সত্যজিতের সিনেমায় তিনি যতটা সাবলীল, ঠিক ততটাই ছিলেন শিবু-নন্দিতার সিনেমাতেও। বয়স ঘড়ির পঁচিশের কাঁটায় ফিল্মি পাড়ায় পা রাখা চঞ্চল সৌমিত্রের মধ্যে নতুন কিছু শেখার যে বাসনাটা ছিল, শিখতে চাওয়ার, নতুন কিছু করত চাওয়ার সেই তীব্র চাহিদাটা বজায় ছিল পঁচাশি বছর বয়সে এসেও...

বিসর্জন তার বড্ড অপছন্দের ছিল, বিদায় ব্যাপারটা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, বিসর্জনের সেই অন্ধকারের একচিলতে নাকি লুকিয়ে আছে তার ভেতরেও। এজন্যে নিজের কাছ থেকেই কখনও কখনও পালিয়ে বাঁচতে চাইতেন, খুঁজতেন মুক্তির পথ। সেই মুক্তি মিলে গেল আজ। বেলভিউ হাসপাতালে চল্লিশ দিনের লড়াইটা শেষ হলো, গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো একটু বিরাম নেয়ার সুযোগ পাবে এখন। 

সৌমিত্র‍্য চট্টোপাধ্যায় নামের যে মানুষটার দৈহিক মৃত্যু হলো ঘন্টা দেড়েক আগে, খানিক বাদে গলফ গ্রীনের বাসভবন হয়ে রবীন্দ্র সদনে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে কেওড়াতলা মহাশশ্মানে যে শরীরটা ধুলোয় মিলিয়ে যাবে- তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসগুলোর একটি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বহু আগেই। যুগের হাওয়া বদলেছে, টালিগঞ্জ বদলেছে, বদলেছে সিনেমার ধরন, দর্শকের চাহিদা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে, সেই পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই টিকে ছিলেন, দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছেন দর্শকের হৃদয়ে। তিনি অপু হয়েছেন, ফেলুদা হয়েছেন, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের এই দুনিয়াটাকে ভালোবেসে এই জগতটাকেই ঘরবাড়ি-সংসার বানিয়ে ফেলা মানুষটা সবকিছু ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্ত ভূবনে, যেখানে তার জন্যে প্রিয় উত্তমদা অপেক্ষা করে আছেন চার দশক ধরে। 

তিনি উত্তম কুমারের মতো চার্মিং এক্টর ছিলেন না। ড্যাশিং লুক ছিল না তার, তরুণীদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো হ্যান্ডসাম হাংক হিসেবেও কোন সিনেমায় আবির্ভূত হননি তিনি। তবু তার মধ্যে কিছু একটা ছিল, যেটা আর কারো মধ্যে ছিল না। হয়তো সেটার নাম সিমপ্লিসিটি, সাধারণের মধ্যেই অসাধারণত্বের বসবাস। নইলে সত্যজিত রায়ের মতো পরিচালক কেন নিজের ক্যারিয়ারের ৩৪টা সিনেমার মধ্যে চৌদ্দটাতেই নায়ক হিসেবে তাকে বেছে নেবেন? কেন সবার সামনে পছন্দের অভিনেতা হিসেবে তাকেই পরিচয় করিয়ে দেবেন? যে ছেলেটাকে সত্যজিতই একবার 'বয়সটা বেশি লাগছে হে' অজুহাতে রিজেক্ট করেছিলেন, সেই সত্যজিতের সঙ্গেই কেন সৌমিত্রের এমন দশাসই জুটি হবে? কেন সৌমিত্রকে মাথায় রেখেই ফেলুদার ক্যারিকেচার আঁকবেন মানিকবাবু? এ কি কেবলই কাকতাল, নাকি অদৃষ্টের লিখন? 

