যে মানুষটা ক্যান্সারকে হারিয়ে এসেছেন, তিনি ক্ষুদ্র একটা ভাইরাসের কাছে হার মানতে পারেন না। বেলাশেষের গল্প যিনি শুনিয়েছেন, বেলাশুরুর গল্পটা না বলে তিনি কোত্থাও যেতে পারেন না। আপনাকে আমরা বিদায় বলছি না সৌমিত্রবাবু...

দু হাজার বারো সালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এবিপি আনন্দ চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে আপনি জানিয়েছিলেন আপনার মৃত্যুচিন্তার কথা। সমসাময়িকদের সবাই পাড়ি জমিয়েছেন অন্য ভূবনে। যাদের সঙ্গে আপনি কাজ করতেন, আড্ডা মারতেন, তাদের কেউই নেই বলতে গেলে, টিকে আছেন আপনি, মুগ্ধ করে চলেছেন অভিনয়ের মোহনীয় যাদুতে। এই বয়সের একটা মানুষের মনে মৃত্যু নিয়ে ভাবনা আসাটাই স্বাভাবিক। 

সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর এবিপি আনন্দের পোস্টবক্সটা যেন ঘূর্ণিঝড় দেখে ফেললো। শত শত চিঠি এসে হাজির হলো চ্যানেলের অফিসে, ফোন করে লোকজন বললো, "সৌমিত্র‍্যবাবুকে বলুন, উনি যেন মৃত্যু নিয়ে আর কোনদিন কথাবার্তা না বলে। আমাদের কাছে সৌমিত্র‍্য চট্টোপাধ্যায় হচ্ছেন তারুণ্যের প্রতীক। আশি ছুঁইছুঁই এই মানুষটাকে দেখে আমরা নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পাই, তার কথা শুনে নিজেদের কাজের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করে। তার মুখ থেকে কোন রকমের মৃত্যুচিন্তা বা মৃত্যুভয়ের কথা আমরা শুনতে রাজী নই।"

আপনাকে যখন সেই চিঠি আর টেলিফোনগুলোর কথা বলা হলো, আপনি মৃদু হাসলেন। দর্শকের এই ভালোবাসা, এই শ্রদ্ধা, এসব তো গত ছয় দশক ধরেই আপনার সঙ্গী। অভিনয়টা আপনার কাছে ধ্যানজ্ঞান, বেঁচে থাকার অক্সিজেন। কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালের আইটিইউতে শুয়ে সেই অক্সিজেনটাকে কি এখন মিস করছেন আপনি? সাংবাদিকেরা ঘন্টায় ঘন্টায় জানতে চাইছেন আপডেট, ডাক্তাররা বলছেন, প্লাজমা দেয়া হয়েছে, ভেন্টিলেশন লাগতে পারে, অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে; অজস্র মানুষ প্রার্থনা করছে আপনার সেরে ওঠার জন্য, এই পোড়া বছরটাতে আর কোন দুঃসংবাদ যাতে শুনতে না হয়। আপনি সেসব টের পাচ্ছেন? 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: যখন যুবক ছিলেন

হাসপাতালে ভর্তির কারন ছিল করোনার সংক্রমণ। আপনার জীবনী নিয়ে ডকুমেন্টরি তৈরির কাজ চলছিল, সেটাই যে জীবন সংশয়ের কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে, ভেবেছিলেন কখনও? অন্যান্য অসুস্থতা, কো-মর্বিডিটি আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা- ৮৬ বছর বয়স; সব মিলিয়ে ভাইরাসের সামনে আপনি এখন সহজ এক প্রতিপক্ষ, আপনাকে কাবু করে ফেলেছে সে। ডাক্তাররা প্রাণপণ লড়ছেন, তবু আশার কথা শোনাতে পারছেন না কিছুই। বেলাশেষের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বেলাশুরুর গল্পটা না শুনিয়েই আপনি চলে যাবেন এভাবে? 

আপনি ছিলেন সত্যজিতের আবিস্কার, বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে মেধাবী মানুষটা খুঁজে বের করেছিলেন আপনাকে, তার প্রিয় অভিনেতাও ছিলেন আপনিই। নিয়ে সত্যজিৎ রায় বানিয়েছেন চৌদ্দটি সিনেমা! অন্য কোন অভিনেতা এর অর্ধেক সিনেমা করার সুযোগও পাননি সত্যজিতের সঙ্গে। সত্যজিতের সিনেমায় আপনি অপু হয়েছেন, অমল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, ফেলুদা হয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের এই দুনিয়াটাকে ভালোবেসে ফেলেছেন আপনি। এটাই আপনার ঘরবাড়ি, সংসার- সবকিছু। 

অভিনয় ছাড়া আপনি এক মুহূর্ত থাকতে পারতেন না, তাই তো এত বড় তারকা হয়েও যাত্রার দল নিয়ে আপনি ছুটে বেড়িয়েছেন গোটা পশ্চিমবঙ্গে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকের চোখের সামনে লাইভ অ্যাক্টিং করার চ্যালেঞ্জটা আশি বছর বয়সেও নির্দ্বিধায় নিয়েছেন আপনি। মঞ্চে আপনি কিং লিয়র হয়েছেন, গা শিউরে ওঠা পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন প্রতিবার। একেকটা সংলাপের পর চেয়ারে বসা দর্শক যখন হাততালি দেয়, গুঞ্জন ওঠে দর্শকসারি থেকে, তখন আপনার রক্তে অ্যাড্রেনালিন রাশ জেগে উঠতো, বয়সটা যেন ত্রিশের কোঠায় নেমে আসতো খানিকটা সময়ের জন্য। সেই দিনগুলোতে আরেকবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না সমুবাবু?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

উত্তম কুমার তো এই নামেই ডাকতেন আপনাকে। জীবনে আপনি কি করেননি! পত্রিকা বের করেছেন, বামপন্থী আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন একটা সময়ে, নায়ক হয়ে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বা মিছিলে নেমে গেছেন মেহেনতি মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কফি হাউজে বসেছেন, আড্ডা দিয়েছেন সমানে, চায়ের কাপে ঝড় তুলেছেন। উত্তম এসব পছন্দ করতেন না, সিনিয়র হিসেবে তিনি বলতেন আপনাকে- 'সমু, যা করছিস সেগুলো কোন স্টারের কাজ না। নিজের ওজনটা ধরে রাখিস, গ্ল্যামারটাই নায়কের সবকিছু, এটা হারিয়ে ফেললে লোকে তোকে ভুলতে সময় নেবেন না।' উত্তম ভুল ছিলেন, লোকে আপনাক্র ভোলেনি, আপনি ভুলতে দেননি, আপনাকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়। 

আপনার জীবনটাকে ধারণ করতে গেলে ডজনখানেক সিনেমা হয়ে যাবে, দুয়েকটা শাহনামাও লেখা হয়ে যাবে। অত ধৈর্য্য এই সময়ে কার আছে বলুন? আমাদের আপনি অনেক দিয়েছেন, আরেকবার প্রত্যাশার দাবী নিয়ে দাঁড়াচ্ছি। হাসপাতালের ওই শ্বেতশুভ্র বেডশিট থেকে উঠে এসে আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন আপনি, সেটাই আমাদের চাওয়া। যে মানুষটা ক্যান্সারকে হারিয়ে এসেছেন, তিনি ক্ষুদ্র একটা ভাইরাসের কাছে হার মানতে পারেন না। বেলাশেষের গল্প যিনি শুনিয়েছেন, বেলাশুরুর গল্পটা না বলে তিনি কোত্থাও যেতে পারেন না। আপনাকে আমরা বিদায় বলছি না সৌমিত্রবাবু...

ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা- ভট্টবাবুর পেজ

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা