঞ, মাছ কাটা, জমি কর্ষণে যাত্রা-১ এবং ২ যাত্রা, ধান মাড়াই- এসব চিত্রকর্ম ১৯৭৬-১৯৮৭ সালের মধ্যে আঁকা। প্রত্যেকটিই তুমুল আলোচিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। কখনও তিনি তেলরঙে ছবি এঁকেছেন, তো কখনও ছবিকে জীবন্ত করে তুলেছেন জলরঙে। ১৯৮৭ সালে শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে করা চুক্তিটা ছেড়েও বেরিয়ে এলেন, শিল্পী তো পরাধীন থাকতে পারেন না, স্বাধীনতা পেয়ে তিনি ছুটে গেলেন নড়াইলে, তার শেকড়ের কাছে। শিশুদের পড়াশোনা, ছবি আঁকা, গান, নৃত্য এসব শেখানোর জন্য গড়ে তুললেন ‘শিশুস্বর্গ’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান৷ নন্দন কানন নামে অঙ্কন শেখানোর একটা প্রতিষ্ঠানও চালু করেছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই গুণী শিল্পী।
প্রায় সারাটা জীবন মানুষটাকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। ঢাকায় বাড়িভাড়া বাকী পড়ায় তাকে বের করে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তবু মৃত্যুর আগে তিনি আফসোস নিয়ে বিদায় নেননি, হাসিমুখেই বলেছেন- ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে’। তার চিত্রকর্মে, তার অঙ্কনে বারবার উঠে এসেছে এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের জীবন, উঠে এসেছে কৃষি, কৃষকের পরিশ্রম। তার ছবিতে কৃষকদের অবয়বে ফুটে উঠতো স্বাস্থ্যবান, পেশিবহুল প্রতিচ্ছবি। এসএম সুলতানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাংলার কৃষকেরা তো রুগ্ন দেহের অধিকারী, তাহলে আপনি কেম ছবিতে তাদের পেশীবহুল করে উপস্থাপন করেন? বাঁধিয়ে রাখার মতো একটা জবাব দিয়েছিলেন তিনি, বলেছিলেন-
‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা...। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। দেশের অর্থবিত্ত ওরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা র্গ্নু কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিৎ।’
এই প্রজন্মের কাছে এসএম সুলতানের নাম আর কীর্তিগাঁথা পৌঁছে দেয়ার তেমন কোন চেষ্টা নেই কোথাও। বরং খবর পাই, অবহেলায় আর অযত্নে তার আঁকা মূল্যবান চিত্রকর্মগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাকে নিয়ে প্রচারণা দেখা যায় না কোথাও, পাঠ্যবইতেও নেই তার অবস্থান। খ্যাতিমান পরিচালক তারেক মাসুদ তাকে নিয়ে 'আদম সুরত' নামের একটা ডকুমেন্টরি বানিয়েছিলেন, সেটাও যে খুব বেশি মানুষ দেখেনি তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। গুণীর কদর যে দেশ করতে জানে না, সেদেশে গুণী মানুষ জন্ম নেবে না, এটাই স্বাভাবিক।
প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন, একই সাথে যান্ত্রিক নগর জীবনকে করেছেন ঘৃণা। নিজের অদ্ভুত জীবনবোধকে যিনি ফুটিয়ে তুলতেন রঙ তুলির আঁচড়ে, সেই মানুষটা আমাদের কাছে আরও অনেক বেশি সম্মান ডিজার্ভ করেন, সেটার ছিটেফোঁটাও আমরা তাকে দিতে পারিনি...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন