ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ে কখনও আমাদের অ্যানালগ বাবাদের খুঁজে পাওয়া গেল, কখনও বা আমাদেরই কোন শিক্ষকের ছায়া দেখলাম তার মাঝে। সাড়ে তিন মিনিটের পুরো বিজ্ঞাপনটাই যেন ইমোশনাল একটা রোলার কোস্টার রাইড হয়ে রইলো...

এদেশের বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রি একটা সময়ে নিয়মিত বিরতিতে দারুণ সব কাজ উপহার দিতো। কিছু বিজ্ঞাপন তো আমাদের শৈশব আর কৈশোরের নস্টালজিয়ার সঙ্গে মিশে আছে। এখন সেরকম দুর্দান্ত কাজ চোখে পড়ে খুব কম। একটা সময় মোবাইল অপারেটরদের বিজ্ঞাপনের জন্য হা করে বসে থাকতাম, নাটক সিনেমার মতোই গিলে খেতাম ডিজুস বা বাংলালিংক দেশের বিজ্ঞাপনগুলো, ঈদের আগে গ্রামীনফোনের স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার গানটা তো অন্যরকম একটা দোলা এনে দিতো মনে, 'ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে' গানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো সেটা কারো কারো কাছে। কিংবা সাড়া ফেলে দেয়া নারী দিবসের স্পেশাল সেই বিজ্ঞাপনটা- এমন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বিজ্ঞাপন এখন চোখে পড়ে খুব কম। 

সম্প্রতি সিম্ফোনির একটা ওভিসি দেখলাম অনলাইনে। করোনাকালে বদলে যাওয়া নিউ নরমালের গল্প নিয়ে বানানো হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন মিনিট দৈর্ঘ্যের সেই ভিডিও কমার্শিয়াল। ফজলুর রহমান বাবু অভিনয় করেছেন তাতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সেরা অভিনেতার তালিকা করা হলে যার নামটা সবার ওপরে রাখা যাবে নির্দ্বিধায়। একজন স্কুল শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি সেখানে, করোনার কারণে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে যাকে অনলাইনে ক্লাস নিতে হচ্ছে। 

গোটা বিজ্ঞাপনজুড়েই চোখ আটকে ছিল ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ে

বিজ্ঞাপনের গল্পটা এমন- হঠাৎ নির্দেশ এসেছে, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকলেও অনলাইনে নেয়া হবে ক্লাস। মধ্যবয়স্ক শিক্ষক ফজলুর রহমান বাবু পড়লেন বিপাকে। বাংলাদেশের আর দশজন মধ্যবিত্ত বাবার মতো তিনিও প্রযুক্তি সম্পর্কে মোটামুটি অজ্ঞ, মোবাইল বলতে শুধু কথা বলাটাকেই বোঝেন। সেই মোবাইল দিয়ে যে হাজার রকমের কাজ করা যায়, সেটা তার অজানা। কাজেই অনলাইন ক্লাসের নির্দেশনা পেয়ে তার মাথায় মোটামুটি আকাশই ভেঙে পড়লো। 

তবে ত্রাতা হয়ে এলেন তার দুই ছেলেমেয়ে। তারা বাবাকে বোঝাতে লাগলো, বাবার জন্য নতুন ফোনও কেনা হলো। কিন্ত এত সহজে কি আর হয় সমাধান? ক্লাস ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীর সামনে যে মানুষটা গমগমে গলায় নির্ভুলভাবে কবিতা আবৃত্তি করে যান, তিনিই কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন মোবাইলের ক্যামেরাটা দেখে। গলা থেকে স্বর বেরুচ্ছে না, আটকে যাচ্ছে কথা- হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি বলে ফেলছেন, "নাহ, এই মোবাইলে ক্লাস ফ্লাস আমি নিতে পারব না! হেডস্যারকে বলে দিচ্ছি..."

স্কুল শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাবু

কিন্ত করব না বললেই তো পার পাওয়া যায় না। মাসের পর মাস তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের দেখেন না, তাদের দুষ্টুমি সহ্য করতে হয় না তাকে, বকা দেয়া হয় না, আদর করতে পারেন না- ছাত্র-ছাত্রীরা তো তার কাছে ছেলে-মেয়ের চেয়ে কম কিছু নয়, একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মিস করার অনুভূতিটাও চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। অদ্ভুত একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন ফজলুর রহমান বাবু, দ্বিধা কমে না, কাটে না জড়তা। 

ছেলেকে তিনি বিচিত্র সব প্রশ্ন করেন, অনলাইন ক্লাসে কি সবাইকে দেখা যায়? ছাত্র-ছাত্রীরা দুষ্টুমি করলে সেটা বোঝা যাবে কিভাবে? বিজ্ঞাপনের এই বাবার মধ্যে যেন আমরা আমাদেরই বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই, ডিজিটাল যুগের বাসিন্দা হয়েও যারা এখনও অ্যানালগে পড়ে আছেন, প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে যাওয়াটা যাদের কাছে চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ, তবে জীবনের আরও হাজারটা প্রতিকূলতার মতো এই চ্যালেঞ্জেও তারা অংশ নেন, জিতেও আসেন। 

বিজ্ঞাপনের শেষ অংশে ফজলুর রহমান বাবু যখন উদাস কণ্ঠে তার ছাত্রছাত্রীদের বলছেন, "তোদের ছাড়া ভালো লাগে না। তোরা ক্লাসে হইচই করবি, দুষ্টামি করবি, তোদের বকা দেব, শাসন করব...কতদিন পর তোদের দেখলাম... তোরা সবাই ভালো আছিস তো?" - ওই সংলাপটাই স্কুল জীবনের সোনাঝরা দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। বাবুর মধ্যে যেন আমাদের শিক্ষকদেরই খুঁজে পেলাম, যারা আমাদের বকতেন, শাসন করতেন, আবার আমাদের অর্জনে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, সবার চেয়ে বেশি আদরও করতেন। 

বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছে পিংক ক্রিয়েটিভ লিমিটেড

সাড়ে তিন মিনিটের পুরো বিজ্ঞাপনটাই যেন ইমোশনাল একটা রোলার কোস্টার রাইড হয়ে রইলো। অল্প সময়ে চমৎকার একটা গল্প বলে ফেলার মতো কঠিন কাজটা যেন অবলীলায় সম্পন্ন হয়ে গেল পিংক ক্রিয়েটিভের বানানো এই বিজ্ঞাপনে। মোবাইল কোম্পানী সিম্ফোনির বারো বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বানানো এই ওভিসিটা যে করোনাকালে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে হওয়া সেরা কাজগুলোর একটি হয়ে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই কোন...

'সময়কে করবো জয়' শিরোনামের ওভিসিটি দেখতে ক্লিক করুন এই লিংকে-

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা