শেখ হাসিনার পাশে খন্দকার মোশতাকদের ভীড় বাড়ছে, সবেধন নীলমণি সৈয়দ আশরাফও এখন নেই। এই সময়টায় সোহেল তাজকে ভীষণ দরকার আমাদের।

অনেকেই বলেন, রাজনীতিতে নাকি ভালো মানুষেরা আসেন না। সেটা কতখানি সত্যি কে জানে, তবে ভালো মানুষেরা রাজনীতিতে বেশিদিন থাকতে পারেন না, সেটা খানিকটা হলেও সত্যি। নইলে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে হয়েও সোহেল তাজকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হয় না। 

দেশের ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে নিজের কাঁধে দায়িত্বভার তুলে নিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশের জন্ম যে কয়টা মানুষের হাতের ওপর হয়েছিল, সেই সূর্যসন্তানদের একজন ছিলেন কাপাসিয়ার বঙ্গশার্দূল তাজউদ্দীন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল জাতীয় চার নেতা, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ওরাই তো পারতেন সোনার বাংলার স্বপ্নকে জিইয়ে রাখতে, তাই কেন্দ্রীয় কারাগারে নভেম্বরের এক শীতল রাতে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাদেরকে।

আওয়ামীলীগ নামের দলটার নাম নিশানা মুছে যাবার জন্যে সেটাই যথেষ্ট ছিল। বঙ্গবন্ধু নেই, জাতীয় চার নেতা নেই, আওয়ামীলীগ অন্তপ্রাণ নেতাকর্মীরাও বেশীরভাগ জেলে, যারা মুক্ত তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেয়া দলটার নাম উচ্চারণও তখন নিষিদ্ধ ছিল, চারদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বীরদর্পে, সেই অস্থির সময়টায় আওয়ামীলীগের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধরে রেখেছিলেন একজন জোহরা তাজউদ্দিন, শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদের স্ত্রী! 

রাজনীতি যার রক্তে মিশে আছে, আওয়ামীলীগ নামের দলটাকে যিনি হৃদয়ে ধারণ করেন, সেই মানুষটা রাজনীতিতে আসবেন না, সেটা হয় না। ২০০১ সালে আওয়ামীলীগের অজস্র হেভিওয়েট প্রার্থী ভোটের ময়দানে হার মেনেছিলেন, সেই দুর্যোগের সময়টায় সোহেল তাজ নৌকা প্রতীকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে। বিএনপি জোট সরকারের সময়টায় বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে বরাবরই নানা জনমুখী দাবীতে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তিনি, পুলিশি নির্যাতনের মুখে পড়েছেন বারবার, তবুও রাজপথ ছাড়েননি। 

২০০৯ সালেও কাপাসিয়া থেকে নির্বাচনে জিতলেন, ক্ষমতায় এলো আওয়ামীলীগ সরকার, তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। কিন্ত মাত্র ছয়মাস দায়িত্ব পালন করার পরেই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। এরমধ্যে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছে, সরকার একটা নাজুক পরিস্থিতে তখন, সেই সময়টাতেই কোন এক অজানা অভিমানে রাজনীতি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ তনয়।

সোহেল তাজ

স্বচ্ছ একটা ইমেজের মানুষ ছিলেন সোহেল তাজ, ছিলেন স্পষ্টবাদী, বাবার মতোই বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণের অধিকারী। তাঁর অভিমানের কারণটা জানে না কেউ, নিজেও কখনও স্পষ্ট করে বলেননি। যে মানুষটার মধ্যে ভবিষ্যত নেতৃত্বের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলো সবাই, তিনিই হুট করে চলে গেলেন চোখের আড়ালে। তাঁর এই চলে যাওয়া নিয়ে কানাঘুষো কম হয়নি, কিন্ত সোহেল তাজ কখনোই এসব নিয়ে কথা বলতে চাননি, রাজনীতিতে ফেরার গুজবেও জল ঢেলে দিয়েছেন বারবার। 

কোন কিছু পরিবর্তন করতে হলে সেটার মধ্যে থেকেই পরিবর্তনটা আনতে হয়। সমস্যার গোড়ায় না দাঁড়িয়ে সেটারও সমাধান আনা যায় না। কাদা পরিস্কার করতে গেলে গায়ে খানিকটা ময়লা লাগবেই, সেই ময়লাটা ধুয়ে নিতে হয়, ময়লাকে এড়িয়ে যাওয়াটা সমাধান নয়। সোহেল তাজ ছিলেন আমাদের ভ্রষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, রাজনীতিবিদ মানেই খারাপ মানুষ, এই ইমেজটা যাদের দেখলে মনে হয় না, এরকম মানুষ হাতেগোনা দুই-চারজন আছেন এই দেশে। তাদের একজন ছিলেন সোহেল তাজ। ‘ছিলেন’ শব্দটা হয়তো ব্যবহার করতে হতো না তাঁর বেলায়, যদি না তিনি আরেকটু সাহস করে টিকে থাকতেন। তবে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে চাননি হয়তো, সেকারনেই নীরবে বিদায় বলে দিয়েছেন। 

মন্ত্রীত্ব, রাজনীতি কিংবা দেশ ছাড়লেও, দেশের মানুষের কাছে এখনও তিনি দারুণ আগ্রহের বিষয়, লোকে তাঁকে এখনও কি ভীষণ ভালোবাসে তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি দেশে ফিরলেই। কিছুদিন আগেই গাজীপুরে রাস্তায় তাঁকে দেখে চলন্ত বাস থেকেই স্যালুট ছুঁড়ে দিয়েছিল বাসের এক হেল্পার, সেটাকেই আবার ক্যামেরায় বন্দী করেছেন কেউ একজন। রাজনীতি না করেও তিনি মানুষের পাশে দাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, হটলাইন কমান্ডো নামে সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানের একটা মিশন তিনি হাতে নিয়েছেন, সেটা নিয়েও প্রচুর আলোচনা হয়েছে। মানুষের এমন ভালোবাসা পাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়, সোহেল তাজ সেটা অর্জন করে নিয়েছিলেন গুণে।

মন্ত্রীত্ব ছেড়ে আড়ালে ছিলেন অনেকদিন, কিন্ত মানুষ তাকে ভোলেনি

তাজউদ্দীন আহমেদ তখন মন্ত্রী নন। ছোট্ট সোহেলকে নিয়ে তাঁকে রোজ বিকেলে হাঁটতে দেখা যেতো আবাহনী মাঠে। বাবার কাছে শোনা গল্পগুলো, তাঁর কাছে পাওয়া শিক্ষাটা এখনও চলার পথে সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে আছে সোহেল তাজের কাছে। তাজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের কাণ্ডারীদের একজন ছিলেন, সোহেল তাজও হয়তো হতে পারতেন আধুনিক বাংলাদেশের এক নতুন স্থপতি। কিন্ত সেটা হয়নি। তাতে সোহেল তাজের ক্ষতি সামান্যই, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা বাংলাদেশের, এদেশের মানুষের। 

এই ক্ষতিটা হোক, সেটা আমরা কোনভাবেই চাই না। আজ সোহেল তাজের জন্মদিন, শুভেচ্ছা জানিয়েই তার কাছে আমরা প্রত্যাশা রাখি, অভিমান ভুলে তিনি রাজনীতিতে ফিরবেন অচিরেই। শেখ হাসিনার পাশে খন্দকার মোশতাকদের ভীড় বাড়ছে, সবেধন নীলমণি সৈয়দ আশরাফও এখন নেই। এই সময়টায় সোহেল তাজকে ভীষণ দরকার আমাদের। শেখ হাসিনার পাশে আমরা সোহেল তাজের মতো মানুষদের দেখতে চাই, সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী নেতাদের নয়...


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা