সৌমিত্রের প্রস্থান: অপু-ফেলুদা-উদয়ন পন্ডিতকে একসঙ্গে হারানোর বিষাদ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একজন মানুষ চলে যাওয়ার আক্ষেপ হয়তো কাটানো যায়। কিন্তু অপু, ফেলুদা, উদয়ন পণ্ডিত একসাথে চলে যাওয়ার আক্ষেপ কীভাবে কাটাবো?
আমাদের বাসায় যেদিন প্রথম ভিসিডি প্লেয়ার আসে, সেদিন ভিসিডি প্লেয়ারের সাথে একটা সিনেমার সিডিও আসে; সত্যজিৎ এর 'হীরক রাজার দেশে।' সিডির ডিস্ক দুইটা। উত্তেজনায় দ্বিতীয় ডিস্ক আগে দেখে ফেলেছিলাম। অর্থাৎ সিনেমার দ্বিতীয় অংশ আগে দেখে, প্রথম অংশ পরে দেখতে হয়েছিলো। 'উদয়ন পন্ডিত' এর সাথে সেদিনই প্রথম পরিচয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে সেই সেদিনই চেনা। তখন বয়স কম। অতটা ভালো চিনিনি। একজন শিক্ষক বাস্তুহারা হয়ে এক অলীক আদর্শের পেছনে ছুটে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। এটাই দেখলাম। এটুকুই বুঝলাম। বাকিটুকু বুঝলাম না।
এরপর এক যুগ পেরোলো। আমি আরেকটু বড় হলাম। তারান্তিনো, কিয়েরোস্তামি, রিচি, টেরান্স, নোলান, ঋত্বিক, কৌশিক এর সিনেমা দেখে দেখে নিজেকে একটু একটু সিনেমাবোদ্ধাও ভাবা শুরু করেছি। হুট করেই সেদিন 'অপুর সংসার' দেখতে ইচ্ছে ছিলো। আমি এতদিনে সিনেমা দেখে দেখে 'সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়' নামের মহীরূহকেও চিনে ফেলেছি। 'অপুর সংসার' আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু এবার যেন অভিনয়টা ধ্বক করে বুকে লাগলো। বিভ্রান্ত 'অপু'র দিকভ্রান্ত চাহনী, স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদে খসে যাওয়া শুকনো পাতার মতন ফ্যাকাশে মুখ, প্রথমবারের মত ছেলেকে দেখে মুখচোখ একসাথে নেচে ওঠা... এগুলো আমি দেখিনি আগে। আমি আর কোথাও দেখিনি এই সর্বগ্রাসী বিষাদ। সেদিনই প্রথম দেখলাম। এতদিন হয়তো সৌমিত্রকে দেখেছি পর্দায়। ওদিনই প্রথমে অপুকে দেখলাম।
সৌমিত্রের চমক তো এখানেই। তিনি পর্দায় 'তিনি' হয়ে থাকেন না। তিনি হয়ে যান অপু, হয়ে যান ফেলুদা, হয়ে যান অন্য কেউ। আমি 'সোনার কেল্লা' 'জয় বাবা ফেলুনাথ' কতবার দেখেছি, গুনে বলতে পারবো না। অজস্রবার দেখেছি। মগনলাল মেঘরাজকে পাকড়াও করে ফেলুদার সেই ভ্রুকুটি, রাজস্থানের জয়সলমীর এ যাওয়ার সময়ে শীতের জমাট স্টেশনে বসে ফেলু-তোপসের কথাবার্তা, ফেলুদার গলার উৎকন্ঠা... এখনো কানে বাজে। সিনেমা দেখতে দেখতে আমি হয়তো ভুলেই গিয়েছি যে আমি সিনেমা দেখছি। ভুলেই গিয়েছি, রজনী সেন রোডে 'ফেলুদা' নামে কেউ থাকেই না। ভুলেই গিয়েছি সবকিছু। ভুলেই গিয়েছি। ইনি সৌমিত্র। ইনি ফেলুদা নন।
সৌমিত্রকে নিয়ে এককালে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। জানতাম, উত্তমকুমারের সাথে তার দ্বৈরথের কথাও। দুজনে চুটিয়ে দুদিক সামলেছেন। একজন হয়তো কর্মাশিয়াল সিনেমার উত্তমকুমার, আরেকজন আর্টফিল্মের সৌমিত্র। দুজনের মধ্যে দ্বৈরথ থাকলেও কেউ কাউকে অপমান করেননি কোনোদিন। সুস্থ প্রতিযোগিতায় লড়ে গেছেন যতদিন পেরেছেন। মানুষ কী শুধু পর্দাতেই নায়ক হয়! পর্দার বাইরেও তো হয়।
প্রসেনজিৎ এর আত্মজীবনী 'বুম্বা, শট রেডি'র এর এক বিশাল অংশজুড়ে এই মানুষটির অস্তিত্ব। একবাক্যে এই মানুষটির বিশালতা স্বীকারও করেছেন প্রসেনজিৎ। 'আমি সৌমিত্র-জেঠুকে ভগবানের চোখে দেখি।' অকপট স্বীকারোক্তি তার। মানুষটি তো এরকমই ছিলেন। 'প্রাক্তন' এর ট্রেনের কামরায় সেই কবিতা, 'বেলাশেষে'র সেই জীবনযুদ্ধে বিরক্ত বৃদ্ধ, 'ময়ূরাক্ষী'র সব ভুলে বসা বাবা, 'পোস্ত' সিনেমার সেই দাদু... সৌমিত্রকে নিয়ে যতটুকুই যা বলি, কেন যেন কম বলাই হয়ে যায়।
সেদিন দেখছিলাম ইরখান খানের 'কারিব কারিব সিঙ্গেল' সিনেমা। আর আফসোস হচ্ছিলো, সিনেমার এই 'যোগী' নামের মানুষটা আর কোনো সিনেমায় আসবেন না। আর ঢুলুঢুলু চোখের ডায়লগগুলো শুনবো না। স্বজনহারানোর অনুভূতি হয়েছিলো। প্রিয়জন হারালে খারাপ লাগে কেন? মানুষটি নেই বলে? নাকি, মানুষটির সাথে সাথে সেই অভ্যাস, মুহুর্ত আর স্মৃতিগুলো মুছে যায় বলে? জানা নেই।
হয়তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো আগের মতন অভিনয়ও করছিলেন না। আমার সাথে কোনোদিন দেখাও হয়নি। হয়তো আরো বিশ-ত্রিশ বছর বেঁচে থাকলেও দেখা হতো না। কিন্তু, এটা জানতাম, পৃথিবীর এক প্রান্তে, মানচিত্রের ওপাশেই তিনি বেঁচে আছেন। সেটাই স্বস্তির। এই অনুভূতিটা হয়। হুমায়ুন আহমেদ মারা যাওয়ায় আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি, বইমেলায় হুমায়ুন আহমেদের আর কোনো বই আসবে না- এটা ভেবে। আর কোনো হিমু, মিসির আলী রইলো না.. এটা ভেবে। সৌমিত্র ঠিক সেই বেদনাতেই কষ্ট দিয়ে গেলেন।
একজন মানুষ চলে যাওয়ার আক্ষেপ হয়তো কাটানো যায়। কিন্তু অপু, ফেলুদা, উদয়ন পণ্ডিত একসাথে চলে যাওয়ার আক্ষেপ কীভাবে কাটাবো?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন