বাবা দিবসের শুভেচ্ছায় তাহসানের নাম নিতে ভুলছেন না তিনি, ছোট্ট আইরাকে তো নিজের বন্ধুই বানিয়ে ফেলেছেন। ভালোবাসার টানে কাঁটাতার পেরিয়ে আসা মানুষটাকে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়ার বদলে কেন আমরা নোংরা আচরণ উপহার দিচ্ছি?
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- 'যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শীর ঘুম নাই।' সৃজিত-মিথিলা-তাহসান ইস্যুতে আলোচনা উঠলে মাঝেমধ্যেই আমার এই প্রবাদটার কথা মনে পড়ে। মিথিলা-সৃজিতের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের কত মাথাব্যথা, তাহসানের জন্য কেঁদে আমরা বুক ভাসাই, মিথিলাকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, নিয়ম করে তার চরিত্র হনন করা হয়, নিজেদের চারিত্রিক সনদপত্র বিলিয়ে আসা হয় তাদের ফেসবুক পেজের কমেন্টবক্সে। অথচ এই তিনটা মানুষের মধ্যে আহামরি বন্ধুত্ব না থাকলেও, পারস্পরিক সম্মানের চমৎকার একটা সম্পর্ক আজও বিদ্যমান।
আমরা যতোই নোংরামি করি, কাদা ছুঁড়ে মারি তাদের দিকে, তারা সেসবে গা ভাসান না, বরং একে অন্যের প্রশংসা করেন, বিশেষ দিবসে উইশ করেন একজন আরেকজনকে। গতকাল বাবা দিবসেই যেমন সৃজিত মূখার্জী টুইটারে তাহসানকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানালেন, ধন্যবাদ দিলেন আইরার (তাহসান-মিথিলার একমাত্র মেয়ে) মতো চমৎকার একটা 'অ্যাঞ্জেল'কে উপহার দেয়ার জন্য।
মিথিলা টুইট করেছিলেন সৃজিতকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে, লিখেছিলেন, 'হ্যাপি ফাদার্স ডে আইরার আব্বু।' সেটা নিজের প্রোফাইল থেকে শেয়ার দিয়ে সৃজিত লিখেছেন, ‘ধন্যবাদ আইরার আম্মু। তাহসানকেও বাবা দিবসের শুভেচ্ছা। আমাদেরকে এমন একটি অ্যাঞ্জেল (আইরা) উপহার দেওয়ার জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাই।’
খুবই ছোট্ট আর সামান্য একটা ব্যপার। বাবা দিবসে আইরার জন্মদাতা বাবার কথা সৃজিত ভোলেননি, জেন্টেলম্যানশীপের চূড়ান্ত নজির রেখেছেন তাহসানকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে। এই দুটো গুণী মানুষের মধ্যে এর আগেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেখা গেছে অনেকবার। তাহসানের গান, পিয়ানো বাজানো, সবকিছুর দারুণ ভক্ত সৃজিত, ইন্টারভিউতে সেসব তিনি বলেছেনও। তার কণ্ঠে বারবার প্রকাশ পেয়েছে তাহসানের প্রতি মুগ্ধতা।
মিথিলা বা সৃজিত সম্পর্কে তাহসান কখনও মিডিয়াতে কিছু বলেননি, না পজিটিভ কিছু, না নেগেটিভ কিছু। কিন্ত সৃজিতের সঙ্গে তার কথা হয়েছে, দুজনে আড্ডা দিয়েছেন পাশাপাশি বসে, তাহসান-মিথিলার মেয়ে আইরার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছে সৃজিতের। নিজের মেয়েকে একজন বাবা যতোটা আদর-স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে, আইরার প্রতি সৃজিতের ভালোবাসা এর চেয়ে এক বিন্দুও কম নয়।
এই যে চোখের সামনে এতগুলো টাটকা উদাহরণ, তাতেও আমাদের নোংরা মনে তৃপ্তি আসে না, থামতে ইচ্ছে হয় না আমাদের। পাপের পঙ্কিলতায় গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা আমরা তবুও বাজে মন্তব্য করে যাই, নিজেদের চরিত্রের ঠিক না থাকা আমরাই মিথিলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলি! একজন মানুষ একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরেকটা সম্পর্কে জড়াতেই পারেন- এই স্বাভাবিক জিনিসটা কেন কিছু মানুষের সহ্য হয় না- এই রহস্যের কোন সমাধান নেই!
আমাদের চোখে তাহসান-মিথিলা ছিলেন ড্রিম কাপল। কিন্ত দুজন মানুষ ভালো হলেই যে তারা সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে পারবেন, এমন কোন কথা নেই। মতের মিল না হতেই পারে, মিথিলা আর তাহসানেরও হয়নি। একটা পর্যায়ে তারা আলাদা হয়েছেন, সম্পর্কটা শেষ করেছেন, তবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে লিপ্ত হননি, অভিযোগের তীর ছুঁড়ে মারেননি একে অন্যের দিকে। পারস্পরিক সম্মানটা বজায় রেখেছেন তারা, নিজেদেরকে রেখেছেন শ্রদ্ধার আসনে। মিথিলা-তাহসান আলাদা হয়ে যাওয়ায় অনেকের মধ্যেই একটা খারাপ লাগা কাজ করেছে হয়তো, কিন্ত জীবনটা তো তাদের, তারা কি করবেন, একসঙ্গে থাকবেন কি থাকবেন না, নতুন সম্পর্কে জড়াবেন কি জড়াবেন না- সেসব ঠিক করে দেয়ার আমরা কে?
মিথিলার নতুন সম্পর্ক নিয়ে তাহসানের কোন আপত্তি ছিল না কখনও, সৃজিতের সঙ্গেও তার দারুণ সম্পর্ক, সেই সম্পর্কে সম্মান আছে, শ্রদ্ধা আছে। সেই শ্রদ্ধাবোধটা আমাদের মধ্যে নেই, হয়তো কখনও আসবেও না। আমরা তাহসানের পক্ষ নিয়ে মিথিলাকে গালিগালাজ করি, আমরা ভাবি তাতে বুঝি তাহসানকে ভালোবাসা হলো! এটা যে নিকৃষ্ট পর্যায়ের নোংরামি, সেটা আমাদের মাথায় ঢোকে না। ভালোবাসাটা সত্যিকারের হলে দূরে থেকেও যে শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা যায়, সেটা তাহসান-মিথিলা দেখিয়ে দিয়েছেন, সেটা থেকে আমরাই শুধু শিক্ষা নিতে পারি না কখনও।
আমার মনে আছে, সৃজিত-মিথিলার বিয়ের দিন শিল্পী অনুপম রায় সৃজিতের সঙ্গে একটা ছবি আপলোড দিয়েছিলেন ফেসবুকে। এদেশের কিছু কুলাঙ্গার দলে দলে গিয়ে সেখানে মিথিলা আর সৃজিতকে গালিগালাজ করে এসেছে। ধৈর্য্যশীল মানুষ হিসেবে অনুপম রায়ের সুনাম আছে, তিনি পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সেই পোস্টের কমেন্ট অফ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই যে খেয়ে না খেয়ে আমরা সেলিব্রেটিদের পেছনে পড়ে যাই, ব্যক্তি আক্রমণে মেতে উঠি, কোন দোষ ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে নোংরামিতে মত্ত হই- এসবের পেছনে কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না, পাওয়া সম্ভবও না মনে হয়।
আমার খারাপ লাগে সৃজিত মুখার্জীর জন্য। এই লোকটা মিথিলাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর ছিলেন তিনি, কত নায়িকার সঙ্গে তার প্রেমের গুঞ্জন তৈরী করেছে কলকাতার মিডিয়া। সেই গুণী লোকটা ভালোবাসার টানে কাঁটাতার পেরিয়ে ছুটে এলেন এই বাংলায়। মিথিলার বিরুদ্ধে যখন অনলাইনে নোংরামির মচ্ছব বসেছে, মিথিলা আইনের আশ্রয় নিয়েছেন, তখন সৃজিত পাশে ছিলেন, সাহস যুগিয়েছেন তাকে। তাহসান-মিথিলার মেয়ে আইরাকে তিনি নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসেছেন, আইরাও তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। দুজনের একসঙ্গে তোলা ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়, সৃজিতকে নিয়ে আইরার মধ্যে কোন আপত্তি নেই।
তাহলে আমাদের কেন এত আপত্তি? সৃজিত-মিথিলার সম্পর্ক নিয়ে তাহসানের মাথাব্যথা নেই, আইরার মাথাব্যথা নেই, আমাদের কেন এত দুশ্চিন্তা? যে মানুষটাকে জামাই আদর করার কথা ছিল, সম্মানের আসনে বসানোর কথা ছিল, সেই সৃজিতকে কেন আমাদের গালাগালি আর নোংরামির শিকার হতে হচ্ছে অযথাই? এই প্রশ্নের জবাব কি জানা আছে কারো?