ঐশ্বরিক প্রতিভা তার ছিল না, ছিল চেষ্টা, ছিল অধ্যবসায়, ছিল নাছোড়বান্দা জেদ, ভালো করার, পরিচালকের মন জয় করার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। সেটাই হয়তো টিকিয়ে রেখেছিল তাকে। সময়ের পটপরিবর্তন তার ওপর কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি, তিনি টিকে ছিলেন সদর্পে, স্বমর্যাদায়। সত্যজিতের সিনেমায় তিনি যতটা সাবলীল, ঠিক ততটাই ছিলেন শিবু-নন্দিতার সিনেমাতেও। বয়স ঘড়ির পঁচিশের কাঁটায় ফিল্মি পাড়ায় পা রাখা চঞ্চল সৌমিত্রের মধ্যে নতুন কিছু শেখার যে বাসনাটা ছিল, শিখতে চাওয়ার, নতুন কিছু করত চাওয়ার সেই তীব্র চাহিদাটা বজায় ছিল পঁচাশি বছর বয়সে এসেও। 

এই অমলিন হাসির দেখা মিলবে না আর

ওপাড় বাংলায় সবচেয়ে সম্মানিত তারকা ছিলেন তিনি, অর্জন আর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তবু কখনও এতটুকু অহঙ্কার দেখেনি কেউ তার মধ্যে। বরং নিজের ভ্যানিটি ভ্যানটা জুনিয়র আর্টিস্টদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন, নিজে জ্যাম ঠেলে ট্যাক্সিতে চড়ে বাড়ি ফিরেছেন, ড্রাইভার সমেত গাড়িটা দিয়েছেন কোন সহকর্মীকে, হয়তো সেই সহকর্মীর কোথাও একটা নেমন্তন্ন আছে, স্ত্রীকে নিয়ে যেতে হবে, মুখ ফুটে বলতে পারছিলেন না, সৌমিত্র মনটা পড়ে ফেলেছেন ঠিকই। সেটে দারুণ মজা করতেন, সবাইকে হাসাতেন। অপর্ণা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন একসময়, পরে অপর্ণা যখন অভিনয় ছেড়ে পরিচালনায় নিয়মিত হলেন, তখন দেখা হলেই তিনি অপর্ণাকে খোঁচাতেন- 'আমাকে তো তুমি সিনেমায় নেবে না, আমরা কি আর অভিনয় টভিনয় পারি!' 

নিজেকে কখনও একটা ফ্রেমে বা একটা নির্দিষ্ট ঘরাণায় বেঁধে রাখেননি, কখনও চাননি লোকে তাকে শুধু রোমান্টিক হিরো হিসেবে জানুক, কিংবা ফেলুদার পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যাক তার নামটা। ষাট কিংবা সত্তরের দশকে উত্তম কুমারের দাপটের ভীড়ে তিনি একটুও ফিকে হয়ে যাননি, কারণ তিনি নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, নিজের সামর্থ্যকে বারবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, ঝিন্দের বন্দীর সেই ভিলে রোলটার কথাই কল্পনা করুন না! আর একারণেই ছয়টা দশক ধরে দর্শক তাকে ভালোবেসেছেন, হৃদয়ে জায়গা দিয়েছেন।

তুমুল তারকাখ্যাতি থাকার সময়টাতেই তিনি মঞ্চে অভিনয় করেছেন, আশি বছর বয়সেও যাত্রায় অভিনয় করার জন্য ছুটেছেন গ্রামেগঞ্জে। টাকার জন্যে নয়, দর্শকের লাইভ এক্সপ্রেশনটা দেখার জন্য। তার অভিনয় দেখে সামনাসামনি দর্শক কি প্রতিক্রিয়া জানায়, সেটা উপভোগ করার জন্যে। এই ফিডব্যাকটা নেশার মতো কাজ করতো তার মধ্যে। ফিল্ম তো সৌমিত্রের সেরাটা দেখেছেই, তবে কলকাতার থিয়েটারে তার কিং লিয়র যারা দেখেছেন, তারা জানেন সৌমিত্র কী জিনিস। রাজা লিয়রের চরিত্রের সৌমিত্রকে একবার যে দেখেছে, সে না ভুলতে পারবে লিয়রকে, না ভুলবে সৌমিত্রকে। এমনই জাদুকরী মোহাবিষ্ট ছিল সেই অভিনয়! আবৃত্তিটাকেও ছাড়েননি তিনি, রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে অ্যালবাম বেরিয়েছে তার, 'প্রাক্তন' সিনেমায় তার কণ্ঠে 'হঠাৎ দেখা' কবিতাটার আবৃত্তি শুনে বুক কেঁপে ওঠেনি, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না বোধহয়।

অভিনয়টা তার কাছে ছিল অক্সিজেনের মতো, তিনি বলতেন, অভিনয় ছাড়া তিনি বাঁচতে পারবেন না। সত্যিই পারলেন না, করোনার লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকায় হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, জোর করেই বের হয়েছিলেন নিজের জীবন নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টরি ফিল্মের কাজে সাহায্য করার জন্য। সেটাই কাল হলো, শরীরে জায়গা করে নিলো ঘাতক করোনাভাইরাস। অন্যান্য অসুস্থতা, কো-মর্বিডিটি আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা- ৮৬ বছর বয়স; সব মিলিয়ে ভাইরাসের সামনে জুবুথুবু হয়ে গেলেন মানুষটা। চল্লিশটা দিন তবু তিনি লড়ে গেলেন, বারবার আশার আলো দেখালেন, ডাক্তারেরাও চেষ্টার কমতি রাখলেন না। কিন্ত একটার পর একটা অর্গান ফেল করতে থাকলো, বিদ্রোহ করলো বুড়ো শরীর; শেষমেশ হারতে হলো তাকে, আজ দুপুর পৌনে একটায় থেমে গেল জীবনঘড়ির কাঁটা, চিরতরে। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়- যখন যুবক ছিলেন

যুবক বয়সে স্বদেশী করেছেন, পত্রিকা বের করেছেন, বামপন্থী আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন একটা সময়ে, নায়ক হয়েও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বা মিছিলে নেমে গেছেন মেহেনতি মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কফি হাউজে বসেছেন, আড্ডা দিয়েছেন সমানে, চায়ের কাপে ঝড় তুলেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল তার, উত্তম প্রায়ই নিষেধ করতেন তাকে এসব করতে, বলতেন- সমু, যা করছিস সেগুলো কোন স্টারের কাজ না। নিজের ওজনটা ধরে রাখিস, গ্ল্যামারটাই নায়কের সবকিছু, এটা হারিয়ে ফেললে লোকে তোকে ভুলতে সময় নেবেন না।' 

উত্তমদার কথা সৌমিত্র শুনতেন, বিরোধিতা করতেন না। তবে কাজের বেলায় নিজের মনের চাহিদাটাই প্রাধান্য পেয়েছে তার কাছে। উত্তম কুমার ভুল ছিলেন, লোকে সৌমিত্রকে ভুলে যায়নি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভোলাটা সম্ভব নয়। এই পঁচাশি বছর বয়সেও তার কলম চলেছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিষবাস্প যে ভারতকে গ্রাস করে নিচ্ছে, সেটা নিয়ে নিজের আপত্তি জানিয়ে খোলামেলা কলাম লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। 

ছয় দশকের যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটলো, দাড়ি পড়ে গেল বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অধ্যায়টায়। খানিক বাদে দেহটা মিশে যাবে মাটির সঙ্গে, ছাই হয়ে। রয়ে যাবে সৌমিত্রের কাজ, সেগুলোতেই অমর হয়ে থাকবেন তিনি চিরদিন। হেমন্তের হিম হিম মাঝরাতের বিষণ্ণতায় তার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বেজে উঠবে পটভূমিতে- 'আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনোদিনই...' 

সৌমিত্রবাবু, দু হাজার বিশ নামের এই স্টেশনটায় না থামলে কি হতো? যাত্রাটা আরেকটু দীর্ঘ কি করা যেতো না? দীপাবলির রোশনাইয়ের মাঝেই নিভে না গেলেও তো হতো, তাই না? এভাবে বিষাদের রেণু বাতাসে উড়িয়ে ভেসে আসা শঙখের সুরের মতো শেষবেলায় মিলিয়ে যাওয়াটা কি মেনে নেয়া যায়?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা