একজন ‘নোবডি’ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন ইমরান। অথচ ১৬ বছর বয়সেই তিনি যখন সবাইকে বলতেন একদিন অনেক টাকার মালিক হবেন, কেউ বিশ্বাস করেনি, সবাই হেসেছে...

ইমরান খান। স্ন্যাপচ্যাটের চিফ স্ট্রাট্রেজি অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন কিছুদিন আগেও। কাজ করেছেন আলিবাবা ডটকমের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র‍্যান্ডের সাথেও। একজন ‘নোবডি’ থেকে তিনি হয়েছেন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক। স্বপ্নের মতো জীবন তার মানুষটার জন্ম বাংলাদেশে। পড়ালেখাও কলেজ পর্যন্ত করেছেন দেশেই। তারপর পাড়ি জমান দেশের বাইরে। সম্প্রতি তার একটি ভিডিও ভাইরাল হয় ফেসবুকে। প্রায় ২৫ বছর আগের ভিডিও। তখন তিনি তার স্বপ্নের কথা বলতেন, মানুষ হাসতো। ফান ভাবতো। সেই তিনিই আজ সিলিকন ভ্যালীর আলোচিত, আলোকিত মানুষ।

একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে ইমরান খান কী বলেছিলেন, কেমন স্বপ্ন দেখতেন তিনি ২৫ বছর আগে, আসুন জেনে নেই- 

“কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা। এই বিষয়ে আমার সতীর্থ বক্তারা বলেছেন তারা কেউ গুলশান বনানী প্রেমিক, পর্যটন প্রেমিক, দেশ প্রেমিক। আমি তাদের মতো নই, বরং কিছুটা আত্মপ্রেমিক। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভালবাসি। নিজেকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চাই। আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন এবং ক্যারিশম্যাটিক তরুণ। (সবাই হাসছে) তা নিশ্চয়ই আপনারা আমার এই ডায়াসে আসা দেখেই বুঝতে পারছেন। আপনাদের এই হাসিই প্রমাণ করে আমার এই প্রতিভা এখানে বিকশিত হবার সুযোগ নেই (বেগম খালেদা জিয়ার হাসি)।

তাই আমি ঠিক করেছি আমি প্লেনে করে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে পাড়ি জমাবো। সেখানে গিয়ে আমি সিনেমার নায়ক হবো। যেহেতু আমি পূর্বেই বলেছি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন এবং ক্যারিশম্যাটিক তরুণ সেহেতু আমি হলিউডের অন্যান্য নায়ক, নায়িকা এবং পরিচালকের কল্পনার রাজকুমার হবো আমি। তারা প্রত্যেকেই আমার সাথে অভিনয় করবার জন্য আমার বেভারলি হিলসের বাড়ির সামনে লাইন ধরবে। আমি তাদের মধ্য থেকে আমার পছন্দের অভিনেতা, অভিনেত্রীদের বেছে নিয়ে অভিনয় করবো।

আমার সঠিক পছন্দের কারণে আমার অভিনীত প্রত্যেকটি বায়োস্কোপই বক্সঅফিসে হিট করবে। এভাবে হিরো হিসেবে নাম করার পর আমি হবো ঢালিউড থেকে আমদানিকৃত প্রথম ব্যাক্তিত্ব যে পরপর তিনবার অস্কার পেয়ে টম হ্যাংকসকে ছাড়িয়ে যাবে। খান এন্ড খান নামে আমি একটি সিনেমা তৈরির প্রোডাকশন হাউজ তৈরি করবো। এই প্রোডাকশন হাউজের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলো তৈরি করবো। কিছুদিনের মধ্যে খান এন্ড খান প্রোডাকশন হাউজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাল্টিবিলিয়নার কোম্পানি হিসেবে আবির্ভুত হবে। তখন প্রায়শই আপনারা পত্রিকায় আমার ছবি দেখবেন, প্রিন্স ইমরান খান। 

ইমরান খান

এ তো গেল ইহকালের কথা। বিত্তবান হবার পরেই আমি পরকালের দিকে নজর দিব। তখন আমি খান’স কেয়ার নামে একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন গড়ে তুলব৷ যেহেতু আমি হলিউডে বৃদ্ধ বয়সেও আমি হলিউডের সর্বাপেক্ষা সুদর্শন বৃদ্ধ থাকবো, সেহেতু আমার ইনোসেন্ট ফেস এবং আমার কনভিন্সিং ক্ষমতা দ্বারা হলিউডের সকল নায়ক নায়িকা আর পরিচালকদেরকে কনভিন্স করে ফেলব। তখন আর তারা বেবাল হিলসে বাড়ি কিনবে না। বেভারলি হিলসে বাড়ির দাম কমে যাবে। তারা আমার সেবা আশ্রমে টাকা দান করবে। তাদেরকে নিয়ে আমি আমার ক্রয়কৃত ৭৭৭ বিমানে করে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো।

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রনায়কদের যুদ্ধখাত ও বিলাস খাতে ব্যয় কমিয়ে আমার সেবা আশ্রমে টাকা দান করতে বলবো৷ এভাবে আমার সেবা আশ্রম বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সেবা আশ্রমে পরিণত হবে। বিশ্বের অধিকাংশ সেবা আশ্রমই আমার টাকাতে চলবে। যেহেতু অধিকাংশ অনাথ আশ্রমই আমার টাকায় চলবে তাই আমি ঠিক করেছি আমি সেখানে রুটি খাওয়াবো না। কারণ রুটি হচ্ছে পাশ্চাত্যের খাবার, তাই আমার দেশকে তুলে ধরার জন্য, আমার দেশের মানুষকে তুলে ধরার জন্য, আমার দেশের মানুষের খাবারকে তুলে ধরার জন্য আমি সেখানে ডালভাত খাওয়াবো। এভাবে আমি সারাপৃথিবীতে ডালভাতের কৃষ্টি চালু করবো। (সবার হাসি) ডালভাত তখন হবে বিজয়ের প্রতীক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় তখন আর বার্গার কিংবা পিজ্জা বিক্রি হবে না, বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রীরা এসে বলবেন, প্লিজ ইমরান গিভ মি সাম রাইস, অর আই উইল ডাই। এভাবে অর্থনীতি এবং শান্তিতে নতুন ডাইমেশন দেয়ার জন্য আমাকে একই সাথে দুটি নোবেল দেয়া হবে। এভাবে একদিন জীবন ঘনিয়ে আসে। সবাইকে চলে যেতে হয়। আমাকেও যেতে হবে। আজকে সময়ের অভাবে আমার কর্মময় জীবন সম্পর্কে আমি পরিপূর্ণভাবে জানাতে পারলাম না। তবে চিন্তার কিছু নেই। আমার মৃত্যুর পর আমার সেক্রেটারি কতৃক কথিত ‘আ লাইফ অব আ বিলিয়নার’ গ্রন্থটি পড়লে আপনারা আমার কর্মময় জীবন সম্পর্কে জানতে পারবেন (উপস্থিত দর্শকের হাসি)। সবাইকে নিরন্তর শুভেচ্ছা।” 

১৯৭৭ সালে জন্ম এই ইমরান খানের, এখন মাত্র ৪৩ বছর বয়স তাঁর। এই বয়সেই তিনি তার স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখেছেন, নিজেকে আরো বেশি এক্সপ্লোর করছেন। তিনি বলেছিলেন এখানে তার মেধা বিকশিত করার সুযোগ নেই। তাই, গভমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে ১৯৯৪ সালে পাট চুকিয়ে সত্যি সত্যি পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

মেধা আর পরিশ্রমের যুগলিবন্দীতেই আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন ইমরান

ইমরান খানের কর্মজীবনের শুরুটা একেবারেই সাদামাটা। শুরুতে তিনি টেলিকম এনালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারপর জেপি মরগ্যান চেজ এন্ড কো কোম্পানিতে কয়েক বছর কাজ করে অসাধারণ পারফরমেন্সের সুবাধে হেড অফ রিসার্চ পদে পদোন্নতি হয় তার৷ প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী ম্যানেজিং ডিরেক্টরও তিনি।  কিন্তু, ইমরান নিজেকে এক্সপ্লোর করতে চেয়েছিলেন। রিসার্চ এনালিস্টের কাজ ছেড়ে এবার তিনি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে কাজ পেলেন জায়ান্ট কোম্পানি আলিবাবাতে। তার দক্ষতা, দূরদর্শিতা তাকে তার কর্মক্ষেত্রে করে তুলেছে অনন্য। তার সাহায্যে আলিবাবা ২০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ পায়। 

এই মেধাবী মানুষটি সিলিকন ভ্যালীতে বেশ আলোচিত হন। তাকে হায়ার করতে চায় অনেকেই৷ বিশ্বের প্রায় সব বিলিয়ন ডলার কোম্পানির প্রধান কার্যালয় সিলিকন ভ্যালিতেই অবস্থিত। গুগল, ফেসবুক এবং ইয়াহুর মত বড় বড় টেক জায়ান্টদের প্রধান কার্যালয় সিলিকন ভ্যালিতেই অবস্থিত। ইমরান খান এসব কোম্পানিতে জয়েন না করে গেলেন নতুন রাইজিং কোম্পানি স্ন্যাপচ্যাটে। এই কোম্পানিটির অন্যতম শীর্ষ পদ চিফ স্ট্রাট্রেজি অফিসার পদে তিনি যোগ দেন ২০১৫ সালে। তার কর্মদক্ষতায় কোম্পানিকে ভাল একটা অবস্থায় নিয়ে আসায় এখান থেকে তিনি শুধু বোনাস হিসেবেই বছরে ৫ মিলিয়ন ডলার পান। স্ন্যাপচ্যাটের ৭ মিলিয়ন শেয়ারের মালিক ইমরান খান, যার বাজারমূল্য ১৪৫ মিলিয়ন ডলার! 

এখন তিনি স্ন্যাপচ্যাট ছেড়ে দিয়েছেন। রয়টার্স, বিজনেস ইনসাইডার সহ বড় বড় সব গণমাধ্যম এই পদত্যাগের খবর ফলাও করে প্রচার করছে। তারাও জানতে আগ্রহী ইমরান নতুন কি করেন, কোথায় যান। ধারণা করা হচ্ছে, নিজের একটি স্টার্ট-আপ শুরু করতে যাচ্ছেন ইমরান খান, যেটিও হবে প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট।  একজন ‘নোবডি’ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন ইমরান। অথচ বেশি না মাত্র ২৫/২৬ বছর আগে তিনি যখন তরুণ, যখন তিনি সবাইকে বলতেন তিনি একদিন অনেক টাকার মালিক হবেন, কেউ বিশ্বাস করতেই পারেনি সে অর্থে। সবাই হেসেছে। 

ইমরান খান

কিন্তু, ইমরান বুঝেছিলেন এই হাসির অর্থ এখানে স্বপ্নের কথা শুনলে মানুষ সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না। ফানি ভেবে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তিনি ঠিকই বড় স্বপ্নই দেখেছিলেন, যে স্বপ্ন আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আজ থেকে ২৫ বছর বয়স আগের যে ভিডিও এখন ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, সেটি দেখে অন্তত আমাদের এখন বোঝা উচিত বড় স্বপ্ন কেনো দেখা দরকার৷ আজকাল বিসিএসের প্রতি ক্রেজ, একটা সরকারি চাকরি না পেলে আত্মহত্যা করছে মানুষ। কেউ বড় স্বপ্ন দেখছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের সর্বোচ্চ টার্গেট বড়জোর কোনো মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট কোম্পানিতে জয়েন করা না হয় বিসিএস দেয়া।

একই পথে এতো মানুষ, প্রতিযোগিতা বেশি, তাই মানুষের মধ্যে হতাশাও বেশি। আমাদের দেশে ছেলেরা কম্পিটিটর ভাবে নিজেদের। বিজন্যাস ফ্যাকাল্টির একটা ছেলে বড়জোর আইবিএ পড়ুয়া একটা ছেলেকে নিজের কম্পিটিটর ভাবে। অথচ তার চিন্তা করার কথা, স্বপ্ন দেখার কথা হার্ভার্ড-অক্সফোর্ডের স্টুডেন্টদের সাথে কিভাবে ফাইট দেয়া যায় সেটা। কিন্তু তা তো হয় না। উলটা নিজেই হতাশ হয়ে ড্রপ আউট সেলিব্রেটিদের কথা শেয়ার দিয়ে নিজের হতাশা আরও বাড়ায়। আমাদের দেশে মানুষজন অজুহাত দেখাতে বেশ ওস্তাদ। যেকোনো পরিস্থিতিতে একটা না একটা অজুহাত বের করে ফেলবেই। 

ইমরান খান কারো ফেভার পাননি। নিজের যোগ্যতা, মেধা দিয়ে তিনি এই পর্যায়ে। আর এই পর্যায়ে আসতে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। তার স্বপ্নের কথা শুনে লোকে হেসেছে, কখনো হয়ত অবিশ্বাস করেছে। অথচ, শুধু স্বপ্ন দেখে গেলেই, সেটার প্রতি সৎ থাকলে জীবন আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ ইমরান খান। যিনি কল্পনার নন, বাস্তবেরই রাজকুমার।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা