শিশুশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা মেয়েটা হয়েছিল ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী সুপারস্টার। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রেম, বিচ্ছেদ, বনী কাপুরের সঙ্গে বিয়ে, নায়িকা হিসেবে নিজেকে শীর্ষে তুলে আচমকা বিরতি নেয়া, দুর্দান্ত এক প্রত্যাবর্তন আর রহস্যময় মৃত্যু- শ্রীদেবীর জীবনটা কি সিনেমার স্ক্রিপ্টের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর?

আয়াঙ্গার কিছুটা ভয় নিয়ে পার্টিতে ঢুকলেন। এমন না যে তিনি খুব ভীতু মানুষ, বরং উল্টোটা। নামজাদা উকিল তিনি। তার সামনে আসলে বরং অনেকে ভয় পেয়ে যায়! তাহলে আজকে তার ভয় পাওয়ার হেতু কি?

কারণ হচ্ছে, যেখানে তিনি এসেছেন সেখানে তার আসার কথা ছিল না। তার রাজনীতি করা ভাইটি হুট করে অসুস্থ হয়ে যায় বাধ্য হয়ে নিজের ভাইয়ের প্রক্সি দিতে তাকে এই পলিটিকাল পার্টিতে আসতে হয়েছে।

“আব্বু, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?” নিজের চার বছরের মেয়ে পাপ্পির মুখে এই কথা শুনে তিনি কিছুটা চমকে উঠলেন! বাচ্চারা যেন কীভাবে সব টের পেয়ে যায়! আয়াঙ্গার দরের ছলে নিজের চার বছরের মেয়ের মাথায় তিনি হাত বুলিয়ে দিলেন। “আপনার মেয়েটা বেশ কিউট তো!” হুট করে একজন এই কথাটি বলে উঠল। আয়াঙ্গার বক্তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা থমকে গেলেন! এ যে তামিল লেখক মানদাসন! কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি লেখকের দিকে। কিন্তু লেখকের বলা এর পরের বাক্যটির জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না!

“আপনার মেয়েকে সিনেমাতে দিচ্ছেন না কেন? চাইল্ড আর্টিস্ট হিসেবে চমৎকার কাজ করতে পারবে সে! আমি মানুষকে দেখে বুঝতে পারি। আপনার মেয়ের মাঝে ব্যাপার আছে মশাই!”

অন্য কেউ এই কথা বললে হয়ত আয়াঙ্গার রেগে যেতেন, তবে নামই লেখকের সামনে তো আর হুট করে রেগে যাওয়া যায় না। কিছুটা হেসে, কিছুটা নিমরাজি হয়ে, “আচ্ছা, তাই নাকি? দেখা যাক!” বলে সেদিনকার মতো বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। আর লেখকের সেই বাক্যকে সেদিন রাতেই ঘুমানোর আগে ভুলে গেলেন।

তবে মানদাসন কিন্তু ভুলেননি সেই ছোট্ট পাপ্পিকে।পরেরদিন ঠিকই সাউথ ইন্ডিয়ার এক সিনেমার পরিচালককে নিয়ে তিনি হাজির হলে পাপ্পিদের বাসায়। আয়াঙ্গার তো তাকে দেখে হতভম্ব! মানদাসন যেন সেদিন পণ করে এসেছেন, এই মেয়েকে তিনি সিনেমাতে আনবেনই! আয়াঙ্গার আর তার স্ত্রী রাজেশ্বরী শুরুতে নিমরাজি হলেও, একসময় গিয়ে রাজি হতে বাধ্য হলেন। চার বছরের পাপ্পি সেদিন বুঝেনি, একদম নতুন এক রাজ্যে যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে যার যেখানে অনেকদিন চলবে তার রাজত্ব।

প্রথম সিনেমা কন্দন করুণাই এর সেটে মায়ের সাথেই গেল ছোট পাপ্পি। কিন্তু মায়ের আঁচল থেকে সে আর বেরই হয় না! নতুন জগত, নতুন মানুষ, সারাক্ষণ “লাইট, ক্যামেরা, একশন” এর আওয়াজ- অতশত কী আর বোঝে চার বছরের ছোট্ট মেয়েটা? কিন্তু মা ঠিকই বুঝে গেলেন নিজের সন্তানকে। বললেন “ভয় কি মা?” মায়ের এই একটি বাক্যই তার সমস্ত ভয় দূর করে দিল। সুন্দর করে একটার পর একটা শট দিয়ে গেলেন। কান্নার দৃশ্যে অন্য বাচ্চাদের যেখানে চিমটি দিয়ে এরপরে কাঁদাতে হতো, সেখানে ছোট পাপ্পিকে বললেই তিনি কেঁদে ফেলতে পারতেন! প্রথম সিনেমার জন্য তার চুল ফেলে দেয়ার কথা উঠেছিল, কিন্তু কিছুতেই চুল কাটবে না ছোট পাপ্পি। শেষমেশ ঘন কালো চুল নিয়েই নিজের রোলটা ঠিকঠাক প্লে করল সে।

নিজের কাজ যে মনোযোগ দিয়ে করে, কাজ তার কাছে আসতেই থাকে। পাপ্পির বেলাতেও সেটি ঘটছিল ক্রমশ। তামিল ছাড়াও, তেলগু, কন্নড়, মালায়ালাম ভাষার ছবিতে অভিনয় করছিল সে। পুমপাট্টা সিনেমার জন্য তো সেই ছোট্ট বয়সে কেরালার অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রামে বেস্ট চাইল্ড এক্টরের অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেল সে। বাবা মা কিছুটা ভয়ই পেয়ে যাচ্ছিলেন এত ছোট বয়সে মেয়ের এত সিনেমাতে জড়িয়ে পড়া দেখে। ভয়টা আরও বাড়ল যখন একদিন একটা রেস্টুরেন্টের লাইভ মিউজিক শোতে বাবা আয়াঙ্গার দেখলেন তার ছোট্ট মেয়েটা যখন যেন মিউজিকের তালে আপন মনে চোখ বন্ধ করে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। পাপ্পি নিজেও আসলে বুঝতে পারেনি এই মিউজিক কখন তার শরীরে এক দোলা দিয়ে গিয়েছে। যখন বুঝতে পারল, তখন চোখ খুলে দেখলে তার বাবা তার দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন;যে দৃষ্টিতে ছিল না কোন প্রশংসা, ছিল বিস্ময় আর অবিশ্বাস। যার কারণে সেদিন লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়েছিল পাপ্পি। বাসায় আসার পর বোনাস হিসেবে কপালে জুটল মায়ের বকুনি।মা ঠিক করলেন,সিনেমাতে আর কাজই করতে দিবেন না মেয়েকে। কেঁদেকেটে বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন বারবার পাপ্পি, শেষমেশ বাবাই বললেন- সিনেমাতে কাজ চলুক।

তবে সেদিন পাপ্পির বাবার সেই চাহনি যে অমুলক কিছু ছিল না, সেটার প্রমাণ পরেই পাওয়া গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে এত সিনেমাতে কাজের ভিড়ে পড়াশুনাটা আর ঠিকমতো হয়নি পাপ্পির। বাসায় টিচার রেখে চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু ফার্স্ট গ্রেডের পর আর এগোয়নি পড়াশুনা। এই জিনিসটা সারাটি জীবন পুড়িয়েছে তাকে, যেমনটা তিনি পুড়িয়েছেন হাজারো পুরুষের মন। পুরুষের মনে স্থায়ী আসন তৈরির আগে তার নাম ছিল শ্রী অম্মা আয়াঙ্গার! তবে এই নামে যে কখনও স্টার হতে পারবে না, সেটা বুঝতে হলে বড় কোন স্টার হতে হয়না। নিজের চাচার এক বন্ধু তার নাম দিলেন শ্রীদেবী। এরপর থেকে এই নামেই পরিচিত হলেন তিনি, হলেন হিন্দি সিনেমার প্রথম নারী সুপারস্টার। তিনিই প্রথম বলিউড এর কোন নায়িকা যিনি অমিতাভ বচ্চনকে না বলার সাহস করেছিলেন, তিনিই প্রথম হিন্দি সিনেমার নায়িকা যিনি প্রতি সিনেমা এক কোটি রুপী চার্জ করেছিলেন। অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ছিল তার ক্যারিয়ার, ব্যক্তিজীবনটাও কম ড্রামা, থ্রিলার, ট্র্যাজেডি আর রোমান্সে পরিপূর্ণ না। চলুন, ঘুরে আসা যাক সেই জীবনে।

শ্রীদেবী ঝড় তুলেছিলেন মিস্টার ইন্ডিয়া সিনেমায়

চার বছর বয়সে যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিল, সে যে ক্যামেরার সামনের ঐ অবস্থানকে অনেক ভালবাসবে, সেটা তো আর নতুন কিছু না। তবে অনেক জলদিই মনে হয় ভালোবাসাটা শুরু করেছিলেন! তানাহলে ১১ বছর বয়সে কেউ নায়িকা হওয়ার চিন্তা করতে পারে? তাও আবার যে সে মানুষদের বিপরীতে না, রজনীকান্ত, কমল হাসান, এনটিআর, এমজিআর, নারায়ণ রাও- সবাই তার নায়ক! যে এনটিআরের নাতনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন একসময়, সেই এনটিআরের নায়িকাও হয়েছেন। তখনই ইন্ডাস্ট্রির এক কঠিন সত্য বুঝে গিয়েছিলেন তিনি- নায়কদের বয়স বাড়ে না! এইসব নায়কদের বিপরীতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সময় টান টান হয়ে থাকতে হতো শ্রীদেবীকে- যদি দেখতে একটু হলেও লম্বা লাগে- এই জন্য!

সত্য আরেকটি ব্যাপার ছিল, তখন পর্যন্ত তার কোন সিনেমা সেভাবে ব্লকবাস্টার হয়নি। ১৬ বছর বয়সে সেটারও দেখা পেয়ে গেলেন আর এটার ক্রেডিট প্রাপ্য তামিল পরিচালক পি ভারতীরাজা। এক মালায়ালাম সিনেমাতে শ্রীদেবীর অভিনয় দেখে নিজের সিনেমা ১৬ ভায়াধিনিলে তাকে সাইন করান তিনি আর সেদিন থেকেই তিনি হয়ে উঠেন শ্রীদেবীর মেন্টর! কমল হাসানের বিপরীতে সম্পূর্ণ আউটডোরে শুট হওয়া ১৯৭৭ সালের এই সিনেমা প্রবল জনপ্রিয় হয়। তবে এই জনপ্রিয়তার সাথে সাথে আরও কিছু কথা আকাশে বাতাসে উড়তে লাগলো। মধ্য তিরিশের বয়সের এই পরিচালকের সাথে নাকি শ্রীদেবীর অন্যরকম একটা ‘সম্পর্ক’ তৈরি হয়েছিল। এমনকি অনেকদিন ভারতীরাজার বাড়িতেই থাকতেন শ্রীদেবী আর তার মা। এই সিনেমার সাফল্যের পর এবার ভারতীরাজার ইচ্ছে হল তিনি যে তিনি শ্রীদেবীকে পুরো ভারতবিখ্যাত করবেন! হিন্দিতে তৈরি করলেন সোলওয়া সাওান, শ্রীদেবীর বিপরীতে ছিলেন অমল পালেকর। সিনেমাটি করতে সেভাবে রাজি ছিলেন না তিনি, রাজি ছিলেন না এই সিনেমার প্রযোজকও! ঠিকমতো হিন্দি বলতে না পারা একটি মেয়েকে নিয়ে প্রযোজক নিজে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না, তবে ভারতীরাজা নাছোড়বান্দা! দিনশেষে এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়ালো, সিনেমা সেভাবে চলল না! মুম্বাইতে আর হবে না এটা ভেবে নিয়ে আবার চেন্নাইয়ের দিকেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীদেবী!

তবে ভাগ্যদেবী তার থেকে মুখ ঘুরাননি। এই ভাগ্যের দরজাটা খুলেছিল ১৯৮৩ সালে, জিতেন্দ্রর হাত ধরে। সাউথে কি একটা সিনেমার কাজে গিয়েছিলেন জিতেন্দ্র, সেখানেই শ্রীদেবীর সাথে কি যেন একটা “মাখোমাখো” ব্যাপার ঘটল আর তাকে হিম্মতওয়ালা সিনেমার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন জিতেন্দ্র। শ্রীদেবী কিছুটা নিমরাজি হলেও শেষ পর্যন্ত করে ফেললেন সিনেমাটা। রিলিজের পর সব পুরুষের স্বপ্নের রানী যেন বনে গেলেন শ্রীদেবী! ন্যায়নো মে সাপনা- গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তবে নিজের ৭৫ কেজি ওজনের জন্য সমালোচকদের নিন্দে জুটল শ্রীদেবীর কপালে, নিজের বিশাল উরুর জন্য “থান্ডার থাইজ” উপাধি পেয়ে গেলেন!(তখনও যে দক্ষিণের ভাবটা যায়নি তার মাঝ থেকে, তখনও যে মুম্বাইয়ের নায়িকাসুলভ চেহাহারার অধিকারী হয়ে উঠেন নি তিনি!) তবে এই সমালোচকদের মুখ তিনি বন্ধ করে দিলেন একই বছর মুক্তি পাওয়া সাদমা সিনেমাতে অসাধারণ অভিনয় করে। একটি প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক তো বলেই ফেলল- শ্রীদেবীর ক্যারিয়ারে অন্যতম মাইলস্টোন এই সিনেমা! সময় যে কীভাবে পরিবর্তিত হয়, সেটা আরও ছোট্ট একটা ঘটনা শুনলে বোঝা যাবে।

মা রাজেশ্বরী বলতেন- শরীরে হলুদ মাখবি অবসর সময়ে, বুঝেছিস? ছোট্ট শ্রীদেবী মাথা দোলাত উপরে নিচে, মায়ের কথা না বুঝলেও। মায়ের কথা উঠলেই তিনটা শব্দ বলতেন তিনি- ফ্রেন্ড, ফিলোসোফার, গাইড। গাইড মানুষকে পথ দেখায়, পথ চেনায়, সাবধান করে দেয় আসন্ন বিপদ সম্পর্কে। সম্ভবত এই কারণেই মায়ের সঙ্গ ছাড়তে চাইতেন না তিনি। চেন্নাই থেকে মুম্বাইতে আসতেন সিনেমার কাজ করতে। অনেকেই বলেছিল মুম্বাইতে ঘর নিয়ে নিতে, কিন্তু সেই কথায় একেবারেই পাত্তা দেন নি তিনি।

মুম্বাই ছিল তার কাছে "ওয়ার্ক প্লেস", আর চেন্নাই ছিল শুধুই নিজের প্লেস, "হোম সুইট হোম"। মুম্বাইতে কাজ শেষে ফিরতেন "সি রক" হোটেলে। সেখানেই গড়েছিলেন নিজের "সাময়িক" বাসস্থান। কাজ শেষ হলেই চেন্নাইতে দৌড়। হোটেলে থাকার সময় মায়ের কথা একদিন হুট করে মনে পড়ে গেল। হলুদ জোগাড় করলেন আর শরীরে মেখে বসে থাকলেন। নিজের নামের শুরুতে যেহেতু "শ্রী" শব্দটি ছিল, হলুদ মেখে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর হয়ে সেই নামের খানিকটা "শ্রী"বৃদ্ধি করা যায়- তাহলে ক্ষতি কি? আর " কমার্শিয়াল নায়িকা" হতে হলে যে চামড়ার দিকে নজর রাখতে হয়, সেটা ততদিনে ভালই বুঝে গিয়েছিলেন তিনি।

চামড়ার দিকে নজর রাখতে গিয়ে হোটেলের টাইলসের দিকে নজর রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। এতদিকে কি আর খেয়াল রাখা সম্ভব? হোটেল বয় টাইলসের অবস্থা দেখে কমপ্ল্যান করে দিলেন, ম্যানেজার এসে অনেক রাগারাগি করলেন- দামি টাইলস যে হলুদের দাগে নষ্ট হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল থাকে না আপনার? কি মনে করেন নিজেকে? নায়িকা বলে কি যা ইচ্ছে তাই করবেন নাকি?

তখনও তার কোন সিনেমা সেভাবে ব্যবসাসফল হয়নি।আর পৃথিবী যে সফল ব্যক্তি ছাড়া আর কারো কথা শুনতে চায় না, সেটা ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন। চুপচাপ শুনে গেলেন ম্যানেজারের কথা। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না বলে ওয়াদা করলেন।

এই ঘটনার পরে পেড়িয়ে গেছে প্রায় সাতটি বছর।বলিউডে ভাল একটা পরিচিতি এসেছে তার। নাগিন সিনেমার শুটিং নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত তিনি। ঘুমের মাঝেও একদিন চিৎকার করে জেগে উঠলেন, স্বপ্নে সাপ দেখেছেন এই বলে! এতটাই ডেডিকেটেড ছিলেন নিজের কাজে, যে স্বপ্নে সাপ দেখাটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গিয়েছিল তার কাছে। তবে সাথে এসেছিল হিম্মতওয়ালা আর সাদমা সিনেমার সাফল্য!

স্বপ্নে সাপ দেখলেন, বাস্তবে দেখতেন শুধু মানুষ আর মানুষ! ফ্যানরা তার একটা ঝলক দেখার জন্য পাগল হয়ে যেত। সেই "সি রক" হোটেলের বেশিরভাগ রুম বুকড থাকতো কারণ অনেকেই জেনে গিয়েছিল- এই হোটেলে নাকি "তিনি" থাকেন, কাজ শেষ হলে আবার চেন্নাইতে চলে যান। "তার" জন্যই বোধ করি, সি রকের ব্যবসার পারদ ক্রমেই উপরে উঠছিল।

উপরে ওঠা মানুষের সামনে এসে ম্যানেজার এবার নিজের মস্তক কিছুটা নত করে রাখলেন। "ম্যামের থাকা খাওয়াতে কোন প্রবলেম হচ্ছে কিনা, কিছু লাগবে কিনা?" আর হ্যাঁ, আরও একটা কথা "ম্যাম কি আগের মতো হলুদ মাখান না শরীরে? টাইলস নিয়ে চিন্তা করবেন না ম্যাম, ওটা পরিস্কার হয়ে যাবে। আপনি কিন্তু আপনার যত্ন নিতে ভুলবেন না!" শ্রী এই কথা শুনে শুধু মুচকি হেসেছিলেন।সময়টাই ছিল তার, তিনি হাসবেন না তো কে হাসবেন?

বারবার অপমানিত হয়েছে যে হোটেলে, একবার ভেবেছিলেন সেটা ছেড়েই দিবেন। তবে এই হোটেলে থেকেই তার সুপারহিট সিনেমাগুলোতে সাইন করেছিলেন তিনি, এই কারণে শেষ পর্যন্ত একটা অন্ধবিশ্বাস থেকেই হোটেলটা আর ছাড়া হয়নি তার। তাছাড়া পরের বছর অর্থাৎ ৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া তোহফা সিনেমা তো ব্লকবাস্টার হয়েছিল! যে হোটেলে একসময় আসলে তাকে আর তার মা বোনকে ছোট একটা ঘর দেয়া হতো, একই হোটেলে আসলে এখন দুটো সুইট দেয়া হয় যার একটাতে থাকতেন তিনি আর আরেকটাতে থাকতেন তার মা বা বোন। এরই মাঝে পত্রিকাগুলোতে নিউজ চলে এসেছে যে, বলিউড তার এক নবর নায়িকাকে পেয়ে গেছে। তার সাথে টক্কর দিতে পারে এরকম মানুষ বলতে গেলে তখন খুব কম- ডিম্পল কাপাডিয়া আর রেখা। হেমা মালিনির অলরেডি তখন বিয়ে হয়ে গেছে আর কে না জানে তখন বিয়ে করা মানেই নায়িকার চাহিদা শেষ! রেখা অনেকদিন কোন হিট দিতে পারছেন না আর ডিম্পল শুধুমাত্র যেন শোভাবর্ধন করতেই সিনেমাতে আসেন! ফলে দিনশেষে একজনের নামই থাকে সবার মুখে- দ্যা ওয়ান অ্যান্ড অনলি শ্রীদেবী!

শ্রীদেবীও নিজের এই অবস্থানকে বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরেও অনেকে তাকে সেভাবে সিরিয়াসলি নিচ্ছিল না- সাউথ থেকে আসার কারণে আর ঠিকমতো হিন্দি বলতে না পারার কারণে। রূপ তো তার ছিলই, কিন্তু তখনও বলিউড নায়িকা টাইপ ব্যাপারটা সেভাবে তার মাঝে আসেনি। শ্রীদেবী এই সমালচনাকে গুরুত্বের সাথে নিলেন! দিনের বেলাসারাদিন শুটিং এ বিজি থাকতেন আর নিজের বোনকে পাঠাতেন মুম্বাইয়ের উচ্চচিত্ত নারীদের ছবি তুলে আনতে। রাতের বেলা দুই বোন বসে সেইসব ছবি দেখতেন আর সেগুলো দেখে শ্রীদেবী ঠিক করতেন কীভাবে নিজেকে “নায়িকা” হিসেবে তুলে ধরবেন পর্দায়, কীভাবে নিজের মাঝে থান্ডার থাইজ এর পরিবর্তে “বলিউডিশ” ব্যাপারটা আনা যায়!

আবার অন্যদের মতো শুধু “নায়িকা” ট্যাগ নিজের সাথে লাগাতে চাননি। সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর নিজের রোল কেমন- সবসময় সেটাতে গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন- আমি নারী নই, আমি একজন অভিনেত্রী। আমাকে উদ্ধার করতে কোন পুরুষের প্রয়োজন নেই। বরং দেশের হাজার পুরুষকে আমি নিজেই উদ্ধার করে দিতে পারি! তখনকার মেইল ডমিনেটেড ইন্ডাস্ট্রিতে এই ধরনের কথা বলতে কলিজা লাগে! নিজের উপরে কী পরিমাণ বিশ্বাস থাকলে এই ধরনের কথা বলা যায়, ভাবুন একবার! প্রযোজকদের সাফ বলে দিতেন- এমন চরিত্র নিয়ে আসুন যা আমার ইমেজের মর্যাদা রক্ষা করে। কথাগুলো শুনতে উদ্ধত লাগলেও, শ্রীদেবী কিন্তু ব্যক্তিজীবনে মোটেও উদ্ধত ছিলেন না। খুব বেশি কথা বলতেন না, তবে যতটুকু বলতেন, তাতেই বোঝা যেত যে ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি শুধু ফুলদানি হয়ে সেজে থাকতে আসেননি।

এই সময়ে হেমা মালিনীকে মাথায় রেখে প্রায় ১০ বছর ধরে সাপের কাহিনীর উপরে একটি স্ক্রিপ্ট সাজাচ্ছিলেন পরিচালক হরমেশ। হেমার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তখন তিনি গেলেন জয়াপ্রাদার কাছে, যিনি সমানে তখন পাল্লা দিচ্ছে শ্রীদেবীর সাথে। দুইজন একসাথে সিনেমা করলেও একসাথে রিহার্সেলে অংশ নিতেন না, এমনকি অনেকদিন মুখ দেখাদেখিও বন্ধ ছিল- এমনই ছিল এই দুজনের প্রতিযোগিতা! তবে সাপকে ভয় পাওয়া কারণে স্ক্রিপ্ট শুনেই না করে দিলেন জয়া! উপায় না পেয়ে হরমেশ সরাসরি চলে গেলেন হোটেল সি রকে। গিয়ে তো তার আক্কেলগুড়ুম! শ্রীদেবী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, উঠে বসার ক্ষমতাটা পর্যন্ত নেই তার! পরিচালক বুঝে গিয়েছিলেন, শ্রীদেবিও না বলবেন এই সিনেমাকে। তাছাড়া সবসময় সঙ্গী হিসেবে থাকা মা রাজেসশ্বরিও চাচ্ছিলেন না, তার মেয়ে এই অবস্থায় স্ক্রিপ্ট শুনুক। কিন্তু শ্রীদেবী তাকে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাতে বলেন। অল্প কিছুক্ষণ শুনেই শ্রীদেবী বলেন- আমি সিনেমাটি করছি! পরে এক সাক্ষাৎকারে শ্রীদেবী বলেছিলেন- এরকম চ্যালেঞ্জিং কিছুই আসলে আমি এতদিন ধরে খুঁজছিলাম! তাই অন্য কিছু না ভেবেই হ্যাঁ করে দেই!

স্বামী ও দুই মেয়ের সঙ্গে শ্রীদেবী

হুট করে হ্যাঁ করে দেয়া এই নাগিনা সিনেমাই বুঝিয়েছিল স্টার শ্রীদেবীর ওজন কত! নাগিনা এমন হিট করেছিল যে পরিচালক তার শুটিং ইউনিটের প্রতিটা সদস্যকে পরের ৬ মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দিয়েছিলেন! শুধু তাই না, এই সিনেমার পরিবেশকরাও নাগিনা টীমের প্রত্যেক সদস্যকে এক মাসের বেতন বোনাস হিসেবে দিয়েছিলেন! কোন নায়িকার হাত ধরে কোন সিনেমার এই লেভেলের জনপ্রিয়তা সত্যি কথা বলতে গেলে বলিউড এর আগে দেখেনি। ফলে রাতারতি শ্রীদেবীর ব্র্যান্ড ভেল্যু তরতর করে উপরের দিকেই উঠতে থাকলো! যে জিতেন্দ্রর হাত ধরে তিনি হিট সিনেমা পেয়েছিলেন, সেই জিতেন্দ্রর সাথে আরেকটি সিনেমা করতে গিয়ে শুটিং সেটে এক পাগল ভক্ত ঢুকে যায় শুধুমাত্র শ্রীদেবীকে একটু ছুঁয়ে দেখার আশায়! আর সেই আশায় একটি দামি ক্যামেরার লেন্স ভেঙে যায় যার ফলে সেদিন আর শুটিংই করতে পারেননি জিতেন্দ্র! প্রযোজকরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, কোন সিনেমার মহরতে শ্রীদেবীর প্রথম শট দেয়া মানেই সিনেমা হিট! ফলে একই সাথে এক ডজন সিনেমা সাইন করা বা একই সাথে ৬ টি সিনেমার মহরতে শট- সবই করতে হয়েছে শ্রীদেবীকে!

নাগিনার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে মুক্তি পেল এমন এক সিনেমা, যা শ্রীদেবীর নামটা চেঞ্জ করে মিস হাওয়া হাওয়াই করে দিল! হ্যাঁ, বলছিলাম মিস্টার ইন্ডিয়ার কথা। সিনেমার নাম মিস্টার ইন্ডিয়া হলেও বেশিরভাগের কাছে শ্রীদেবীর কারণে সিনেমার নাম মিস ইন্ডিয়া হিসেবে পরিচিত হতে থাকে! অথচ এই সিনেমাটা শুরুর দিকে প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল শ্রীদেবীর হাত থেকে। শ্রীদেবী তখন সিনেমা প্রতি বেশ ভালো পারিশ্রমিকই নেন, তার যাবতীয় ব্যাপারস্যাপার দেখাশোনা করেন তার মা। প্রযোজক বনি কাপুর অনেক চেষ্টা করেও যখন এই সিনেমার জন্য রাজি করাতে পারছিলেন না, তখন হুট করে তাকে অনেকটা ভাগিয়ে দেয়ার জন্যই শ্রীদেবীর মা বলেন- ১০ লাখ টাকা দিলে আমার মেয়ে এই সিনেমা করবে। বনি কাপুর বললেন- আমি ১১ লাখ দিব! ব্যস, হয়ে গেল সিনেমা সাইন! শ্রীদেবী তখন অলরেডি সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রী, আর এই সিনেমাতে ১১ লাখ পেতে তিনি আগের সব রেকর্ড যেন ভেঙে দিলেন। তবে সব ভাঙেন নি, কিছু জোড়াও লাগিয়েছিলেন। বিবাহিত বনি কাপুরের মন শ্রীদেবীকে দেখে জোড়া লেগেছিল, সেই কাহিনীতে যথাসময়ে ফেরত আসা হবে।

মিস্টার ইন্ডিয়া ৮৭ সালের সেকেন্ড হাইয়েস্ট গ্রসিং সিনেমা আর বলিউডের কাল্ট ক্লাসিক হয়ে গেল। ইন্ডাস্ট্রিতে হইচই পড়ে গিয়েছিল শ্রীদেবীর অবিশ্বাস্য উত্থানে! সিনেমাতে চার্লি চ্যাপলিনের অনুকরণ করার সিনে শ্রীদেবী অনবদ্য ছিলেন! প্রথমে সিনটি খুবই ছোট ছিল, কিন্তু শ্রীদেবী একটেকে এত ভালো শট দেন যে শেখর কাপুর বাধ্য হয়ে এই সিনটিকে আরও অনেক বেশি লম্বা করেন! এই এক টেক নিয়েও এক কাহিনী আছে। রিহার্সেলে শ্রীদেবী সেভাবে মন খুলে অভিনয় করতেন না, তার মত ছিল ক্যামেরার সামনে দেয়া তার প্রথম শটটাই হবে তার দেয়া বেস্ট শট। এই কারণে প্রথমবারে কোন শট ভাল না হলে সেটা রিটেক দিতে গেলে শ্রীদেবী ঘাবড়ে যেতেন! কিছুতেই নাকি আর ভাল অভিনয় করতে পারতেন না এরপরে! চার্লি চ্যাপলিনের মাঝে কি এই ব্যাপারটি ছিল কিনা সেটি জানা না গেলেও, এটি জানা যায় শ্রীদেবীর সাক্ষাৎকার পড়ে যে- অভিনয়ের যা তিনি শিখেছেন, সব নাকি চার্লি চ্যাপলিনকে দেখেই শিখেছেন!

সফলতা আসার পরে মানুষ নিজের জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়, শ্রীদেবীও নিয়েছিলেন। এক লাফে নিজের পারিশ্রমিক ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখে নিয়েছিলেন। আরেকটা সিদ্ধান্ত ছিল- অমিতাভ বচ্চনের সাথে আর সিনেমা করব না। প্রথম সিদ্ধান্তে অনেক প্রযোজক প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে পরে রাজি হলেও, দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত শ্রীদেবীর ক্যারিয়ারে একটা অন্যরকম প্রভাব ফেলে। এই সিদ্ধান্ত বলিউডকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল! তবে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের পেছনে শ্রীদেবীর দিক থেকে চিন্তা করলে যৌক্তিক কারণও ছিল!

শ্রীদেবীর মতে- অমিতাভের সাথে অভিনয় করা মানে তার ছায়াতে ঢেকে যাওয়া। তার সাথে ইনকিলাব আর আখেরি রাস্তা করে সেটা টের পেয়েছিলেন তিনি বেশ ভালোভাবেই। বিশেষ করে আখেরি রাস্তায় নাকি শ্রীদেবীকে রীতিমত ঠকানো হয়েছিল। এই সিনেমার তামিল ভার্সনে শ্রীদেবীর রোল অনেক বড় ছিল, এই কারণেই হিন্দি ভার্সনে অভিনয় করতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। অবাক হয়ে খেয়াল করলেন- হিন্দি ভার্সনে তার রোলের দৈর্ঘ্য কমিয়ে দেয়া হয়েছে! ব্যস, ডিসিশন ফাইনাল- বিগ বির সাথে আর কাজ নয়!

ইন্ডাস্ট্রি অনেকটাই দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল এই সিদ্ধান্তের পর। একপক্ষ বলছিল-অবশেষে একজন নারী অমিতাভ বচ্চনকে পাওয়া গেল। আর আরেকপক্ষ ক্রমাগত সমালোচনার তীরে শ্রীদেবীকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। হুট করে এই সুযোগে অনেকে শ্রীদেবীর তখনকার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জয়াপ্রদাকে তুলে এনে বেশি প্রচার দেয়া হতে লাগলো। সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে জাভেদ আখতার, সবাই তখন জয়াপ্রদাতে মুগ্ধ ছিলেন। ফলে শ্রীদেবীর নম্বর ওয়ান আসনটাতে জয়াপ্রদা বসার চেষ্টা করেন। এই সময়েই আরেক বড় সিদ্ধান্ত নেন শ্রীদেবী। এক লাফে পারিশ্রমিক ২৫ লাখ থেকে ৩৫ লাখে নিয়ে যান! কারণ? সেভাবে জানা যায় না! তবে শ্রীদেবী এমন একটা অবস্থানে নিজের স্টার ভ্যালুকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যেন যেকোনো নায়িকাই “শ্রীদেবী” হতে চায়!

কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়! মিস্টার ইন্ডিয়ার পর আর সেভাবে হিট দিতে পারছিলেন না শ্রীদেবী। ঐদিকে জয়াপ্রদা আর মীনাক্ষি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছেন। হুট করে আবার বিবি হো তো আয়সি আর খুন ভারি মাঙ্গ দিয়ে রেখাও (যাকে কিনা শ্রীদেবী নিজের গডমাদার বলতেন) লাইমলাইটে চলে এসেছেন! এবার শ্রীদেবী একটু সুর পালটালেন। বললেন- অমিতাভের সাথে কাজ করতে সমস্যা নাই, জাস্ট পারিশ্রমিক আর স্ক্রিপ্ট যেন ঠিক থাকে।

নিজের নেয়া পরপর সিদ্ধান্তে কি শ্রীদেবী হুট করেই কিছুটা টালমাটাল হয়ে পড়েছিলেন? সমালোচকরা অমিতাভের সসাথে সিনেমা করতে রাজি দেখে এমনটাই বলা শুরু করেছিলেন। এমন বলার কারণও ছিল। যে রেখাকে নিজের গডমাদার বলতেন, যে রেখা তাকে সাজসজ্জার টিপস দিতেন, আখেরি রাস্তাতে শ্রীদেবীর ডাবিং পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন- তাকে নিয়ে শ্রীদেবী ঘনিষ্ঠ মহলে বলতে শুরু করেন- রেখাকে এভাবে এত পাত্তা দেয়ার কিছু নেই! ঘটনা এখানেই থেমে ছিল না। নাগিনার পরে রেখা শেষনাগ নামের একটি সিনেমাতে সাইন করেন যে সিনেমার সাথে আবার নাগিনার পরিচালক হরমেশ যুক্ত ছিলেন। এই সিনেমাতে রেখার জন্য বিদেশ থেকে কন্টাক্ট লেন্স আনা হয়। এই শুনেই ক্ষেপে যান শ্রীদেবী! হরমেশকে বলেন- নাগিনার সময় আমাকে তো বিদেশী লেন্স দাওনি, আমি তো দেশী লেন্সে কাজ করেছি! শুধু তাই না, আগার তুম না হোতে সিনেমাতে রেখা নিজের গলাতে গান গেয়েছিলেন দেখে নাকি চাঁদনী সিনেমাতেও শ্রীদেবী নিজের গলাতে গান গেয়েছিলেন- এমন কথাও রটেছিল! স্টারডম জিনিসটাকে অনেক বেশি সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছিলেন ততদিনে শ্রীদেবী। তার ওপরে চাঁদনী আর লামহে দিয়ে ততদিনে যশরাজ ক্যাম্পেও নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। তার সাথে পারিশ্রমিক বাড়িয়ে ততদিনে করেছেন সিনেমাপ্রতি এক কোটি! ইন্ডাস্ট্রিতে এর আগে অমিতাভ বচ্চন ছাড়া আর কারো সাহস হয়নি এভাবে রাতারাতি পারিশ্রমিক বাড়ানোর!

কিছু বাড়লে কিছু কমবে- জীবন এভাবেই ব্যাল্যান্স করে দেয়। শ্রীদেবীর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। এত বেশি পারিশ্রমিকের কারণে তার অনেক সিনেমা চলে যায় জয়াপ্রদা আর মীনাক্ষির কাছে। একটা সময় যা আসতো, তাই সাইন করতে লাগলেন শ্রীদেবী। অথচ একসময় তিনিই সবার আগে গুরুত্ব দিতেন স্ক্রিপ্টকে! অমিতাভের সাথে খুদা গাওয়াও করে ফেললেন। হিন্দি আর উর্দুতে সবচেয়ে দুর্বল ছিলেন শ্রীদেবী, অথচ খুদা গাওয়া দেখলে এই কথা শ্রীদেবীর শত্রুও বিশ্বাস করবে না- এতটাই ডেডিকেটেড ছিলেন তিনি নিজের পারফর্মেন্সে! আরও কিছু উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে ব্যাপারটা আরও ভালো করে। চালবাজ সিনেমার না জানে কাহা সে আয়ি হ্যাঁয় গানে শ্রীদেবীর নাচ দেখে মুগ্ধ হননি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, অথচ এই গানে নাচার সময় শ্রীদেবীর জোর ছিল ১০৩ ডিগ্রী। মাথা ঘোরাচ্ছিল বনবন করে, এরপরেও নেচে যাচ্ছিলেন। লামহে সিনেমার শুটিং এর মাঝে খবর পান তারা বাবা মারা গেছেন! একদিন গিয়ে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে তিনি প্রথম যে শটটা দেন, সেটি ছিল একটি কমেডি সিন। অথচ সিনটা পারফেক্টলি ওকে করেন শ্রীদেবী। সেটা দেখে সবাই হাততালি দিতে থাকেন আর শ্রীদেবী কেঁদে দেন!

শুধু সিনেমার শুটিং এ বা ক্যামেরার সামনে কাঁদেননই শ্রীদেবী। ব্যক্তিগত জীবনে এর মাঝেই তার উপরে দিয়ে বয়েছে অনেক ঝড় ঝাপটা। সেসবের জন্য নিজে কেঁদেছেন আবার কাঁদিয়েছেন অনেককেও! প্রেমের শুরুটা হয়েছিল মিঠুনের সালে, ১৯৮৪ সালে রিলিজ পাওয়া জাগ উঠা ইনসান সিনেমার শুটিং এর সময়। এরই মাঝে কখন যে নিজেদের মাঝে প্রেম জেগে উঠেছে, নিজেরাও সেভাবে টের পেলেন না। সাংবাদিকরা এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সেই পুরনো জবাব- আমরা শুধুই বন্ধু!

মিঠুনের সঙ্গে সম্পর্কটা টেকেনি শ্রীদেবীর

বন্ধুর মতো বাবা চেয়েছিলেন তার মেয়েটা সংসারীও হোক, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এক ছেলেকে ঠিকও করে ফেলেছিলেন বিয়ের জন্য! কিন্তু শ্রীদেবী নারাজ, তার মনে থখন শুধুই মিঠুন! সেই বাবা আর মেয়ের বিয়ে দেখে যেতে পারেননি, তার আগেই দুনিয়া ত্যাগ করেন। শ্রীদেবীর প্রেমের ব্যাপারে জানতেন তার মা আর বোন শ্রীলতা। শ্রীলতা মিঠুন কে বেশ পছন্দ করলেও মা রাজেশ্বরী সেভাবে মিঠুনকে পছন্দ করতেন না। দুটি মনের কথা জানতো আরও কিছু মানুষ। দুজনের প্রেমের চিঠির চালাচালির দায়িত্ব নিয়েছিলেন কোরিওগ্রাফার সরোজ খান, যিনি শ্রীদেবীকে নিজের মেয়ের মত দেখতেন। শ্রীদেবীর হোটেল সি রক থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল রেখার বাসা, সেখানে দুইটি প্রাণকে প্রেম করার জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন রেখা।

কিন্তু জায়গা ধরে রাখার জন্য একটা জিনিসই ছিল মোর দেন এনাফ, আর তা হচ্ছে- মিঠুন ছিলেন বিবাহিত! এরপরেও দুইজনে বিয়ে করে ফেললেন! নিজের মঢ আইল্যান্ডে দুইজনের কিছু ঘনিষ্ঠ মানুষের আর শ্রীদেবীর বোনের উপস্থিতিতে এই বিয়ে হয়েছিল। অনেকের মতে তাদের সংসারের স্থায়িত্বকাল ছিল ১০ দিন, আবার অনেকের মতে তা ছিল ১০ মাসের! এত অল্প সময়ে দুইজন আলাদা হওয়ার কারণ? ঐ যে, পরিবার!

মিঠুনের স্ত্রী যোগিতা এই ঘটনার ব্যাপারে জানার পরে মিঠুনকে বলেন- তোমার যা খুশি করো, শুধু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। এমনকি তিনি শ্রীদেবীর কাছে গিয়েও নাকি অনুরোধ করেছিলেন। অনুরোধের পর শ্রীদেবীর কাছে এক গ্লাস পানি খেতে চান তিনি। পানি অর্ধেক গ্লাস খাওয়া পরেই শ্রীদেবী সেই গ্লাস নিয়ে নিজে বাকি পানিটা খেয়ে শেষ করে বুঝিয়ে দেন- মিঠুন যদি অর্ধেক তোমার হয়, তাহলে বাকিটা আমার। আর আমার কোন কিছুর হক আমি ছাড়ি না!

শ্রীদেবীর মা এই সুযোগটা কাজে লাগান। তিনি শ্রীদেবীকে বলেন- মিঠুন যদি তোকে এতই ভালোবাসে, তাহলে ওকে বল সব ছেড়ে তোর সাথে এসে থাকতে। শ্রীদেবীও মায়ের কথায় গলে যান! মিঠুনকে এই কথা বলতেই মিঠুন নিজের অপারগতা স্বীকার করেন যে যোগিতাকে ছেড়ে তিনি কিছুতেই আসতে পারবেন না। রাগে, দুঃখে আলাদা হয়ে যান শ্রীদেবী। শ্রীদেবীকে মনে মনে যে বনি কাপুর ভালোবাসতেন, সেই বনি কাপুরকে সন্দেহ করে একবার তাকে দিয়ে অনেকটা জোর করেই শ্রীদেবীকে রাখী বাধিয়েছিলেন এই মিঠুন, আর সেই মিঠুন আর শ্রীদেবী শেষ পর্যন্ত একসাথে থাকতে পারলেন না, তাদের মাঝের বন্ধনটা আলগা হয়ে গেল।

এরপরে যেটা হল, সেটা অনেকটা বলিউড সিনেমার মতই। যে শ্রীদেবী ১৯৮৪ এর এক ইন্টার্ভিউতে বলেছিলেন যে তিনি কখনও কোন বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করবেন না, সেই শ্রীদেবী ১২ বছর পর ১৯৯৬ সালে বিবাহিত বনি কাপুরকে বিয়ে করলেন! এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ! পত্রিকাগুলোতে শ্রীদেবীকে সরাসরি “হোমব্রোকার” বলে ডাকা শুরু হতে লাগলো! বনি কাপুরের বাবা মা তাদের ছেলের বউ মোনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তারা কোনোভাবেই এই বিয়ে মেনে নিলেন না, উল্টো বনিকে আলাদা করে দিলেন! বনির দুইজন ভাই পর্যন্ত শ্রীদেবীকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলেন।

কিন্তু এতকিছুর পরেও, ১৯৯৭ সালে নিজের মায়ের মৃত্যুর পরেও শ্রীদেবী ভেঙে পড়েননি কারণ তার পাশে বনি কাপুর সবসময় ছিলেন। তবে বনিকে পাশে পাবার মূল্য বেশ চড়া দামে দিতে হয়েছিল তাকে। কাপুর পরিবারের কোন প্রোগ্রামে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন না। কেউ তার সাথে কথা তো দূরে থাক, দেখা পর্যন্ত করতেন না। একবার এক হোটেলের লবিতে বনির প্রথম স্ত্রীর শাশুড়ি শ্রীদেবীকে দেখতে পেয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তার তলপেটে একটা ঘুষি চালিয়ে দেন আর বলেন- তোর জন্য আমার মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে, শুধু তার জন্য! শ্রীদেবী কিছু বলেননি, দাঁতে দাঁতে চেপে কুঁজো হয়ে তলেপেটের ব্যথা সামলাতে ব্যস্ত তখন তিনি!

মাধুরী আর জুহি চাওলার যুগ শুরু হওয়ার পর বিবাহিত শ্রীদেবী আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছিলেন। ৯৭ সালে সিনেমা ছাড়ার আগে তার বলার মতো আর মনের রাখার মতো পারফর্মেন্স ছিল জুদাই। এরপরে বলিউডকে বিদায় জানিয়ে সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। জন্ম দেন দুটি কন্যা সন্তানের- জাহ্নবী আর খুশি কাপুর। ঘরে কাজকর্ম দেখা থেকে শুরু করে মেয়েদের সাথে টেনিস খেলা, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা, স্বামীর কাজে হেল্প করা- সবকিছুই এক হাতে সামলাচ্ছিলেন শ্রীদেবী, যেমনটা নিজের সিনেমার স্ক্রিপ্টের বেলায় করতেন। মেয়েদের ব্যাপারে বেসগ কেয়ারিং আর পজেসিভ ছিলেন। মেয়েরা বাইরে কোথাও গেলে রাত ১০ টার মাঝে ফিরে না এলে দুই মিনিট পর পর ফোন দিতেন তিনি। এমনকি মেয়েরা কোন ছবি ইন্সটাগ্রামে দিবে, সেটাও ঠিক করে দিতেন শ্রীদেবী! একদম যাকে বলে- পারফেক্ট মাদার!

পারফেক্ট মাদারের অন্য অনেককিছু পারফেক্ট হওয়া শুরু করছিল। মোনা কাপুরের মৃত্যুর পর দুই পরিবারের মাঝের বরফ গলতে শুরু করল। শ্রীদেবীকে বরণ করে নিল বনি কাপুরের পরিবার। তাদের পারিবারিক ফাংশনে দাওয়াত পেতে শুরু করলেন শ্রীদেবী। অর্জুন কাপুর তার বাবার সাথে দীর্ঘদিন কথা না বলে ছিলেন। এই ব্যাপারটাও ঠিক হয় শ্রীদেবীর মাধ্যমে। এতদিন যাকে অর্জুন শুধু “মহিলা” বলতেন, এবার তাকে কিছুটা সম্মান দিয়ে সম্বোধন শুরু করেন।

অনেক ব্যাপার শ্রীদেবীও নিজেও শুরু করেছিলেন নিজের তরফ থেকে। যেই জয়াপ্রদার সাথে এককালে প্রফেশনালি বেশ ভালই রেষারেষি ছিল তার, সেই জয়ার ছেলের বিয়েতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন তিনি। শুধু তাই না, বিয়ের অনেক কাজে হেল্প পর্যন্ত করেছিলেন!

এগুলো শুনলে নিশ্চয় মনে হয় যে সিনেমা থেকে দূরে থেকে ফ্যামিলি লাফি নিয়ে, নিজের পার্সোনাল লাইফে অনেক বেশি আনন্দিত ছিলেন শ্রীদেবী? এমনটা আসলে মনে হলেও, এমনটা আসলে ছিল না। নিজের বয়স হয়ে যাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না রূপের দেবী। তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নাকি প্রায়ই নিজের বুড়িয়ে যাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতেন তিনি। সারাক্ষণ নাকি ওজন ধরে রাখার চেষ্টা আর মুখের বলিরেখা ঢাকার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যেতেন তিনি। ফলাফলস্বরুপ বারবার নিজেকে সঁপে দিয়েছেন ছুরি কাঁচির নিচে। ২৯ বার নাকি অপারেশনই করেছেন ইয়ং থাকার জন্য! বোটক্সের কথা না হয় বাদই দিলাম! সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমা করার সময় শ্রীদেবীর চওড়া নাক আর বলিউডে আসার পর শ্রীদেবীর নাক দেখলে যে কেউই বুঝতে পারবে, সেটা শুধু মেকাপের কারসাজিতে জীবনেও সম্ভব না।

সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার সেলেব্রিটি কসমেটিক সার্জন ডক্টর রাজ কনোডিয়ার “বিশেষ” বন্ধু ছিলেন শ্রীদেবী। এই ডক্টরের সাথে তার পরিচয় ঘটে শাহরুখ খানের মাধ্যমে। ডক্টরের ইন্সটাগ্রাম আর টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘাঁটলেই শ্রীদেবীর সাথে তার শত শত ছবি পাওয়া যাবে। বন্ধুত্বটা কী কারণে, সেটা আশা করি পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন! কিন্তু যে জিনিসটা বুঝতে পারি না, সেটা হচ্ছে- কেন এত রূপ ধরে রাখার অদম্য ইচ্ছা? কেন এত কৃত্তিমতার আশ্রয় নেয়া? কেন বারবার নিজেকে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ছুরি কাঁচির নিচে সঁপে দেয়া আর সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেই মুখের উপরে অস্বীকার করে- একদম না! ডায়েট আর ইয়োগাই আমার ফিটনেসের মূলমন্ত্র বলা? আমাদের শ্রীদেবী তো কৃত্তিমতার সাহায্য ছাড়াই জনপ্রিয় হয়েছিলেন, নিজের অভিনয় প্রতিভা দিয়েই!

অভিনয় প্রতিভা সবাইকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই সম্ভবত আরেকবার পর্দায় হাজির হয়েছিলেন ইংলিশ ভিংলিশ আর মমের মতো সিনেমা দিয়ে! কি দুর্দান্ত কামব্যাক, একদম যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন নিজের নামের ওজনটাকে! সবাই যখন ভেবেই নিয়েছিলেন, শ্রীদেবীর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংসটাও হবে দেখার মতো, তখনও ঘটল সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা যা দেখার কথা কেউ কখনও কল্পনাও করেনি!

২০১৮ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি শ্রীদেবীর মৃত্যু সংবাদ এল! সবাই যেন হতভম্ব! ফ্যানরা তো বিশ্বাসই করতে পারছে না! দুবাইতে নিজের এক আত্মীয়র বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিলেন শ্রীদেবী, সেখানেই নাকি হোটেলরুমের বাথটাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। মৃত্যুর কারণ? হার্ট অ্যাটাক! কম জলঘোলা হয়নি আবার এই মৃত্যু নিয়ে। দুবাইতে প্রথমে গিয়েও পড়ে মুম্বাইতে ফিরে আসেন বনি কাপুর। এরপরে ২৪ তারিখে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ ডিনারে নিয়ে যাবেন বলে আবার দুবাইতে আসেন তিনি। হোটেলে গিয়ে যখন শ্রীদেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন তিনি, তখন সময় ছিলা বিকাল সাড়ে পাঁচটা। ১৫ মিনিট গল্প করার পর ফ্রেশ হতে বাথরুমে যান শ্রীদেবী। অনেকক্ষণ পরেও সেখান থেকে বের না হওয়ায় বনির সন্দেহ হয় আর বাথরুমের দরজা ভেঙে ঢুকে তিনি শ্রীদেবীকে অচেতন অবস্থায় বাথটাবে দেখতে পান। সেখান থেকে দুবাইয়ের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীদেবীকে। দুবাই পুলিশের কাছে রাত ৯ টায় খবর যায়।

সমস্যা শুরু হয়, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বের হওয়ার পর। সেখানে বলা হয় হাসপাতালে শ্রীদেবীকে মৃত অবস্থাতেই আনার হয়েছিল। আরও বলা হয়, দুয়াবি পুলিশের কাছে খবর রাত নয়টায় না বরং রাত সাড়ে দশটায় পৌঁছায়! শ্রীদেবীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন আর শরীরে এলকোহল পাওয়া যায়, এমনটাও নাকি রিপোর্টে পাওয়া যায়। রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ ছিল- এক্সিডেন্টাল ড্রাউনিং অর্থাৎ দুর্ঘটনায় ডুবে মৃত্যু। ফুসফুসে পানি যাওয়ার কারণে ডুবে মৃত্যু বলা যেতে পারে তবে সে, কিন্তু সেটা যে দুর্ঘটনাই; খুন না-সেই ব্যাপারে শিউর হওয়া গেল কীভাবে? তাছাড়া ৫ ফুট সাড়ে ৬ ইঞ্চির শ্রীদেবীর বাথটাবে ডুবে যাবেন- জিনিসটা হজম করতেও খানিকটা সমস্যা হয়।

শেষ যাত্রায় শ্রীদেবী

আবার অমর সিংয়ের মতো মানুষ বলেছেন- শ্রীদেবী নাকি মদ্যপান করতেন না! আবার এটাও শোনা যায়, ঘরে বনি কাপুর থাকার সময় এক ওয়েটার নাকি পানি নিয়ে এসেছিল তবে অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে কোন সাড়া না পেয়ে সে চলে যায়! বনি কাপুরকে আটক করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রশ্ন করা হয়, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। হুট করেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়, বাকিসব ব্যাপার নিয়েও সবাই মাথা ঘামানো বন্ধ করে দেয়।

অনেকে এখনও বনি কাপুরকে সন্দেহ করেন, অনেকে বলেন রূপ ধরে রাখার নিমিত্তে ছুরি কাঁচির নিচে নিজেকে অজ্ঞান রাখার জন্য যে এনেস্থেসিয়া ব্যবহার করা হতো, সেটাই হয়ত শেষ পর্যন্ত হার্ট অ্যাটাকের নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্রীদেবীর জন্য। তবে কিছু জিনিস ভাবলে খুবই অবাক লাগে, সি রক হোটেলে নিজের স্টারডম পাওয়া মানুষটাকে শেষ মুহূর্তে পাওয়া গেল দুবাইয়েরই আরেক নামীদামী হোটেলে। বনির প্রথম স্ত্রী মারা যায় অর্জুন কাপুরের প্রথম সিনেমা মুক্তির আগে আর শ্রীদেবী মারা যান নিজের মেয়ে জাহ্নবী কাপুরের প্রথম সিনেমা ধাড়াকের মুক্তির আগে। দুই মায়ের কেউই তাদের সন্তানের বড় পর্দায় অভিষেক দেখে যেতে পারেননি।

তবে দর্শক হিসেবে আমরা দেখেছি শ্রীদেবীর উত্থান, মজেছি তার রূপে আর অভিনয়ে, শুধু পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে পড়ে না, নিজের চোখে দেখেই বিশ্বাস করেছি- মেল ডমিনেটেড বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম ফিমেল সুপারস্টার ছিলেন এই শ্রীদেবীই, আর সেটার একদম যোগ্য ছিলেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রি ছাড়ার আগে স্টারডমের যে মুকুটটা তিনি খুলে রেখে গিয়েছিলেন, এখনও কি কেউ সেই মুকুটটা পরার যোগ্যতা অর্জন করেছে এত বছরে? সম্ভবত না!

এই কারণেই দেবী অনেক, আর শ্রীদেবী একজনই!

তথ্যের জন্য ঋণী- আনন্দলোক, আনন্দবাজার পত্রিকা, ফিল্মফেয়ার, স্টারডাস্ট, সিনেব্লিটজ, কুইন অফ হার্টস : লেখিকা ললিতা আইয়ার (শ্রীদেবীর বায়োগ্রাফি বই), ইউটিউব। 

লেখকের কথা- ছোটবেলায় দেশের বাইরে আমার প্রথম যে অভিনেত্রীর প্রতি ক্রাশ বা প্রেম বা মুগ্ধতা এসেছিল, তার নাম শ্রীদেবী। আজ তার জন্মদিন। তার একজন ছোট ভক্ত হিসেবে আমার ক্ষমতাও খুব ছোট। তাই তাকে শ্রদ্ধা দেয়ার জন্য এই বিরাট লেখাটি লিখেছি। পুরো লেখাটি লিখতে আমার প্রায় এক মাসের মতো পড়াশুনা করতে হয়েছে। এই লেখাটি লিখতে আমার সময় লেগেছে নয় ঘণ্টার মতো। খুব কম লেখা লিখতেই আমার এত কষ্ট করতে হয়েছে। একটা সময় গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি এই লেখা আর শেষ করতে পারব না। অনেকবার উঠে গেছি লেখার মাঝখানে। এমনও রাত গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারের সমানে বসে আছি কিন্তু একটা শব্দও বের হচ্ছে কীবোর্ড থেকে। এই লেখাটা শেষ করতে না পারলে আমি এবারের বইমেলাতে নিজের বইটা আর বের করতাম না। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। রোদেলা থেকে প্রকাশিত বইমেলা-২০১৯ এ আমার বই সিনেমামার সবচেয়ে শেষ লেখাটি হচ্ছে এই লেখাটি। আর কে না জানে, শেষ ভালো যার; সব ভালো তার?

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা