টুইটারে এক ছেলে সনু সুদকে ট্যাগ করে লিখেছে, অনেকদিন সে মাকে দেখে না, লকডাউনের কারণে বাড়ি যেতে পারছে না সে, সনু কি তাকে সাহায্য করবেন? সনু তাকে রিপ্লাই দিয়েছেন, 'মাকে বলে দাও, এবারের ঈদ তুমি মায়ের সাথে করছো!' তারপর প্লেনের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছেন সেই ছেলের জন্য...

ভারতীয় অভিনেতা সনু সুদের জন্মদিন ছিল গতকাল। জন্মদিন ছিল ক্রিস্টোফার নোলানের, একই দিনে জন্মেছেন কিংবদন্তী গায়ক সনু নিগমও। অর্জন এবং নামের ভারে শেষ দুজন এগিয়ে থাকবেন যোজন যোজন, কিন্ত তাদের ছাপিয়ে গতকাল টুইটারে শুভেচ্ছার ঝড় উঠেছিল সনু সুদের নামে, হ্যাপি বার্থডে সনু সুদ হ্যাশট্যাগ তো নাম্বার ওয়ান ট্রেন্ড ছিল ইন্ডিয়াতে। শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার প্লাবনে ভেসে গেছেন এই অভিনেতা। অবশ্য, এগুলো সনু সুদের প্রাপ্য ছিল, ভালোবাসার এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা তিনি ডিজার্ভ করেন। করোনার ক্রান্তিকালে নিজের তারকাখ্যাতিকে তুলে রেখে যেভাবে তিনি সর্বস্ব উজাড় করে কাজ করেছেন, সেটাকে অবিশ্বাস্য বললেই কম হয়ে যাবে।

সিনেমায় তিনি খলনায়ক। দুনিয়ার যতো খারাপ কাজ আছে সব করে বেড়ান। খুন, রাহাজানি, মাফিয়াগিরি, নারী পাচার, ড্রাগের ব্যবসা, সব। সেখানে তিনি অত্যাচারী এক প্রতিমূর্তি, সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করা যার কাজ। অথচ বাস্তব জীবনে এই মানুষটাই হাজির হয়েছেন একদম ভিন্ন এক অবতারে, তিনি গরীব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যতোটা পেরেছেন। করোনার ক্রান্তিকালে তার মানবিক রূপটাই দেখেছে গোটা ভারত, এমন মানবিকতায় মুগ্ধ হয়েছে সবাই। 

করোনাভাইরাসের কারণে আচমকা শুরু হওয়া লকডাউনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়েছিল অভিবাসী শ্রমিকেরা। অভিবাসী বলতে কিন্ত ভীনদেশী নন, হয়তো পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের কোন দিনমজুর নিজের এলাকায় কাজ না পেয়ে দিল্লি বা মুম্বাইতে কাজ করতে গেছে, এদেরকে বলা হয় অভিবাসী শ্রমিক। লকডাউন শুরু হবার পরে এই লোকগুলো পড়েছিল সবচেয়ে বিপদে। তাদের হাতে জমানো টাকাপয়সা ছিল না, কাজ বন্ধ, সরকারী সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছে না- সব মিলিয়ে মানবেতর একটা অবস্থা! যেটা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। 

সনু তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, তার মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের খাবার রান্না হয়েছে, সেগুলো প্যাকেট করে বিতরণ করা হয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে। একটা সময় সবাই বুঝতে পেরেছে, এভাবে মাসের পর মাস হাজার হাজার মানুষকে খাওয়ানোটা অসম্ভব একটা কাজ, তখন এই শ্রমিকরা ফিরে যেতে চেয়েছে নিজ নিজ এলাকায়। কিন্ত বাস-ট্রেন সব তো বন্ধ, কিভাবে যাবেন তারা? 

শ্রমিকদের বাসে তুলে দিচ্ছেন সনু সুদ

সনু তখন হাজির হয়েছেন দেবদূত হয়ে। নিজের টাকায় ডজনে ডজনে বাস ভাড়া করেছেন তিনি, মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে রোড পারমিট বের করেছেন, তারপর নিজে হাজির থেকে অসহায় এই মানুষগুলোকে তুলে দিয়েছেন বাসে, সঙ্গে দিয়েছেন প্যাকেট করা খাবার, পানির বোতল। সনুর ভাড়া করা এসব গাড়ি মুম্বাই থেকে ছুটে গেছে চেন্নাই, কেরালা, ব্যাঙ্গালোর, বিহার, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান আর পাঞ্জাবের উদ্দেশ্যে। কোটি কোটি টাকা বাস ভাড়া গুণেছেন সনু, চেন সাইন করার আগে একবারও ভাবেননি, শুধু মাথায় ছিল, যা করছেন, তার বিনিময়ে মানুষের দোয়া আর ভালোবাসা পাবেন। 

শুধু তো এখানেই শেষ নয় সনুর কাজ। করোনাকালে ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র হিসেবে যারা কাজ করছেন, সেই ডাক্তার আর পুলিশদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সনু। পুলিশ সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছেন মাস্ক এবং ফেস শিল্ড, ডাক্তারদের বিশ্রামের জন্য খুলে দিয়েছেন নিজের বিলাসবহুল হোটেল। টুইটারে এক ছেলে সনুকে ট্যাগ করে লিখেছে, অনেকদিন মাকে দেখে না, লকডাউনের কারণে বাড়ি যেতে পারছে না সে, সনু কি তাকে সাহায্য করবেন? সনু তাকে রিপ্লাই দিয়েছেন, 'মাকে বলে দাও, এবারের ঈদ তুমি মায়ের সাথে করছো!' প্লেনের টিকেট কেটে সেই ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন সনু। যেখানে যার বিপদের কথা শুনেছেন, ছুটে গেছেন সবার আগে, পাশে দাঁড়িয়েছেন সাধ্যমতো। নিজে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন, তাই জানেন অসহায়ত্বের কষ্টটা।

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করা সনুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভারতের পাঞ্জাবে। পড়ালেখায় ভালোই ছিলেন। কিন্ত গ্র‍্যাজুয়েশন করতে করতেই অভিনয়ের ভূত চাপলো মাথায়। বাসায় বললেন, এক-দেড় বছর তাকে সময় দিতে, তিনি মুম্বাই গিয়ে অভিনেতা হতে চান। যদি এই সময়ের মধ্যে কিছু করতে না পারেন, তাহলে ফিরে এসে চাকরি করবেন, নইলে বাবার ব্যবসা সামলাবেন। ব্যবসায়ী বাবা আর কলেজ শিক্ষিকা মা ছেলের চাহিদাকে গুরুত্ব দিলেন, সনু গেলেন মুম্বাই। 

অদ্ভুত একটা দুনিয়া, সবাই এখানে ব্যস্ত, কারো দিকে ফিরে তাকানোরও সময় নেই কারো। সাড়ে চার হাজার রূপি বেতনে একটা চাকরি করতেন, নিজের খরচ চালানোর জন্য। পোর্টফলিও নিয়ে আজ এর কাছে, কাল তার কাছে যান সনু- কিন্ত কাজ হয় না কোনো। প্রতিদিনই রিজেকশন জোটে কপালে। সনুর তখন মাথায় হাত, এক-দেড় বছর তো মুম্বাই শহরটা চিনতেই কেটে যাবে, কাজ করবেন কখন? এরইমধ্যে চেন্নাই থেকে ডাক এলো, এক কাস্টিং ডিরেক্টরের পছন্দ হয়েছে সনুকে, ছবি দেখেছেন তিনি, এখন সামনাসামনি দেখতে চান। ট্রেন পাকড়ে সনু ছুটে গেলেন চেন্নাই। ব্যাটে বলে হয়ে গেল, তামিল সিনেমায় ভিলেন হিসেবে অভিষেক হলো সনুর।

সনুর ভাড়া করা বাস ছুটে গেছে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে

এরপরে তেলুগু, কন্নড়, ইত্যাদি ভাষার সিনেমায় কাজ করেছেন, দক্ষিণী দর্শকেরা তাকে গ্রহণ করেছে দারুণভাবেই। মুম্বাই থেকেও ডাক এলো, সিনেমার নাম দ্য লিজেন্ড অফ ভগত সিং। অজয় দেবগনের সেই সিনেমা দিয়েই হিন্দি সিনেমা জগতে অভিষেক হলো সনুর। শুরু থেকেই স্ট্রাগল তার জীবনের সঙ্গী, অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোন গডফাদারের সাহায্য ছাড়া একা, একদম একা নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, আউটসাইডার হয়েও পেয়েছেন দারুণ জনপ্রিয়তা- এটা কম কিছু নয়। 

অভিনেতা সনু সুদ ভালো, কিন্ত মানুষ সনু সুদের কোন তুলনা হয় না। মায়ার ভাণ্ডার উজাড় করে তিনি অসহায় মানুষের উপকার করেছেন, বিনিময়ে মানুষও তাকে ভালোবেসেছে অকাতরে। লোকজন নিজের নবজাতক বাচ্চার নাম রাখছে সনুর নামে, এতটা ভালোবাসা পেয়ে সনু নিজেও আপ্লুত। অভিনয় তার প্যাশন, পেশাও, কিন্ত মানুষের জন্য কাজ করাটা তার কাছে নেশায় পরিণত হয়েছে এখন। এটা অক্সিজেনের মতো, যে কাজটা না করে সনু বাঁচতে পারবেন না। সনু বলেন, মানুষের উপকার করার জন্যেই বোধহয় আমার জন্ম হয়েছে! 

সব ভালো কাজেই বাম হাত ঢোকানোর মতো কিছু লোক থাকে, ভালো কিছু ঘটলেও সেখানে তারা সন্দেহ পোষণ করেন। সনুকেও এসব লোকজন রেয়াত দেয়নি, তাদের ভাষায়, সনু সামনে পলিটিক্সে আসবেন, এজন্যেই এসব কাজ করে জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছেন। সনুর কথা পরিস্কার- "মানুষের জন্য কাজ করতে হলে পলিটিক্সে আসতে হয় না। আমি প্রায় দেড়শো কোটি রূপি সম্পত্তির মালিক, আপনাদের কি মনে হয়, আরও টাকা চাই আমার? কি করব আমি এত টাকা দিয়ে? মরে গেলে এসব টাকা কাজে আসবে না আমার, কাজে আসবে আপনাদের ভালোবাসাটা। ধরে নিন আমি টাকা দিয়ে সেই ভালোবাসা আর দোয়াই কিনতে চাইছি। ভগবান হয়তো আমাকে এই কাজের জন্যেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।"

তবে দু-চারজন নিন্দুকের এসব কথা ছাপিয়ে ভারতের আপামর মানুষের কাছে সনু এখন সুপারম্যান, বিপদে পড়া মানুষকে যিনি নিজের জাদুমন্ত্রবলে রক্ষা করছেন বারবার, করে যাবেন মৃত্যু অব্দি...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা