ইতালির এক সাধারণ তরুণী যেভাবে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হয়েছিলেন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একজন সোনিয়া গান্ধী, যার বিপরীতে লাগাতার কুৎসা রটানো, যার জাতীয়তা-রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে শুরু করে এমনকি হিন্দি উচ্চারণ নিয়েও হাস্যরস করেছে প্রতিপক্ষরা, তিনি কিনা শূন্য আশা থেকে কংগ্রেসকে পুনরায় জিতিয়ে এনেছিলেন সবাইকে চমকে দিয়ে।
২০০৪ সালের ১৮ মে, দিল্লীর এক সকালের কথা। দিল্লীর রাস্তায় ভোর থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা বড় জমায়েত দিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করছে। 'এন্টি সোনিয়া' প্লেকার্ড হাতে তারা। অপরদিকে একটু পরেই পার্লামেন্ট ভবনের একটি হলে কংগ্রেসের নির্বাচিত সাংসদদের বৈঠক হবে, যেখান থেকে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হচ্ছেন সেটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে।
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যাজিক ফিগার পেরোতে না পারলেও কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজবাদী দলের সমর্থন পেয়েছে, যা তিনটি নির্বাচন পর তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে মসৃণ করেছে। জোট এবং জোটের বাইরের সকল দলই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ব্যাপারটিও কংগ্রেসের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়। সুতরাং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বড় বড় মিডিয়া হাউজ থেকে শুরু করে সর্বত্রই সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে আলোচনা। গান্ধী পরিবারের ইতালিয়ান পুত্রবধূই কি তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের ১৩ তম প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন! কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে যে নাটকীয়তার শেষটুকু তখনো লেখায় হয়নি।
হলে প্রবেশ করলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হল চারদিক। এরপরেই নেমে এলো পিন পতন নীরবতা, বক্তব্য দিতে উঠলেন সোনিয়া। এক পর্যায়ে সোনিয়া জানিয়ে দিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব চান না, নিজের জায়গায় মনমোহন সিং এর নাম প্রস্তাব করলেন।
'নো' শব্দের প্রকম্পে কেঁপে উঠলো পার্লামেন্টিরিয়ান ভবন। তবুও এতটুকু টলানো গেল না সোনিয়া গান্ধীকে। কিন্তু কেন? শাশুড়ি ও স্বামীকে হারানোর বেদনা ও জন্মানো অভিমান কি তখনো কমেনি সোনিয়ার? এত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েও কি কেউ ঠেলে দেয় বুঝি? সোনিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় হতবাক হয়ে রইলো ভারতবর্ষ। চমকে পিছু হটলো হিন্দুত্ববাদীরাও।
সাল ১৯৬৫, ক্যামব্রিজ শহরের 'ভার্সিটি' নামের একটি গ্রিক রেস্টুরেন্টে ইন্দিরা গান্ধীর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজীব খোশ মেজাজে রাজনৈতিক আড্ডা দিচ্ছেন তাঁর ভাই সঞ্জয় ও দুই পাকিস্তানি বন্ধুর সাথে। এমন সময় রাজীবের দৃষ্টি আটকে গেল এক ইতালিয়ান সুন্দরী রমণীর দিকে, যে তাদের টেবিলের পাশ দিয়ে গিয়ে খানিকটা জানলার সাথে বসলো।
মেয়েটির চঞ্চলতা দেখে রাজীব বুঝতে পারলেন খুব সম্ভবত কোনো কাজেই এসেছে। অবশ্য কাজে রাজীবের কী এসে গেল! তিনি যে বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুগ্ধ হয়ে আড়চোখে তকাচ্ছেন বারবার। পরে তো মেয়েটিকে এক পলক দেখার জন্য রাজীব দাঁড়িয়েই যাচ্ছিলেন। একদম প্রথম দেখায় ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তাই যেন হয়ে গেল। তবে প্রথম দেখায় ভালোবাসা যে একতরফাভাবে হয়েছিলো, সেই ভুল ভাঙলো কদিন পরেই, যখন রাজীব এক পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে ফের দেখা পেলেন সেই মেয়েটির।
এবার ইতালিয়ান মেয়েটিও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন, সেদিন রেস্টুরেন্টে তাঁর প্রতি রাজীবের দৃষ্টি একদমই চোখ এড়ায়নি। এটা জানতেই এক মুহুর্ত দেরি না করে রাজীব সরাসরি দুর্বলতার কথা জানিয়ে দিলে মেয়েটি কিঞ্চিৎ অবাক হন। কিন্তু জবাবে দ্রুত তিনিও তাতে সাঁয় দেন। আচ্ছা এরপর তৎক্ষণাৎ ইতালির এক ছোট্ট গ্রামে খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া বিশ বছর বয়সী সোনিয়া মাইনো কি বুঝেছিলেন, জীবনের কোন মোড়ে তিনি প্রবেশ করছেন?
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সবটাই জানেন। মেনেও নিয়েছেন, কারণ তিনি চাচ্ছেন না তাঁর পরিবার নিয়ে মিডিয়ায় কোনো রকমের নেতিবাচক ও রসালো খবর তৈরি হোক। তাই লন্ডন সফরে সোনিয়াকে দেখে, তিনি রাজীবকে সম্মতি দিয়ে এসেছেন। এখন দ্রুত বিয়ে হওয়ার পালা।
রাজীব এশিয়ার একটি বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় সোনিয়া মাইনোর পরিবার, বিশেষত পিতা স্টেফানো মাইনো শুরুতে এই সম্পর্ক মেনে না নিলেও সোনিয়ার প্রতি রাজীবের একাগ্রতাকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। অবশেষে ১৯৬৮ সালে তিন বছরের প্রণয় পরিণতি লাভ করে। আভিজাত্যময় গান্ধী পরিবারের বড় বউ একজন সাদা চামড়ার বিদেশি, হইচই পড়ে গিয়েছিলো সমগ্র ভারতেও। কিন্তু রাজনীতি থেকে রাজীব কয়েকশো হাত দূরে থাকায়, এই সমালোচনা সেই সময় হালে অতটা পানি পায়নি।
ইতালিয়ান হওয়া সত্ত্বেও গান্ধী পরিবারের বড় পুত্রবধূ হিসেবে সোনিয়া যথাযথভাবে সামলে যাচ্ছিলেন পারিবারিক দায়িত্বগুলো। তাঁর প্রতি শাশুড়ি ইন্দিরার স্নেহও ছিল প্রবল। দেবর সঞ্জয় গান্ধী রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও রাজীব গান্ধী এয়ারলাইনের পাইলট-কেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এয়ার ইন্ডিয়ায় কর্মরত থাকার বাইরে ফুটফুটে এক ছেলে ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাথে সুখী সময় পার করছিলেন তিনি।
কিন্তু এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না। দেশজুড়ে এক প্রকান্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখিয়ে ইমার্জেন্সী ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। এর ঢেউ এসে লাগলো জনপথ বাসার উঠোনেও। রাজীব-সোনিয়া এসব থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখলেও মা ও ছোট ভাই রাজনৈতিক প্রতিকূলতা মুখোমুখি হওয়ার প্রভাব তাদের জীবনেও স্বাভাবিকভাবে পড়লো।
১৯৭৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো একজোট হওয়ায় ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়। পুনরায় কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরানোর জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে দৌড়ঝাঁপ তো চলছিলোই। দুবছর পর ফের জাতীয় নির্বাচন হলে সঞ্জয়ের সক্রিয় ক্যারিশমা ও ইন্দিরার প্রজ্ঞায় ফের কংগ্রেস ক্ষমতায় এলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাগুলো যে তখনো সোনিয়া গান্ধীর জন্য অপেক্ষা করছিলো!
১৯৮০ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন সঞ্জয় গান্ধী, যাকে দেশ, জাতি এবং দলের আগামীর কান্ডারি হিসেবেই সবাই মেনে নিয়েছিলো। বিদেশে সফররত রাজীব ভাইয়ের মৃত্যু শুনে দেশে ফিরে আসেন এবং অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন। এর এক সপ্তাহ পর স্বামী স্বরূপানন্দ- এর কাছে গেলে, তিনি রাজীবকে পাইলট এর পেশা ছেড়ে দেশসেবায় মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন।
তবে এদিকে সোনিয়া চাইছিলেন না রাজীবের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটুক। কিন্তু তরুণ নেতৃত্ব হারিয়ে কংগ্রেসের ভিতরে বিভিন্ন মহলে তখন রাজীবের জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাচ্ছিলো। এর কিছুদিন পরেই কংগ্রেস পার্টির সত্তর জন সদস্য ইন্দিরা গান্ধীর নিকট একটি লিখিত আবেদনে রাজীবকে রাজনীতিতে দেখতে চাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। রাজীবও মায়ের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ছেড়ে দেন।
অবশেষে প্রিয় স্ত্রীর শত বারণ অগ্রাহ্য করে মায়ের সম্মতিতে এর কয়েক মাস পরে ‘আমেথী’ থেকে নির্বাচন করেন এবং জিতে আসেন তিনি। এদিকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মেনকা গান্ধীর নানান ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা ও দূরত্ব তৈরি হয়, যা কোর্ট কাচারি পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মেনকা গান্ধী ঘর ছাড়লে গান্ধী পরিবার ভেঙে যায়। ঐ মুহুর্তে পরিবার ও শাশুড়িকে সামলাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন সোনিয়া।
কিন্তু ১৯৮৪ সালে নিজ দেহরক্ষী দ্বারা ইন্দিরা গান্ধী খুন হলে দলের সম্পূর্ণ ভার এসে পড়ে রাজীবের ওপর। অগত্যা রাজীবকে আরো বেশি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয়, যদিও সোনিয়ার এতে কোনদিন সম্মতি ছিল না।
১৯৮৪ সালে রাজীবের নেতৃত্বে কংগ্রেস এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। রাজীব ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। স্বামীর সাথে মানসিক ও শারীরিকভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সোনিয়াও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সফরে রাজীবের পাশে সোনিয়া হয়ে উঠেন প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু তাতেও সোনিয়া বেশ নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে দিন পার করছিলেন যে, সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে ঘরে পড়ালেখা করানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য হন। এই ভীতি ও আশংকা পরিণতি লাভ করলো কয়েক বছর পরেই। চেন্নাইয়ে এক নির্বাচনী জন সমাবেশে শ্রীলংকান জঙ্গী সংগঠন তামিল টাইগারের কয়েকজন সদস্যের আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহন হন রাজীব গান্ধী।
অকূল পাথারে পড়লেন সোনিয়া। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে পরিবারের তিন মূল সদস্যকে হারিয়ে গান্ধী পরিবারও যেন রাজনীতিতে এক অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হলো। সব দায়িত্ব এসে পড়লো সোনিয়ার কাঁধে। কী অদ্ভুত, তাই না? নেহেরু-গান্ধী পরিবারের ভবিষ্যৎ পথচলা নির্ভর করছে এক ইতালিয়ান মহিলার ওপর!
কী করবেন ভেবে পান না সোনিয়া। সন্তানদ্বয় নিয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইলেন। সন্তানেরাও মায়ের সিদ্ধান্তকে জোরালোভাবে সমর্থন জানায়। অপরদিকে প্রণব মুখার্জির নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটা অংশ সোনিয়ার নিকট দলের দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানালে সোনিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। নরসিমা রাও এর নেতৃত্বে কংগ্রেস ৯১ এর নির্বাচন জিতে আসলে, সোনিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।
গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশ হতে কংগ্রেস সম্পূর্ণ বিলুপ্তের পথে হাঁটতে থাকে। এমনকি মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো হিন্দি হার্ট লাইন অঞ্চলে কংগ্রেসের একক নিয়ন্ত্রণ লোপ পেতে থাকে। রাম মন্দির-কে জাতীয় ইস্যুতে রূপ দিয়ে বেশ পাকাপোক্তভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দামামার সূচনা করে দিয়েছে বিজেপিও। দলটির প্রধানতম নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী তখন অভিজ্ঞ স্টেটমেন্ট, দেশের ক্ষমতায় শিখরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর।
অবশেষে যা হওয়ার তাই হলো, ৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে বাজপেয়ীর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় বিজেপি। আর নির্বাচনের হারের পর, দলেও বহুমুখী ভাঙণ তৈরি হয়। মাধবরাও সিন্ধিয়া, অর্জুন সিং, মমতা ব্যানার্জি, পি চিদাম্বরমের মতো জনপ্রিয় নেতারা দল ছাড়েন। এদিকে দলের একটি পক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন সোনিয়া গান্ধীর সাথে।
অবশেষে অনেক অনুনয়ের পরে সোনিয়া গান্ধীর সম্মতিতে ১৯৯৭ সালে কংগ্রেসের পার্টির সদস্য মনোনীত করা হয় তাঁকে। বিজেপি একক বা জোটগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বা ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় দেড় বছর পর আবারো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সীতারাম কেসোরির নেতৃত্বে আবারো কংগ্রেস ব্যর্থ হয়। এটি নিয়ে প্রথমবারের মতো টানা দুটি নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলো। এরপরেই পার্টি নেতা নির্বাচিত হন সোনিয়া গান্ধী।
এবারের সংগ্রামটা সবচাইতে কঠিন এবং ভিন্ন। নামের শেষে গান্ধী থাকলেও উপমহাদেশের সবচাইতে সুপ্রাচীন সংগঠনকে নেতৃত্ব দেয়া তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাছাড়া পরিবারে থেকে রাজনীতিকে দেখলেও সরাসরি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়াটা অবশ্যই ব্যতিক্রম এবং কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মানসিকভাবে শক্তিশালী সোনিয়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সিদ্ধান্ত নিলেন দৃঢতার সাথেই।
শারদ পাওয়ার, পি সাংমা, তারিক আনোয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতা সোনিয়ার পার্টি প্রধান হওয়ার বিষয়ের কট্টর বিরোধিতা করেন এবং সোনিয়ার জাতীয়তার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দল ত্যাগ করে নতুন দল তৈরি করেন। দায়িত্ব নিয়ে ভাঙণের সম্মুখীন দল, সোনিয়া ঘাবড়ালেন না। বরং আরো সক্রিয় হলেন। অর্জুন সিং, চিদাম্বরমের মতো কিছু পুরোনো নেতাও ফিরে আসে দলে।
১৯৯৯ সালে আবার নির্বাচন হলো। প্রত্যাশিত জয় পেলেন বাজপেয়ী এবং এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করলেন। সোনিয়া দুটি আসন থেকে নির্বাচন করে প্রতিটি জেতেন, একটিতে বিজেপির ভ্যাটেরান নেত্রী সুষমা স্বরাজকেও পরাজিত করেন। দায়িত্ব গ্রহনের মাত্র এক বছর পর নির্বাচনে হেরে গেলেও, সমালোচক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সোনিয়াকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এতকিছুর মধ্যে হারের দায় নিয়েই সোনিয়া বিরোধী দলীয় নেত্রী নির্বাচিত হলেন।
এরপরেও পাঁচ বছর কেবলই দলকে নতুন আঙ্গিকে উজ্জীবিত করার লড়াই চলছিলো। খুব বেশি জনসম্মুখে এসে রাজনীতি না করলেও পার্টির নেতাদের একবিন্দুতে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। দলের মাঝে অযথা তৈরি কোন্দল তিনি শক্ত হাতে দমন করেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ নেতা রাজেশ পাইলট, মাধবরাও সিন্ধিয়াকে অকালে হারানোর পর তাদের সন্তানদেরও তিনি রাজনীতিতে নিয়ে আসেন, যা পরবর্তীতে দলের জন্য সুফল বয়ে আনে। ছেলে রাহুল গান্ধীরও রাজনৈতিক অভিষেক ঘটান।
এবার ২০০৪ সালে নির্বাচনের পালা। ফল প্রকাশের আগেরদিনও কেউ ঘুণাক্ষরে ভাবেনি কী হতে চলেছে। অটল বিহারি বাজপেয়ী টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন তা অনুমিতই ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে খেলার রঙ পাল্টাতে শুরু হয় সকাল থেকে। দিনশেষে ফলাফল এমন গিয়ে দাঁড়ালো, কংগ্রেস তখন বিজেপির চেয়ে আটটি সীট বেশি। এককভাবে ১৪৫, জোটগতভাবে ২১৮। তখনও প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্তিতে ষাটটির মতো আসন বাকি।
কিন্তু এতে আর কী এসে গেলো, বিজয়ের দামামা তো বেজে উঠেছে। তবে সোনিয়া নির্ভার হলেন না। সকল অহংবোধকে চূর্ণ করে তিনি আঞ্চলিক দলের নেতাদের সাথে গিয়ে গিয়ে দেখা করলেন, সরকার গঠনে সমর্থন চাইলেন। অবশেষে সমর্থন আদায় করলেন।
একজন সোনিয়া গান্ধী, যার বিপরীতে লাগাতার কুৎসা রটানো, যার জাতীয়তা-রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে শুরু করে এমনকি হিন্দি উচ্চারণ নিয়েও হাস্যরস করেছে প্রতিপক্ষরা, তিনি কিনা শূন্য আশা থেকে কংগ্রেসকে পুনরায় জিতিয়ে এনেছেন। এক বিদেশিনীর ত্রাতার ভূমিকায় কিনা ক্ষমতার মসনদে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টি।
ইতালির 'ভিকেঞ্জা' নামক গ্রাম থেকে দিল্লীর '১০,জনপথ', সোনিয়া গান্ধীর পথচলাটা ট্র্যাজেডি ও অনিশ্চিয়তায় ভরপুর, অবিস্মরণীয়। আমি জানি না আজকে প্রায় পাঁচ দশক পর, একজন সোনিয়া গান্ধী কীভাবে নিজের ব্যক্তি জীবনকে মূল্যায়ন করেন।
তিন দশক ধরে কংগ্রেস পার্টির প্রধান নেত্রীই কেবল নন, কাজ করেছেন অটিজম এর মতো বিষয় নিয়েও। বিশ্বনেত্রী হিসেবেও সমাদৃত হয়েছেন। আসলে দায় এবং দায়িত্ববোধ মানুষকে কতটুকু জীবন সংগ্রামে এগিয়ে নিয়ে যায়, সোনিয়া গান্ধীর জীবনই হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
আরও পড়ুন-
- যে ছয়টি নারী আন্দোলন বদলে দিয়েছে ইতিহাস!
- সালেহা জাবীন: আমেরিকান এয়ারফোর্সের প্রথম নারী ইমাম হয়েছেন যিনি!
- রুমানা মঞ্জুর: স্বামীর নির্যাতনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে আইনজীবী হয়ে ওঠা অদম্য এক নারী!
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন