সোনম ওয়াংচুক: বাস্তবের র্যাঞ্চোর দাস শ্যামালদাস চাঞ্চাড!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সেলুলয়েডের পর্দার সেই র্যাঞ্চোর দাশ কিন্তু কল্পনার কোন চরিত্র নন। আমির খান অভিনীত সেই চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল বাস্তবের এক ফুংসুক ওয়ানডুর জীবনীর অনুপ্রেরণায়। তার নাম সোনম ওয়াংচুক।
ফুংসুখ ওয়াংডুর কথা মনে আছে? ওই যে থ্রি ইডিয়টস মুভির সেই খেয়ালী বিজ্ঞানী, যে কিনা প্রথাগত শিক্ষার বিবেচনায় অসাধারণ প্রতিভাবান হয়েও একঘেয়ে আর ভালো ফলাফলনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিনব উপায়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিল উচ্চশিক্ষার নামে বাগাড়ম্বরের অসারতা? সেলুলয়েডের পর্দার সেই র্যাঞ্চোর দাশ কিন্তু কল্পনার কোন চরিত্র নন। আমির খান অভিনীত সেই চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল বাস্তবের এক ফুংসুক ওয়ানডুর জীবনীর অনুপ্রেরণায়। তার নাম সোনম ওয়াংচুক। একাধারে প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় সোনম জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলটা পাল্টে দিয়েছেন তার অপরিমেয় প্রতিভা আর সৃজনশীলতায়।
১৯৬৬ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর লাদাখের ‘উল’-এ জন্মগ্রহণ করা সোনম ওয়াংচুকের ছোটবেলাটা কেটেছে শ্রীনগরে। বাবা সোনম ওয়াংগ্যাল ছিল ভারত সরকারের মন্ত্রী, কিন্ত স্থানীয় ভাষা একেবারেই ভিন্ন হওয়ায় সোনম কোনভাবেই মানিয়ে নিতে পারেনি স্কুলের পরিবেশ। ওই যে, প্রথাগত ভালো রেজাল্টভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা, তারই করুন বলি হতে হয়েছিল ছোট্ট সোনমকে। কারণ আর দশটা ছেলের তুলনায় সোনম একটু ভিন্ন হওয়ায় শিক্ষকেরা তাকে ভাবতো নির্বোধ জড়পদার্থ, ফলে তার স্কুল জীবন হয়ে উঠেছিল বিভীষিকার অন্য নাম।
শেষমেষ টনক নড়ে পরিবারের। সোনমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দিল্লীতে সরকারী আবাসিক স্কুলে। সেখানে শিক্ষকদের অকুণ্ঠ সহায়তায় সোনম ফিরে পায় তার আত্মবিশ্বাস। মাত্র ২১ বছর বয়সে শ্রীনগর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ব্যাচেলর ডিগ্রি কমপ্লিট করেন তিনি। তার মতো প্রতিভাধর কেউ এরপর হয়তো নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাবতেন। কিন্তু সোনম ওয়াংচুক যে আলাদা ধাতুতে গড়া!
ব্যাচেলরের পরপরই সোনম চলে এলেন তার জন্মস্থান লাদাখে। তার মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ফেরত কয়েকজন প্রতিভাবান লাদাখিয়ান ক্র্যাক পিপলকে নিয়ে গড়ে তুললেন স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ (এসইসিএমওএল)। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল লাদাখের প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা, প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা, বাবা-মা’দের সচেতন করা, রেডিও প্রোগ্রামসহ নানাভাবে সৃজনশীল শিক্ষার গুরুত্ব প্রচার, লাদাখের তরুণ জেনারেশনের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণে সমস্যা এবং সরকারের সাথে মিলে এমনভাবে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো যেন তরুণদের স্রেফ ভালো রেজাল্টভিত্তিক প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে হাঁসফাঁস করতে না হয়।
পরিচিত লাগছে কথাগুলো? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। সোনম ওয়াংচুক তার শৈশবে পড়ালেখার নামে যে বিভীষিকার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার মুখোমুখি যেন আর কোন শিশুকে না হতে হয়, যেন তার ভেতরের সুপ্ত সৃষ্টিশীলতার ফুল অঙ্কুরেই নষ্ট না হয়ে যায়, সে জন্যই তার এ আপ্রাণ প্রচেষ্টা। আর তার এ প্রচেষ্টাকেই রাজকুমার হিরানি এবং আমির খান অসাধারণ মুন্সিয়ানার সাথে তুলে এনেছেন থ্রি ইডিয়টসে, দেখিয়েছেন উচ্চশিক্ষার বিস্তৃত সৃজনশীল মঞ্চ কিভাবে ভালো রেজাল্ট করবার আর ভালো চাকুরি পাবার ইঁদুরদৌড়ে পরিণত হয়েছে!
এ তো গেল শিক্ষা সংস্কারক সোনম ওয়াংচুকের কথা। তার আসল গল্পটা তো এতোক্ষণ আপনাদের বলাই হয়নি। সেই যে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়েছিলেন সোনম, মনে আছে আপনাদের? সেই সোনম এরপর প্রমাণ করেন, স্রেফ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফোর আউট ফোর সিজিপিএই কারোর যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। সবসময়ই ভালো রেজাল্ট ভালো চাকুরীর ইঁদুরদৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা সোনম স্রেফ নিজের প্রতিভা আর চেষ্টার জোরে পাল্টে দেন জন্মভূমি লাদাখের চেহারা।
“Ice Stupas” বা বরফ-স্তুপ নামের এই প্রজেক্টটি দূর করে লাদাখের বহুদিনের খরা এলাকার সেচ সমস্যা, হাসি ফোটায় অগণিত কৃষকের মুখে। পশ্চিম হিমালয় অঞ্চলের খরা এলাকার চাষাবাদের পানির সমস্যা অনেকদিন ধরেই। সি-লেভেল থেকে প্রায় ৩৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত লাদাখ এলাকায়, বিশেষ করে কুনলুন থেকে বৃহত্তর হিমালয়ের মালভূমি এলাকায় তীব্র পানি সংকট চলে এপ্রিল-মে মাসে। আবার জুনের মাঝামাঝি খুব দ্রুত বরফ গলে যাওয়ার কারণে পাহাড়ী ঢলে মাঝে মাঝে বন্যাও দেখা দেয়। মুশকিল হচ্ছে এপ্রিল-মে’র সময়টাতেই কৃষকেরা ফসল ফলায় এবং সেচের পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়। সোনম ওয়াংচুক এ সমস্যার সমাধানে কাজ করছিলেন অনেকদিন ধরেই। এরই ফলশ্রুতিতে জন্ম “Ice Stupas” প্রজেক্টের।
এ প্রজেক্টের আওতায় সোনম শীতকালের অপচয় হওয়া পানির প্রবাহকে বরফে পরিণত করে সংরক্ষণ করে তা এপ্রিল-মে মাসে তীব্র খরার সময় ব্যবহারের পরিকল্পনা করলেন। অর্থাৎ কোণক আকৃতির কৃত্রিম টিলায় পানির প্রবাহ ধরে রেখে তা কৃষকদের সেচ কাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা করলেন। ‘লেহ’ তে তৈরি হলো ৬ মিটার অর্থাৎ ২০ ফুট উঁচু একটি “Ice Stupa”, যাতে প্রায় ১,৫০,০০০ গ্যালন পানি মজুদ করে রাখা হলো সূর্যের আলো থেকে বাঁচিয়ে।
হাসি ফুটলো কৃষকের মুখে, লাদাখের চিত্র পাল্টে গেল এক লহমায়! মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই বিজ্ঞানী তার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ Rolex Awards for Enterprise লাভের মধ্যে দিয়ে। “Who have reshaped the world with their innovative thinking and dynamism” স্লোগানের উপর ভিত্তি করে দেওয়া এই পুরস্কার ওয়াংচুক লাভ করেন তার “Ice Stupas” প্রজেক্টের জন্য।
সোনমের এ প্রজেক্ট লাদাখের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছেছে সুইজারল্যান্ডেও। ২০১৬’র সেরা পাঁচ উদ্ভাবকের একজন নির্বাচিত হন তিনি। রোলেক্সের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘রোলেক্স অ্যাওয়ার্ড থেকে পাওয়া ফান্ড তার “Ice Stupas” প্রজেক্টকে অনেক সহায়তা করবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে খরা অঞ্চলে পূনরায় সবুজ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।’
শুধু এই পুরস্কারই নয়, শিক্ষা সংস্কারে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৬ সালে ভারত সরকারের বিশেষ সম্মাননা, ২০১৪ সালে UNESCO Chair for Earth Architecture সহ অসংখ্য স্বীকৃতি অর্জনকারী এই বিজ্ঞানীর পরবর্তী লক্ষ্য লাদাখে ৬৫ হেক্টর জমির উপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেশালাইজেশন হবে নিজস্ব রিসোর্স ব্যবহার করে হিমালয় ও তার আশেপাশের পার্বত্য অঞ্চলসহ পৃথিবীর সকল পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলের জলবায়ু সমস্যার সমাধান করা।
আজ শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সবকিছুই যখন স্রেফ বাণিজ্য, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া, ভালো রেজাল্ট, ফোর আউট অফ ফোর সিজিপিএ আর কর্পোরেট দুনিয়ায় একটা লোভনীয় চাকুরীর লুপে আটকে গেছে, তখন সোনম ওয়াংচুকের মত পর্দার অন্তরালের প্রতিভাবানেরা নিঃশব্দে স্রোতের উল্টোদিকে দাঁড় বেয়ে চলেন। সে যাত্রায় হয়তো টাকার ঝনঝনানি নেই, নেই খ্যাতির সস্তা আলো ঝলসানি। কিন্তু তাতে আছে মানুষের মত মানুষ হবার তৃপ্তি,মানুষের জন্য কিছু করতে পারার অপরিমেয় আনন্দ। চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া এক অনির্বচনীয় সত্য-
‘হাজারো চাতুরের ভিড়ে এই পৃথিবীর অনেকগুলো রাঞ্চোর দাস শামালদাস চাঞ্চাডের বড্ড বেশি প্রয়োজন!’
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন