অর্থনীতিতে স্নাতক করা ছেলেটার মাথায় যে ফিল্মের পোকা ঢুকে বসেছিল, সেটা টের পাওয়া যায়নি। চলচ্চিত্রের সায়েন্স-আর্টস-কমার্স গুলে খাওয়া সেই ছেলেটা যে বাংলা সিনেমাকে নতুন একটা দিগন্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন, সেটাও ভাবেনি কেউ...
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের প্রধান সমরেশ মুখোপাধ্যায় একাধারে কবি, শিক্ষক ও শিল্পী ছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন এনাটমি বিভাগের একজন শিক্ষক। তাদের সন্তান যে বুদ্ধিজীবী গোছের কেউ হবে সেটাই হয়তো সবাই ভেবেছিল। হলোও তাই… প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক করে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতেই এমফিল ও পিএইচডি। সবকিছু ট্র্যাকমতোই এগুচ্ছিল। কিন্তু ছেলে যে তাদের অফট্র্যাকের সেটা বুঝতেও তাদের সময় লাগে নি।
অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে কাজ করতে করতেই দিল্লীতে ইংরেজি সার্কিট থিয়েটারের সাথে কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আর বরুন চন্দকে নিয়ে নামিয়ে ফেলেন “ফেলুদা ফেরত” নামের এক নন-ক্যানোনিকাল নাটক। এরপর অঞ্জন দত্তের সঙ্গে “ম্যাডলি বাঙালি” আর অপর্ণা সেনের সাথে “ইতি মৃণালিনী” চলচ্চিত্রে কাজ করেন সহযোগী হিসেবে। এদের সাথে কাজ করার সময়ই শিখে নেন কীভাবে একটা সিন লিখতে হয় আর কীভাবে সেটা সেলুলয়েডের ফিতায় অনুবাদ করতে হয়।
ধীরে ধীরে তিনি চলচ্চিত্রের ৩ টি প্রধান অংশকে আত্মস্থ করে নেন- চলচ্চিত্রের সাইন্স, কমার্স আর আর্টস। অর্থাৎ কীভাবে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলচ্চিত্রে উৎকর্ষতা আনা যায়, কীভাবে চলচ্চিত্রকে সঠিকভাবে বিপণনযোগ্য করা যায়, আর কীভাবে চলচ্চিত্রের সাথে শিল্পের মিশেল ঘটানো যায়। সহযোগী হিসেবে কাজ করার সময় অঞ্জন দত্ত, ক্যামেরাম্যান, ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি সবাই তার প্রশ্নের পর প্রশ্নে ভয়ে তটস্থ থাকতো। কেউ বুঝতো না এতো কিছু জেনে ছেলেটা কি করবে!
চলচ্চিত্র জগতে তারপর তার আবির্ভাব গীতিকার,লেখক ও অভিনেতা হিসেবে। চলচ্চিত্র জগতকে ভালমতো বোঝার জন্যই হয়তো বারবার পার্শ্বচরিত্রের বেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মাথায় তখন তার নিজের চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখা চলছে। বারবার সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। ভাবছেন বড় কিছু একটা। অফট্র্যাকের কিছু...
সৃজিত বসে আছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর বাসায়। বাংলা থিয়েটারের এই মহারথীর কাছে এসেছেন তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্রে একটি চরিত্র করানোর জন্য। যে রুদ্রপ্রসাদ “সিটি অফ জয়”, তার সর্বশেষ চলচ্চিত্রটি করেছিলেন সেই ১৯৯২ সালে, সেই রুদ্রকে কী তিনি রাজি করাতে পারবেন আবার চলচ্চিত্রে অভিনয় করানোর জন্য? এই রুদ্রপ্রসাদের স্ত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তই সত্যজিৎ রায়ের “ঘরে বাইরে” চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আর তাই রুদ্রপ্রসাদকে রাজি করানোর জন্য আগে স্বাতীলেখাকেই স্ক্রিপ্ট পড়িয়ে রাজি করিয়েছেন সৃজিত। এখন অপেক্ষা কেবল রুদ্রের ‘হ্যাঁ’ বলার।
“নায়ক” চলচ্চিত্রে শর্মীলা ঠাকুরের বলা সেই ডায়লগ- “বাংলা সিনেমায় বাস্তবিকতার অভাব আছে” সৃজিতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতার মেইনস্ট্রিম সিনেমার প্রধান নায়ক প্রসেনজিতকে দিয়ে অফট্র্যাকের চলচ্চিত্র করানোর জন্য সাহসের চেয়ে বেশি দুঃসাহস প্রয়োজন ছিল। আর সেটা সৃজিতের ছিল বৈকি। বেশ বড় একটা ব্রেকের পর প্রসেনজিতও যেন নিজেকে ভেঙ্গে গড়তে চেয়েছিলেন। তারপর আর কি? নির্মিত হল অটোগ্রাফ, মুখ্য চরিত্রে প্রসেনজিত। বুম্বাদা'র গুরুর ভূমিকায় রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। সাথে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ভেটেরান দেবজ্যোতি মিশ্র আর আনকোরা অনুপম রায়। সবগুলো বাজি জিতে নিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এরপর থেকে কেবল অবিরাম ছুটে চলা...
২২ শে শ্রাবণ, অফট্র্যাক মুভিতে শিল্প-সাহিত্য, সাথে রগরগে সাসপেন্স আর মেইনস্ট্রিম মাল-মশলা, পারফেক্ট সবদিক থেকেই। শহুরে ইন্টেলেকচুয়াল দর্শক থেকে শুরু করে, সাধারণ ধুতি পড়া দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়লো হলে। ক্রিটিকস, বক্স অফিস দু জায়গাতেই বাজিমাত। হেমলক সোসাইটি, আবারও ভিন্ন কিছু। “এখানে কিভাবে সুইসাইড করতে হয় শেখানো হয়”, হুটহাট ডিপ্রেসড হয়ে যাওয়া তরুণ প্রজন্ম গিলে খেলো যেন মুভিটি। শ্রুতিমধুর গান আর সাবলীল অভিনয় সবদিক দিয়ে আবারও বাজিমাত।
মিশর রহস্যে ফেলুদা আর ব্যোমকেশে ঘোরোঘুরি করা কলকাতার চলচ্চিত্রকে আবারও নতুন কিছু দেয়ার প্রয়াস সৃজিতের। প্রসেনজিতের ‘কাকাবাবু’ লুক লুকোনোর জন্য বেজায় কড়াকড়ি আর বাজেটের আধিক্য প্রত্যাশার বেলুন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। সেই প্রত্যাশার পারদ কমে গেল চলচ্চিত্র মুক্তির পর। তবুও সৃজিতের নতুন কিছু দেয়ার প্রয়াস প্রশংসাযোগ্য।
কিছুটা সময় নিয়ে সৃজিত আবারও এলেন “জাতিস্মর” নিয়ে। এই চলচ্চিত্র হয়তো হতোই না যদি না কবির সুমন এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব কাঁধে না নিতেন। সুমনের মৃত্যুকঠিন ভক্ত সৃজিত কোনভাবেই ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না এ ব্যাপারে। কবির সুমনকেও তাই বনবাস ছেড়ে আবারও ফিরতে হয় রঙিন চলচ্চিত্রের জগতে। কবিগান; বাংলা সাহিত্যের এক হারিয়ে যাওয়া অংশকে সৃজিত জীবন দান করলেন রিইনকারনেশন দিয়ে।
সত্যিকার অর্থেই পুনর্জন্ম হল যেন এন্থনি ফিরিঙ্গির। উত্তম কুমারের সেই এন্থনি আবারও সেলুলয়েডের পর্দায় এলো প্রসেনজিতের হাত ধরে। সৃজিত তার নিজস্ব নির্দেশনায়ও নিয়ে আসলেন অনেক নতুনত্ব। সেলফ ক্যামেরা পোট্রেয়াল, ড্রোনক্যামেরা, সিম্বলিক ইফেক্টস অ্যান্ড ডায়লগস, সিম্বলিজমকে যেন ঘাড় ধরে আবার পরিচয় করালেন সাধারণ দর্শকদের সাথে। গানেও তার বিস্তৃতি লাভ…
“এসেছি আগেও আমি যখন তুমি পদ্মাবতী, কবেকার পুঁথির শোলোক তোমার মতোই অশ্রুমতী।”
কবির সুমনের পারফেকশনিজম, রুপঙ্করকে দিয়ে বারবার বারবার এই গান রেকর্ডিং করা, ইতিহাস গড়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছিল বোধহয়। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে ইতিহাস গড়েও ফেলে জাতিস্মর। এরপর আর কি করা যায়? কলকাতার চলচ্চিত্রে নতুন ধারা সৃষ্টি হয়ে গেছে সেই কবেই তার হাত ধরে। এবার আর কি করা যায়? এখানেই কি থেমে যাবে সৃজিত!
কিন্তু না তিনি থামেন নি। একই বছর সৃজিত হাজির হন চতুষ্কোণ নিয়ে। এই চলচ্চিত্রের শুরুর দৃশ্য কোনভাবেই রিলেট করা যায় না চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য না আসা পর্যন্ত। আপনার মনে হতে থাকবে একসাথে দুটি চলচ্চিত্র দেখছেন, এক গল্পে সাদা-কালো অতীতের কোন এক গল্প বলা হচ্ছে আর অন্য গল্পে চারজন মানুষ আরও চারটা গল্প বলার চেষ্টা করছে। এর মাঝে শুরু হয়ে যায় সৃজিতের রং নিয়ে খেলা, নীল-লাল-সবুজ আর শেষমেশ সাদা-কালো। অর্থাৎ শেষের গল্প প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যায় কিন্তু। চার রঙ্গে রঙিন, চার দৃষ্টিকোণে বর্ণন- “চতুষ্কোণ”।
এর আগের প্রতিটি চলচ্চিত্রেই সৃজিত সিম্বলিজম, মেইনস্ট্রিম মশলা, শিল্পতত্ত্ব সবকিছুর মিশেল রেখেছিলেন। কিন্তু এবার কেবল সিম্বল নিয়েই খেলা করতে চাইলেন এক মুভিতে। “নির্বাক”, এক্সপেরিমেন্টাল ওয়ার্ক হিসেবে কাস্টিং বেশ হাই প্রোফাইল হলেও, বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও সৃজিতের কাজের মুগ্ধ দর্শক হলে এই চলচ্চিত্রটিও আপনাকে মুগ্ধ করবে। রাজকাহিনী আর জুলফিকার নিয়ে কিছু লিখলাম না কারণ আমার ব্যক্তিগত ধারণা মতে, এই দুটো মুভি সৃজিতের ক্লাস অনুযায়ী হয়নি, হয়নি এরপরের বেশ কয়েকটিও। কেন হয়নি, কী কারণে বললাম সেটা নিয়ে অন্য কোন লেখায় বলা যাবে ক্ষণ।
বিশাল এই নিবন্ধ শেষ করছি সৃজিতের ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ দিয়ে যেখানে বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে সৃজিত তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন-
Bengali cinema has changed over the years. It’s become glossier though the technology and the budgets we work with here, can’t be compared to the ones used in Bollywood. The exposure to international cinema also has a trickle-down effect. The kind of films that I believe in shouldn’t be branded as intellectual stuff. By intellectual stuff, I only mean movies which are extremely abstruse, tangential and self-indulgent. All these terms are very relative but like everyone else, I have an individualistic set of parameters for defining these.
বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন এক দিগন্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে জন্মদিনের অশেষ শুভকামনা। সৃষ্টি আর জয়ের গল্প চলুক নিরন্তর...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন