“আজ অভিনয়টা ছেড়ে দিলে কাল বাদে পরশুই হয়তো আমি মরে যাবো। মাছ যেমন পানি ছাড়া থাকতে পারে না, আমিও তেমনি অভিনয় ছাড়া বাঁচতে পারবো না।বেঁচে থাকার জন্যে একটা কারণ লাগে বোধহয়। আমার বেঁচে থাকার কারণটা অভিনয়..."

বছর সাতেক আগের কথা, কলকাতার এবিপি আনন্দ চ্যানেলে একটা সাক্ষাৎকার দিতে এসেছিলেন সৌমিত্র‍্য চট্টোপাধ্যায়। সেখানেই নানা কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন তার মৃত্যুচিন্তা আর মৃত্যুভয়ের কথা। তার বয়স তখন সাতাত্তর, সমবয়েসী সঙ্গী-সাথীরা অনেকেই ততদিনে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সেই ব্যাপারটাই হয়তো খানিকটা ভয় বা দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছিল মানুষটার ভেতরে। তবে সেটা চলে যাওয়ার ভয় নয়, কিংবা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে, সেরকম কোন শঙ্কা নয়। তার ভয়টা ছিল অন্য জায়গায়।

একটা সময়ের পর তিনি আর অভিনয় করতে পারবেন না, মঞ্চে দাঁড়াতে পারবেন না, ক্যামেরার সামনে ডায়লগ দিতে পারবেন না, এই ভয়টাই গ্রাস করছিল তাকে। টিভিতে সেই সাক্ষাৎকারটা প্রচারিত হবার পরে অজস্র চিঠি এসেছে এবিপি আনন্দের অফিসে, টেলিফোনে সৌমিত্র‍্যের বাড়ির নম্বর চাওয়া হয়েছে, অসংখ্য মেইলের রিপ্লাই দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সেসব টেলিফোন, চিঠি আর ইমেইলের একটাই ভাষ্য ছিল- আমাদের কাছে সৌমিত্র‍্য চট্টোপাধ্যায় হচ্ছেন তারুণ্যের প্রতীক। আশি ছুঁইছুঁই এই মানুষটাকে দেখে আমরা নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পাই, তার কথা শুনে নিজেদের কাজের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করে। তার মুখ থেকে কোন রকমের মৃত্যুচেতনা বা মৃত্যুভয়ের কথা আমরা শুনতে রাজী নই।

একটা মানুষ পঁচাশি বছর বয়সেও চুটিয়ে কাজ করে চলেছেন, ক্যামেরার সামনে তো বটেই, মঞ্চেও তিনি সরব। যাত্রার দল নিয়ে ছুটছেন জেলায় জেলায়। তরুণ অভিনেতারা যখন শিডিউল দিয়ে সেটা ঠিকঠাক রাখতে পারেন না, সেই সময়টায় এত ব্যস্ততা সামলে ঠিকই সিনেমার সেটে সবার আগে হাজির হয়ে যান সৌমিত্র‍্য।

পঁচাশি বছর বয়সেও তিনি চুটিয়ে কাজ করে চলেছেন

কী এমন আছে তার মধ্যে, যেটা এই পঁচাশি বছর বয়সেও তাকে এমন প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ করে রেখেছে? কোন শক্তির বলে 'বেলাশেষে'র প্রহরে দাঁড়িয়ে তিনি দর্শককে 'বেলাশুরু'র গল্প শোনান? চলুন, সেই গল্প শোনা যাক সৌমিত্র‍্য চট্টোপাধ্যায়ের মুখেই।  

"মৃত্যুকে আসলে আমি ভয় পাই না। আমি যেটাকে ভয় পাই, সেটা হচ্ছে বার্ধক্য। যেটা আমাকে দুর্বল করে দেবে, আমাকে শারিরীকভাবে অক্ষম করে দেবে। আমি বেঁচে থাকবো অথচ মঞ্চে দাঁড়াতে পারবো না, আমার বোধশক্তি থাকবে অথচ আমি অভিনয় করতে পারবো না, এই জিনিসটা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না, বোধহয় পারবোও না কখনও। অথচ এটা কিন্ত নিয়তি, আপনাকে এটা বরণ করে নিতেই হবে। এখনও আমি মঞ্চে কাজ করি, কিন্ত হয়তো বিশেষ কোন দৃশ্যে, যেখানে হয়তো আমাকে একটু পা ছড়িয়ে নাচতে হবে, সেখানে এসে আমি হাঁপিয়ে যাই। শরীর তো আর নিতে পারে না।" 

"সেই হাঁপিয়ে যাওয়াটা হয়তো খুব বড় কিছু নয়। কিন্ত পরের সিকোয়েন্সে যে ডায়লগগুলো, সেখানে যে আমার পারফরম্যান্সটা মান অনুযায়ী হচ্ছে না সেটা আমি বুঝতে পারি। এত বছর ধরে অভিনয় করছি, আমার স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে তো আমি জানি কিছুটা। আমি জানি এরচেয়ে ভালোভাবে এই ডায়লগগুলো আমি দিতে পারি। কিন্ত শারিরীক দুর্বলতার কারণে সেটা যখন সম্ভব হয় না, তখন খুব হতাশ লাগে জানেন।"  

তাঁর কাছে অভিনয়টা প্রচন্ড ভালো লাগার জায়গা

"কয়েক বছর আগে আমার একটা স্ট্রোক হলো। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, বাড়ির সবাই তো ভেবেছিল এক পা শ্মশানে দিয়ে রেখেছি বুঝি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেই নতুন সিনেমার কথাবার্তা শুরু করলাম। বাড়ির সবাই রেগেমেগে অস্থির। কেন আমাকে এত কাজ করতে হবে, টাকা-পয়সা তো জীবনে কম কামাই নি, তবুও কেন এত পরিশ্রম করছি, এখন একটু বিশ্রাম কেন নিচ্ছি না, আরও কত কথা! আমি সবাইকে ডেকে বললাম, তোমরা যেমন বেঁচে থাকার জন্যে তিনবেলা খাবার খাও, আমিও তেমনই বেঁচে থাকার জন্যেই অভিনয় করি। সেটার সাথে টাকাপয়সার কোন সম্পর্ক নেই, এটা প্রচণ্ড ভালোবাসার একটা জায়গা।"  

"আজ অভিনয়টা ছেড়ে দিলে কাল বাদে পরশুই হয়তো আমি মরে যাবো। মাছ যেমন পানি ছাড়া থাকতে পারে না, আমিও তেমনি অভিনয় ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আমি এটা বিশ্বাস করি। এই যে আমি তিরাশিটা বছর বেঁচে আছি, কাজ করছি, মোটামুটি সুস্থ শরীর নিয়ে ছুটতে পারছি, সবটাই অভিনয়ের জন্যে। বেঁচে থাকার জন্যে একটা কারন লাগে বোধহয়। আমার বেঁচে থাকার কারনটা অভিনয়। আমার শুধু মনে হয় এখনও কত কিছু করা হলো না, কত এক্সপেরিমেন্ট বাকী রয়ে গেল! এজন্যেই আমি কিং লিয়র সেজে মঞ্চে দাঁড়াই, যাত্রার দল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে বেড়াই।"   

"অভিনয়ের এই ক্ষিধেটার জন্যেই আমার হিন্দি সিনেমা করা হলো না। বলিউডের প্রস্তাব তো অনেকবার এসেছিল আমার কাছে। দিলীপ কুমার তার ছোটভাইকে পাঠিয়েছিলেন আমার বাড়িতে, অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে। রাজ কাপুর তার সিনেমায় অভিনয়ের অনুরোধ করেছিলেন ফোন করে। কিন্ত আমার শুধু মনে হতো, সেখানে যে চরিত্রগুলো আমাকে দেয়া হবে, সেগুলোতে করে দেখানোর মতো বিশেষ কিছু নেই। সেখানে আমি কাজ করার স্বাধীনতাটা পাবো না, অভিনয়ের আনন্দটা সেখানে থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা, আমি আমার মাতৃভাষায় কথা বলতে পারবো না, অভিনয় করতে পারবো না।" 

"জীবনের এই জার্নিটা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। হ্যাঁ, কিছু অতৃপ্তি তো থাকবেই। তবুও পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, ষাটটা বছর ধরে এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি, কাজ করেছি, দর্শক ভালোবেসেছেন, এটা কিন্ত বিশাল পাওয়া। আর সবচেয়ে বড় পাওয়া কি জানেন? এই যে তিরাশি বছর বয়েসী আমাকে প্রাধান্য দিয়ে এখনও চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে, সিনেমার গল্পে মূল বিষয়বস্তু আমি- এটা আমাকে খুবই তৃপ্তি দেয়। ভালো কাজ করেছি কি মন্দ করেছি সেটা লোকে বলবে, কিন্ত নিশ্চয়ই সেই আস্থার জায়গাটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি আমি। নইলে তো এই বয়সে এমন সুযোগটা মিলতো না। এই তৃপ্তিটা সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেও আক্ষেপ থাকবে না।"

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা